প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ নিজ প্রয়োজন মেটানোর প্রচেষ্টায় সচেষ্ট ছিল। মৎস আহরণ, কৃষিকাজ, পশু শিকার, পণ্য বিনিময়, উৎপাদন প্রচেষ্টা প্রভৃতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিল। এর মূলে যে জিনিস কাজ করে তাহলো মানুষের অভাববোধ। অভাব পূরণের লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে এবং অর্থ উপার্জনের প্রচেষ্টা চালায় । মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও লেনদেনকে ঘিরেই উদ্ভব হয় ব্যবসায়ের।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা জানতে পারব—
সূত্র: ক্যামব্রিয়ান পাবলিকেশন্স
জলিল বন থেকে বেত সংগ্রহ করে তা দ্বারা পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে সোফা, মোড়া ইত্যাদি তৈরি করে
জনাব কামালের দোকানে সরবরাহ করে । কামাল সেগুলো ঢাকা শহরের বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করে ।
বাজারজাতকরণ
উৎপাদন
প্রমিতকরণ
বাজার গবেষণা
স্বত্বগত
প্রচারগত
অর্থগত
রূপগত
সাধারণভাবে কোনো কিছু কেনা-বেচার কার্যক্রমকে আমরা ব্যবসায় হিসাবে জানি। কিন্তু শুধুমাত্র কেনা-বেচার সাথে ব্যবসায় সম্পৃক্ত নয়। ব্যবসায় হলো উৎপাদন, বণ্টন এবং উৎপাদন ও বণ্টনের সহায়ক কার্যাবলি। আমরা ব্যবসায়কে একটি ছকের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারি-
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে ব্যবসায় বলে। পরিবারের সদস্যদের জন্য খাদ্য উৎপাদন করা, হাঁস-মুরগি পালন করা, সবজি চাষ করাকে ব্যবসায় বলা যায় না। কিন্তু যখন কোনো কৃষক মুনাফার আশায় ধান চাষ করে বা সবজি ফলায় তা ব্যবসায় বলে গণ্য হবে। তবে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যবসা বলে গণ্য হবে যদি সেগুলো দেশের আইনে বৈধ ও সঠিক উপায়ে পরিচালিত হয়। মানুষ তার অভাব পূরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন পণ্য বা সেবা উৎপাদন, বণ্টন, উৎপাদন ও বণ্টনের সহায়ক কার্যক্রমে নিজেকে সম্পৃক্ত করে এবং মুনাফা অর্জন করে। এ মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে সম্পাদিত অর্থনৈতিক কার্যক্রমকেই ব্যবসায় বলে ।
সমাজ বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে ব্যবসায় পণ্য ও সেবা উৎপাদন ও বণ্টন কার্যাবলির সাথে সংশ্লিষ্ট। মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত এরূপ কার্যাবলির কতকগুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যা নিে উপস্থাপিত হলো—
অভাব পূরণের প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার উৎপাদন ও বণ্টন এবং এর সহায়ক যাবতীয় কার্যাবলি ব্যবসায়ের আওতাভুক্ত। অর্থাৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ হতে আরম্ভ করে তৈরি পণ্য বা সেবা ভোক্তার হাতে পৌছানো পর্যন্ত সকল কার্যাবলিই ব্যবসায়ের আওতা বা পরিধির অন্তর্ভুক্ত।
শিল্প উৎপাদনের বাহন। যে কর্ম প্রচেষ্টা বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং এর উপযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের ব্যবহার উপযোগী পণ্য প্রস্তুত করা হয় তাকে শিল্প বলে। শিল্পের বৈশিষ্ট্য সমূহ—
শিল্পকে নিম্নোক্ত বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—
প্রাথমিক শিল্পে কোনো রূপগত পরিবর্তন ঘটে না । প্রাথমিক শিল্পকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে ।
যে প্রক্রিয়ায় সম্পদের রূপের পরিবর্তন ঘটে তাকে গৌণ শিল্প বলে । নিম্নে গৌণ শিল্পের সম্ভাব্য আওতাগুলো তুলে ধরা হলো—
এ প্রক্রিয়ায় একাধিক যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ সংযোজন করে নতুন পণ্য তৈরি করা হয়। যেমন-মোটর শিল্প, রেল ইঞ্জিন।
শিল্পে উৎপাদিত পণ্য প্রকৃত ভোগকারীর নিকট অথবা কাঁচামাল ও অর্ধ প্রস্তুত পণ্য পরবর্তী ভোগকারী বা উৎপাদকের নিকট পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল প্রতিবন্ধকতাকে দূরীকরণের জন্য গৃহীত যাবতীয় কাজের সমষ্টিকে বাণিজ্য বলে ।
১. পণ্য সংগ্রহ ও বণ্টন: পণ্য উৎপাদন হয় এক স্থানে এবং ভোগ হয় বিভিন্ন স্থানে । বাণিজ্য ব্যবসায়, পরিবহণ, গুদামজাতকরণ, বীমা, ব্যাংকিং ও প্রচার ব্যবস্থার মাধ্যমে ঐ সমস্ত পণ্য সংগ্রহ করে বণ্টন করে ।
২. উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্যে সমন্বয়: বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে বাণিজ্য বাজার স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে ।
৩. ব্যবসায়ের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ: বাণিজ্য ব্যবসায়, পরিবহণ, গুদামজাতকরণ, ব্যাংক, বীমা ও প্রচারের দ্বারা যথাক্রমে ব্যবসায়ের ব্যক্তিগত, স্থানগত, কালগত, অর্থ সংক্রান্ত, ঝুঁকিগত বাধা বা প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসায়কে চলতে সাহায্য করে ।
৪. পণ্যের মান ও গুণ উন্নতকরণ ও সংরক্ষনঃ পণ্যের মান ও গুণ উন্নতকরণ এবং সংরক্ষণের লক্ষ্যে
বাণিজ্য প্রমিতকরণ, পর্যায়িতকরণ, চিহ্নিতকরণ, মোড়কিকরণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে ।
৫. বৃহদায়তন উৎপাদনে সাহায্য: বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় পণ্যের বাজারজাতকরণ নিশ্চিত হয় বলে উৎপাদক অবিরত উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত থেকে বাজারের চাহিদানুযায়ী ব্যাপক আকারে উৎপাদন করতে পারে ।
বিনিময় (Trade): পণ্য দ্রব্য বা সেবা সামগ্রির স্বত্ব হস্তান্তরের কাজকে পণ্য বিনিময় বলে। বিনিময়ের মাধ্যমে স্বত্ব হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যক্তিগত বাধা অপসারিত হয়। পণ্য বা সেবা বিনিময়কে নিম্নোক্ত কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ।
১. অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (Home Trade): একটি দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে যে ক্রয় - বিক্রয় কার্য সম্পাদিত হয়, তাকে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বলে । অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকে প্রকৃতি অনুযায়ী আবার দুভাগে ভাগ করা হয়েছে।
i. পাইকারী ব্যবসায় (Whole sale trade): যে ব্যবসায় পাইকারি ব্যবসায়ী উৎপাদকের নিকট হতে অধিক পরিমাণে পণ্য দ্রব্য ক্রয় করে সেগুলো ছোট ছোট লটে খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করে তাকে পাইকারি ব্যবসায় বলে ।
ii. খুচরা ব্যবসায় (Retail trade): খুচরা ব্যবসায়ী পাইকারদের নিকট থেকে পণ্য দ্রব্য সংগ্রহ করে সেগুলো ভোক্তাদের নিকট বিক্রি করে । এরূপ ব্যবসায়কে খুচরা ব্যবসায় বলে ।
২. আন্তর্জাতিক/বৈদেশিক বাণিজ্য (Foreign trade): এক দেশের সাথে অন্য দেশের বাণিজ্য হলে তাকে বৈদেশিক বাণিজ্য বলে। এ ব্যবস্থায় এক দেশের ক্রেতা অন্য দেশের বিক্রেতার সাথে বাণিজ্য করে থাকে । বৈদেশিক বাণিজ্য তিনটি উপায়ে হয়ে থাকে—
i. আমদানি (Import): অন্য দেশ থেকে পণ্য কিনে নিজ দেশে নিয়ে আসার কাজকে বলে আমদানি ।
ii. রপ্তানি (Export): রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পণ্য দ্রব্য বা সেবা স্বদেশ থেকে বিদেশে প্রেরণ করা হয় ।
iii. পুনঃরপ্তানি (Re-export): এক দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য তৃতীয় দেশে বিক্রি করা হলে তাকে পুনঃরপ্তানি বাণিজ্য বলে ।
সহায়ক কার্যাবলি (Auxilaries to trade):
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে শিল্প ও বাণিজ্যে সহায়তা দানের লক্ষ্যে যেসব কার্য সম্পাদিত হয় সেগুলোও ব্যবসায়ের আওতাধীন ।
সহায়ক কার্যাবলি নিম্নরূপ—
i. ব্যাংকিং (Banking): ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ সরবরাহ করে ব্যবসায়ের অর্থ সংস্থানজনিত প্রতিবন্ধকতা দূর করে ।
ii. বিমা (Insurance): ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ঝুঁকি সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে সহায়তা করে বিমা ।
iii. পরিবহন (Transportation): পরিবহন পণ্য স্থানান্তরের ক্ষেত্রে স্থানগত প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত করে থাকে। পরিবহন তিন উপায়ে হয়ে থাকে-স্থল পথে, জল পথে, বিমান পথে ।
iv. গুদামজাতকরণ (Warehousing): এ প্রক্রিয়ায় পণ্য কিছু সময়ের জন্যে মজুত রেখে সময়গত উপযোগ সৃষ্টি করা হয়।
v. প্যাকিং (Packing): পণ্য বাজারজাতকরণের আগে পণ্যের দাম, গুণ, তারিখ ইত্যাদি সংবলিত একটি আকর্ষণীয় মোড়কে পণ্যকে সাজানো হলে একে প্যাকিং বলে।
vi. বাজারজাতকরণ প্রসার (Promotion): পণ্যের সঠিক মূল্যায়ন হওয়ার জন্য, যে উদ্দেশ্যে পণ্য তৈরি করা হয়েছে এবং মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পণ্যকে বাজারজাতকরণ করা হয়। বাজারজাতকরণের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় হলো-পণ্য গবেষণা, বাজার গবেষণা, বিক্ৰয়িকতা।
অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে যেসব কার্য সরাসরি সম্পাদিত হয় কিংবা দৈহিক বা মানসিক শ্রমের বিনিময় করা হয় তাকে প্রত্যক্ষ সেবা বলে।
প্রত্যক্ষ সেবার বৈশিষ্ট্য:
১. অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্য স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত থাকে,
২. পণ্য ছাড়া সরাসরি সেবা প্রদান,
৩. সেবাদাতা ও সেবা গ্রহীতার উপস্থিতি থাকতে হয় ।
প্রত্যক্ষ সেবার আওতা বা প্রকারভেদ
যেসব কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ সেবার মধ্যে পড়ে সেগুলো হলো-চিকিৎসা বৃত্তি, আইন বৃত্তি, হিসাব বৃত্তি, প্রকৌশলী বৃত্তি, পরামর্শ বৃত্তি, হোটেল, সেলুন, নাট্যশালা, সিনেমা হল, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের অভিনয়, ডাক্তাররা মিলে ক্লিনিক ব্যবসা বা কয়েকজন উকিল মিলে এটর্নি ফার্ম বা প্রকৌশলীরা মিলে ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম গঠন করতে পারেন; যা প্রত্যক্ষ সেবা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সঙ্গত কারণে ব্যবসায়ের আওতায় আসে । পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যবসায়ের আওতা অত্যন্ত ব্যাপক। বর্তমান বিশ্বে ব্যবসায় একটি ব্যাপক আওতাবিশিষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমষ্টি। মানুষের অফুরন্ত অভাব পূরণের জন্য বস্তুগত ও অবস্তুগত সেবা ও শ্রমের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। কাজেই মানুষের এসব চাহিদা পূরণের জন্য অর্থোপার্জনের লক্ষ্যে সম্পাদিত যাবতীয় কার্যই ব্যবসায়ের আওতাভুক্ত ।
বাংলাদেশ শিল্পে অনগ্রসর একটা দেশ। প্রাচীন কাল থেকেই কৃষি খাত এ দেশে মুখ্য হলেও বর্তমানে শিল্পোন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। জাতীয় সম্পদ ও গৃহীত বৈদেশিক ঋণের বড় পরিমাণ অর্থ শিল্পোন্নয়নের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু প্রত্যাশিত অগ্রগতি নানান কারণেই এখনও অর্জিত হয়নি।
বাংলাদেশে শিল্পের সমস্যা (Problems of Industry in Bangladesh):
বাংলাদেশে শিল্পখাতে দূর্বলতার পিছনে বিভিন্ন কারণ বিদ্যমান। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১। সৎ ও যোগ্য উদ্যোক্তার অভাব: আমাদের দেশের সকল পর্যায়েই দক্ষ ও যোগ্য উদ্যোক্তা বা সংগঠকের অভাব লক্ষনীয়। অথচ উদ্যোক্তা হলো ব্যবসায়ের নেতা। যোগ্য উদ্যোক্তা শ্রেণী গড়ে না উঠার কারণে এ দেশের শিল্প ক্ষেত্রে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে
না ।
২। ব্যবস্থাপনার অদক্ষতাঃ শিল্প নিজে চলতে পারে না। ব্যবস্থাপনার উপর তাকে নির্ভর করতে হয় । শিল্প সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য এর ব্যবস্থাপকদের যেরূপ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন আমাদের দেশে তার বড়ই অভাব পরিলক্ষিত হয় ।
৩। মূলধনের অভাব: শিল্প ছোট বড় যে ধরনেরই হোক না কেন তাতে যদি কাম্য পরিমাণের মূলধন সংস্থান করা না যায় তবে তা হতে কাঙ্খিত ফল লাভ করা যায় না ।
৪। সরকারি সুষ্ঠু নীতিমালার অভাবঃ শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের যে সুষ্ঠু নীতি-পরিকল্পনা ও তদনুযায়ী উদ্যোগ এবং সহযোগিতা থাকা প্রয়োজন তারও মারাত্মক অভাব এ দেশে লক্ষণীয়।
৫। উন্নত প্রযুক্তি ও কারিগরি দক্ষতার অভাব: আমাদের দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুরাতন যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে। ফলে বিদেশি প্রতিযোগীদের ন্যায় মানসম্মত পণ্য উৎপাদন তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ ছাড়া ব্যবসায় পরিচালনা ও উৎপাদনে যে ধরনের কলাকৌশল ও পদ্ধতি এখানে ব্যবহৃত হয় তাও উন্নত নয়। ফলে ব্যবসায় সংগঠনগুলোর দক্ষতার মান উন্নত হওয়ার সুযোগ কম ।
দেশের ক্রমবর্ধমান জনশক্তির কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই । প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যাপক ব্যবহার, অভ্যন্তরীণ বাজার, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধি, উন্নতমানের কয়লা খনির সন্ধান লাভ, রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বেসরকারি উদ্যোগ সম্প্রসারন, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বারোপ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের প্রয়াস, বিশ্বায়নের প্রভাব ইত্যাদি সবকিছুই এদেশে শিল্পখাতের অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয় । দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে শিল্পখাতের উন্নয়নের আবশ্যকতা ও করণীয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব যত দ্রুত সৃষ্টি হয় ততই তা মঙ্গলজনক। সর্বোপরি দেশীয় উদ্যোগ ও বিনিয়োগ আকর্ষণের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে সকল বাধা-বিপত্তি দূর করে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাবে।
বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। যে কারণে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকার পরও এদেশে বাণিজ্যের কাঙ্ক্ষিত সম্প্রসারণ সম্ভব হচ্ছে না। নিম্নে এরুপ সমস্যাসমূহ উল্লেখ করা হলো—
ক. অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সমস্যা: (Problems of home trade)
খ. বৈদেশিক বাণিজ্যে সমস্যা: (Problems of foreign trade )
বাংলাদেশে বাণিজ্যোর সম্ভাবনা যথেষ্ট তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ব্র্যান্ডের পণ্যের সম্প্রসারণ, খুচরা বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ, মোড়কীকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্ৰত্যক্ষ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা প্রসার ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রামীণ বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে বিধায় লেনদেন অনেক সহজ হয়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের ভোগের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। মানুষের রুচি ও চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে নতুন ডিজাইন ও মানের পণ্য বাজারে আসছে। রাজধানি থেকে শুরু করে ছোট শহর পর্যন্ত বিপনি বিতান গড়ে উঠায় বাণিজ্যিক কর্মকান্ডের বিস্তৃতি ঘটছে। রপ্তানি বাণিজ্যে বিদ্যমান সমস্যা মাথায় রেখে আমদানিকারকদের মনে আস্থা সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। রপ্তানিমুখি প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিদেশি বাণিজ্যিক মিশনগুলোকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরিন ও বৈদেশিক বাণিজ্য ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধ হবে।
প্রচলিত ব্যবসায় আমাদের শিক্ষা দেয় কীভাবে অধিক মুনাফা অর্জন করা যায়। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যবসায় আমাদেরকে স্বার্থপর করে তোলে। অপরদিকে সামাজিক ব্যবসায় আমাদেরকে শিক্ষা দেয় কীভাবে ব্যবসায়ের মাধ্যমে স্বল্প মুনাফায় সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা যায়। মুনাফা অর্জনের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, ব্যবসায় সম্প্রসারণ এবং সামাজিক সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখায় বর্তমান বিশ্বে সামাজিক ব্যবসায় ধারণাটি ব্যপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এ ধারনাটি প্রথমে উপস্থাপন ও উন্নয়ন করেন বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ডঃ মোঃ ইউনুস। তিনি ২০০৮ সালে তার প্রকাশিত বই “Creating a world without poverty social business and the future of capitalism” সর্বপ্রথম এ ধারনাটি দেন। পরবর্তিতে ২০১০ সালে তার প্রকাশিত “Building Social Business: The new kind of Capitalism that serve humanity's most pressing needs” এ এই মডেলটির বিস্তারিত আলোচনা করেন।
সামাজিক ব্যবসায় হচ্ছে একটি কারণ ধাবিত (Cause-driven) ব্যবসায়। সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগকারী ধীরে ধীরে তার বিনিয়োগকৃত মূলধন তুলে নিতে পারে। কিন্তু এর বাইরে কোনো লভ্যাংশ সে ভোগ করতে পারে না। এ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবসায় পরিচালনার মাধ্যমে সমাজের এক বা একাধিক সামাজিক উদ্দেশ্য অর্জন করা; এখানে বিনিয়োগকারীর কোনো ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য থাকে না। এ ব্যবসায়ের মুনাফা ব্যবহার করা হয় সামাজিক ব্যবসায় সম্প্রসারণ বা পণ্য উন্নয়নে। এ কারণেই বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো মুনাফা উত্তোলন করে না ।
পণ্যের খরচ তুলে মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি এ ব্যবসায় এক বা একাধিক সামাজিক উদ্দেশ্য যেমন—গরীবদের স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন ব্যবস্থা, আর্থিক সেবা প্রদান, অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের পুষ্টির ব্যবস্থা করা, নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহ, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবস্থা ইত্যাদি অর্জন করতে সহায়তা করবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন— ইত্যাদি।
সামাজিক ব্যবসায়ের প্রকারভেদ (Types of Social Business): সামাজিক ব্যবসায় দুপ্রকার। যথা—
১. টাইপ-I: সামাজিক ব্যবসায়
২. টাইপ-II: সামাজিক ব্যবসায় ।
১. টাইপ-I: এ ধরনের সামাজিক ব্যবসায় কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক, নৈতিক অথবা পরিবেশগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোনো পণ্য সরবরাহের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। যেমন-গ্রামীণ ডানোন (Grameen Danone), গ্রামীণ শক্তি (Grameen Sokti)।
২. টাইপ-II: এ ধরনের সামাজিক ব্যবসায় মুনাফানির্ভর ব্যবসায় যেটির মালিক হবেন গরিব বা সমাজের নিম্নবিত্তরা যারা সরাসরি লভ্যাংশ ভোগ করতে পারে বা পরোক্ষভাবে সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। যেমন: গ্রামীণ ব্যাংক সামাজিক ব্যবসায় অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়িক সামাজিক দায়িত্ব থেকে ভিন্ন ।
সামাজিক ব্যবসায়ের নীতিমালা (Principles of Social Business)
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং হ্যানস রেইটজ ( Hans Reitz), সামাজিক ব্যবসায়ের ৭টি নীতিমালার কথা উল্লেখ করেছেন । সেগুলো হলো—
পণ্য বা সেবা উৎপাদন এবং উৎপাদিত পণ্য বা সেবা সামগ্রী ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত যাবতীয় কার্যাবলি ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত । ভোক্তা বা ক্রেতার সন্তুষ্টি অর্জনই ব্যবসায়ের মূল উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ।
নিম্নে ব্যবসায়ের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলিসমূহ বর্ণনা করা হলো—
প্রমিতকরণ হলো মৌলিক মান নির্ধারণ এবং পর্যায়িতকরণ হলো উক্ত প্রতিষ্ঠিত মান অনুযায়ী পণ্য দ্রব্য ভাগ বা শ্রেণিবদ্ধ করা । ব্যবসায়ে পণ্য-দ্রব্য উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষেত্রে প্রমিতকরণ ও পর্যায়িতকরণে প্রয়োজন পড়ে।
পরিশেষে বলা যায়, মানুষের অভাব পূরণের উদ্দেশ্যে যাবতীয় বৈধ অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপই হলো ব্যবসায় আর ব্যবসায়ের সাথে সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডই হলো ব্যবসায়ের কার্যাবলি। সম্পাদিত কার্যাবলির মধ্যে যেসব কাজ মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে করা হয়, সেগুলো ব্যবসায়িক কার্যকলাপের আওতায় পড়ে। প্রকৃতপক্ষে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যা করে তাই ব্যবসায়ীক কার্যকলাপ ।
বর্তমান উন্নয়নশীল বিশ্বে দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবর্তনের জন্য ব্যবসায়ের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য যোগাযোগ, পরিবহন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উন্নয়নের সাথে ব্যবসায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নিম্নে ব্যবসায়ের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করা হলো—
ক. অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic Importance):
খ. সামাজিক গুরুত্ব (Social Importance):
পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক বিশ্বে মানব গোষ্ঠীর সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও সভ্যতার ক্রমোন্নতিতে ব্যবসায়ের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে প্রয়োজনীয় পণ্য বা সেবা আহরণ, উৎপাদন ও বিতরণ সংক্রান্ত কার্যক্রমে ব্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
যে কোন দেশের জন্য ব্যবসায় হচ্ছে অর্থনীতির মূখ্য চালিকা শক্তি। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। উন্নত দেশের পর্যায়ে পৌছাতে হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। কৃষিনির্ভর দেশ হলেও এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবসায়ের অবদান দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসায় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা, , ব্যক্তিগত ও জাতীয় আয় বৃদ্ধি, সঞ্চয়ে উৎসাহ প্রদান, মূলধন গঠনে সহায়তা, সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, মানবসম্পদের উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবসায়ের অবদান ব্যাপক ও অনস্বীকার্য।
কোনো বিশেষ বিদ্যায় বৃত্তিমূলক জ্ঞান আহরণ করে পারদর্শিতা ও দক্ষতা অর্জনের পর বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগ ও ব্যবহারের দ্বারা জীবিকা নির্বাহের প্রচেষ্টাকে পেশা বলে । কোনো মানুষ তার জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কোনো কাজকে অবলম্বন করলে সেটা পেশা হিসেবে গণ্য হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবসায়কে পেশা বা জীবিকা অর্জনের উপায় বলতে পারি । কারণ একজন ব্যক্তি ব্যবসায় করে তার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অভাবসমূহ পূরণ করছে। ব্যবসায় মানুষের জীবিকা অর্জনের অন্যতম প্রধান উপায়। যেকোনো ব্যক্তি তার স্বল্প বা বেশি মূলধন নিয়ে সহজেই ব্যবসায় করতে পারে । তাই অনেকে ব্যবসায়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে।
ব্যবসায়ের মাধ্যমে মানুষ তার জীবনকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কেউ যদি চাকরি করে তবে সে নির্দিষ্ট বেতন পায়। সেক্ষেত্রে তার চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষা সীমিত হয়ে থাকে। কিন্তু কেউ যদি ব্যবসায় সঠিকভাবে করতে পারে তবে সে চাকরির চেয়ে অনেক বেশি উপার্জন করতে পারবে। এখানে তার উপার্জন সীমিত থাকে না। ব্যবসায় কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি দেশে যত বেশি ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ ঘটবে তত বেশি মানুষের কর্মের সংস্থান হবে।
ব্যবসায় হলো স্বাধীন পেশা বা বৃত্তি। একজন ব্যবসায়ী বৈধভাবে যেকোনো ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারে, সেখান থেকে মুনাফা অর্জন করতে পারে, এজন্য কোনো জবাবদিহি কারও নিকট করতে হয় না । তাই স্বাধীন পেশা হিসেবে ব্যবসায়কে সবাই পছন্দ করে।
বলা হয় মানুষ পরিবেশের দাস। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি পরিবেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষকে চালিত করে । আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়ে আমাদের পরিবেশ। অপরদিকে ব্যবসায় পরিবেশ সামগ্রিক পরিবেশের একটি অংশ, যা শুধু ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে ব্যবসায়ের সাফল্য অর্জন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে ব্যবসায়ের পরিবেশের উপর। যেসব পারিপার্শ্বিক উপাদান ব্যবসায়কে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে তার সমষ্টিকে ব্যবসায়ের পরিবেশ বলে। পরিবেশের উপাদানগুলো ব্যবসায়ের কার্যাবলিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা জানতে পারব—
সূত্র: ক্যামব্রিয়ান পাবলিকেশন্স
বাংলাদেশের কোনো গ্রামে স্বল্পবিত্তসম্পন্ন একজন কৃষকের ঘরে একটা শিশু জন্ম নিল। এরপর তার পরিচর্যা, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া, জীবন-জীবিকা ও চিন্তা-ভাবনা যে ধরনের হবে ইংল্যান্ডের কোনো গ্রামে জন্ম নেয়া শিশু এবং তার পরিচর্যা, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়াসহ সবকিছু হবে ভিন্নতর। এর পিছনে উভয়ের পারিপার্শ্বিকতা অর্থাৎ প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি পরিবেশের উপাদানসমূহ ভিন্ন বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। এটাকে অস্বীকার করার কোনোই সুযোগ নেই ।
তাই বলা যায়, প্রতিটি মানুষ তার চিন্তা-বিশ্বাস, আচার-আচরণ, জীবন-জীবিকাসহ যে ভিন্ন ভাবধারাতে গড়ে ওঠে এর পিছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব তার পরিবেশ। সেজন্যই বলা হয়, মানুষ আজন্ম পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেসব পারিপার্শ্বিক উপাদান ব্যবসায়কে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে তার সমষ্টিকে ব্যবসায়ের পরিবেশ । যেসব অবস্থা ব্যবসায়ের উন্নতির উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তাকে ব্যবসায় পরিবেশ বলে। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ বলতে সাধারণত বাইরের সেসব উপাদানগুলোকে বুঝানো হয় যেগুলো প্রতিষ্ঠানের জন্য সুযোগ বয়ে আনতে পারে কিংবা ক্ষতির সৃষ্টি করতে পারে।
বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে ব্যবসায়ের সাফল্য অর্জন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে ব্যবসায় পরিবেশের উপর । পরিবেশের উপাদানগুলো মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলি এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। নিম্নে ব্যবসায় পরিবেশের উপাদানগুলো তুলে ধরা হলো:
১। প্রাকৃতিক উপাদান (Natural element) : প্রকৃতিগত কারণে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয় তাকে প্রাকৃতিক পরিবেশ বলে। কোনো দেশের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, প্রাকৃতিক সম্পদ, অবস্থান, আয়তন, জনসংখ্যা, নদ- নদী, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদান ।
এ উপাদানসমূহের উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতির দ্বারা ব্যবসায় কার্যকলাপ প্রভাবিত হয়। সে কারণেই এসব উপাদানের অনুকূল ক্ষেত্রে ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প-করখানা অধিক পরিমাণে গড়ে ওঠে।
২। অর্থনৈতিক উপাদান (Economic element): “অর্থনৈতিক পরিবেশ কতকগুলো উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত যা ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা ও ব্যয়ের ধরনকে প্রভাবিত করে।” এসব উপাদানের মধ্যে রয়েছে অর্থ ও ঋণ ব্যবস্থা, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ, মূলধন ইত্যাদি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর একটি দেশের শিল্প ও বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। একটি দেশের জাতীয় আয়, ভোগের পরিমাণ, উৎপাদন ও বণ্টন, গড় মাথাপিছু আয় ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে কোনো দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশ। কাজেই উপরিউক্ত উপাদানসমূহ অনকূল হলে ব্যবসায় বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন সহজতর হয়।
৩। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান (Social and cultural element):
মানুষ সমাজবদ্ধ জীবন যাপনে অভ্যস্ত। এ সমাজবদ্ধ মানুষের ধ্যান-ধারণা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, মনোভাব ও বিশ্বাস, রীতি-নীতি, মূল্যবোধ, ধর্মীয় চেতনা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সামাজিক পরিবেশ। ব্যবসায়-বাণিজ্যের উপর এ সামাজিক উপাদানগুলোর প্রভাব অসীম। সামাজিক পরিবেশ সহজ, সুন্দর ও অনুকূল হলে ব্যবসায় বাণিজ্য তার কাম্য লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয় ।
৪। রাজনৈতিক ও আইনগত উপাদান (Political and legal element): একটি দেশের রাজনৈতিক ও আইনগত উপাদানসমূহ ব্যবসায়ের উন্নয়ন ও বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কোনো দেশের সরকারি নিয়ম-কানুন, আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনুকূল হলে ব্যবসায়ও দ্রুতগতিতে বিকশিত হতে পারে। ঠিক তেমনি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, বাণিজ্য নীতি, রাজস্ব নীতি, বিনিয়োগ নীতি ইত্যাদির আনুকূল্য এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
৫। তথ্য ও প্রযুক্তিগত উপাদান (Information and technological element): বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভর। প্রযুক্তি যেমন মানুষের জীবনে এনেছে আধুনিকতার ছোঁয়া, বর্তমান কম্পিউটারভিত্তিক তথ্য ব্যবস্থাও তেমনি মানুষের জীবনধারাকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানের দ্বারা গবেষণা ও উদ্ভাবনের ফলে বিশ্ব পাচ্ছে নতুন নতুন আবিষ্কার, ক্রেতা ও ভোক্তারা পাচ্ছে নতুন নতুন পণ্য ও সেবাসামগ্রী। আবার তথ্য ব্যবস্থার অবাধ প্রবাহ ব্যবসায়-বাণিজ্য গতি সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ ব্যতীত আজকের বিশ্বায়নের (Globalisation) যুগে ব্যবসায়-বাণিজ্যে অগ্রগতি ও উন্নয়নের প্রত্যাশা দুরাশামাত্র ।
৬। আন্তর্জাতিক উপাদান (International element): বর্তমান ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্র আজ আর কেবল সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ নেই। ব্যবসায় আজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী তার সকল ডালপালা প্রসারিত করতে সমর্থ হয়েছে। সুতরাং ব্যবসায়ের আন্তর্জাতিক দিককে অবহেলা করার সুযোগ নেই । একটি দেশের সাথে অপর দেশের সম্পর্ক, বিশেষ করে উন্নত দেশের সাথে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশের সম্পর্ক ব্যবসায়কে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এছাড়া আন্তর্জাতিক চুক্তি, বিশ্ব বাণিজ্য নীতি ও বিশ্ববাজার ব্যবস্থা, প্রতিবেশি দেশসমূহের সাথে সম্পর্ক ইত্যাদি যেকোনো দেশের ব্যবসায়- বাণিজ্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যবসায় পরিবেশের উপরোক্ত প্রতিটি উপাদানই ব্যবসায়কে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করছে।
ব্যবসায় একটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। মানুষের জীবন প্রণালি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান বা শক্তিসমূহ যেভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তেমনিভাবে ব্যবসায় এবং তৎসংক্রান্ত কার্যাবলিও পরিবেশগত বিভিন্ন চলক / উপাদান / শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়। পরিবেশের উপাদানসমূহের মধ্যে যেমন রয়েছে ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, মৃত্তিকা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক উপাদান, তেমনি রয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তি, সরকারি বিধি-বিধান ইত্যাদির মতো অ- প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ। কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের এ সময় পরিবেশগত উপাদান একক এবং সম্মিলিতভাবে অহরহ ঐ স্থানের ব্যবসায়িক কর্মধারা, সিদ্ধান্ত, ফলপ্রদতা ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে ।
১। প্রতিষ্ঠানের জন্য মূলধন প্রাপ্তি (Availability of capital for the venture): ব্যবসায় একটি সৃজনশীল ও উদ্ভাবনমূলক কাজ। ব্যবসায়ীর এরূপ উদ্ভাবনী শক্তিকে বাস্তবে রূপদানের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত মূলধনের। সংগঠন স্থাপন, কলকব্জা ও যন্ত্রপাতি ক্রয়, কাঁচামাল সংগ্রহ ইত্যাদি বাবদ প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। উদার ঋণদান নীতি, সুষ্ঠু ও কার্যকর শেয়ার বাজারের উপস্থিতি এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির উপর মূলধন সরবরাহ পরিস্থিতি নির্ভরশীল। দেশে অনুকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ বিদ্যমান থাকলে ব্যবসায়ের মূলধন প্রাপ্তি সহজ হয়। অন্যদিকে প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ মূলধন প্রাপ্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। ফলে ব্যবসায় বাধাপ্রাপ্ত হয়।
২। অনুকূল কর কাঠামো (Favourable tax structure): দেশের বিরাজমান অনুকূল কর ও শুল্ক নীতি ব্যবসায়ের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। দেশে বিদ্যমান কর কাঠামোতে যেসব খাতে বা অঞ্চলে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায় স্থাপনে কর রেয়াত দেয়া হয়, সেসব খাতে বা অঞ্চলে দ্রুত শিল্প কারখানা গড়ে উঠে । প্রতিকূল কর ও শুল্ক কাঠামো নতুন শিল্প স্থাপনকে নিরুৎসাহিত করার সাথে সাথে চালু শিল্প কারখানা ও ব্যবসায় কর্মকাণ্ডের ইতি ঘটায়।
৩। লাইসেন্স প্রাপ্তির সুবিধা (Facility to getting licence): দেশে শিল্প স্থাপন ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন। শিল্প স্থাপনের এরূপ অনুমোদন বা লাইসেন্স প্রাপ্তির সুবিধা বা অসুবিধা ব্যবসায়ী কার্যক্রমে যথাক্রমে ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। তাই দেখা যায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি অনুমোদন ও লাইসেন্স প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতার নীতি ব্যবসায়ী উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করে। আবার এক্ষেত্রে ত্বরিত ব্যবস্থার নীতি শিল্প কারখানা স্থাপনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
৪। ভূমি প্রাপ্তির সুবিধা (Advantages of getting land): শিল্প বা ব্যবসায় স্থাপনে যথাযথ সুবিধা সংবলিত ভূমি প্রয়োজন। সুষ্ঠু যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, বাজারের নৈকট্য, কাঁচামাল, শ্রমশক্তি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদির সহজলভ্যতা সংবলিত ভূমি যথাযথ শিল্প স্থাপনের সহায়ক। অন্যদিকে শিল্প স্থাপনের উপযোগী ভূমির অপর্যাপ্ততা ব্যবসায় কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করে ।
৫। সুষ্ঠু যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা (Smooth communication and transportation system): সুষ্ঠু ও পর্যাপ্ত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উপাদান-যা ব্যবসায় বা শিল্পের প্রতিষ্ঠা ও এর অগ্রগতিতে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা একদিকে যেমন কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য অপরিহার্য, অন্যদিকে উৎপন্ন পণ্য বাজারজাতকরণের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ । আবার উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্যও একান্ত অপরিহার্য ।
৬। বাজারে প্রবেশের সুযোগ (Facility to access in the market): উৎপাদিত পণ্য অবাধে বিক্রয়ের সুযোগ তথা পণ্যের বাজার লাভের সুযোগ আরেকটি অর্থনৈতিক উপাদান-যা শিল্পীয় উৎপাদনকে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহিত করে। মূলত পণ্য উৎপাদিত হয় বাজারে বিক্রয়ের নিমিত্তে। এমতাবস্থায়, কোনো পণ্যের বাজার যদি একচেটিয়া বা নিয়ন্ত্রিত বা সংরক্ষণমূলক হয় তবে ঐ শিল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। অনেক সময় দেখা যায় পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, কপিরাইট অথবা অন্য কোনো সরকারি নির্দেশ পণ্যের বাজারকে সংরক্ষিত ও সংকুচিত করে রাখে । এরূপ অবস্থায় ব্যবসায় কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে।
৭। অনুকূল ঋণ ও আর্থিক সুবিধা (Favourable credit and financial facilities): ব্যবসায়ীগণ শিল্প স্থাপন এবং চলমান শিল্পে প্রয়োজনীয় চলতি মূলধন যোগান দেয়ার নিমিত্তে অথবা সম্প্রসারণের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মূলধন বা ঋণের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। এমতাবস্থায়, কোনো অঞ্চলে এরূপ মূলধন বা ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ না থাকলে ব্যবসায়ীগণ নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। ফলে ব্যবসায় কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। আবার প্রয়োজনীয় ঋণ বা মূলধনের যোগান দেয়ার জন্য যে অঞ্চলে পর্যাপ্ত ব্যাংক, সুষ্ঠু শেয়ার বাজার বা বিদেশি সাহায্য বিদ্যমান সেখানে সহজেই শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে।
৮। সহায়ক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি (Presence of supporting and service organisations): কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বা শিল্প প্রতিষ্ঠানই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এককে খাত বা শিল্পে উন্নয়ন অন্যান্য অনেক শিল্প বা ব্যবসায়ের সমর্থন বা সহায়তার উপর নির্ভরশীল। তাই ব্যাংক, বিমা, পরিবহন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস, পাইকারি ও খুচরা দোকান, মেরামতি সপ, টেলিযোগাযোগ, ডাক ইত্যাদির মতো সেবাদানকারি এবং সহায়ক প্রতিষ্ঠান ব্যবসায় প্রচেষ্টাকে বেগবান করে তুলতে পারে ।
৯। সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা (Socio-cultural conditions): কোনো সমাজে নতুন শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ বা উদ্যম গড়ে উঠা না উঠার পেছনে ঐ অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ বা মূল্যবোধের প্রভাব অনেকখানি। আধুনিক প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, পছন্দ-অপছন্দ, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদি নতুন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার সহায়ক হলেও সনাতনী সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ব্যবসায় উদ্যোগ সৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটায়। সনাতনী সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসীগণ সামন্তবাদী চিন্তা- চেতনায় বিশ্বাসী। তাঁরা ব্যবসায়ে অর্থ-বিনিয়োগের চেয়ে ভূমির মালিকানায় অর্থ বিনিয়োগকে অধিক সামাজিক মর্যাদার প্রতীক মনে করেন। ফলে বিনিয়োগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয় বিধায় ব্যবসায় কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়।
১০। অনুকূল সরকারি নীতিমালা (Favourable government policies): রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ে প্রণীত ও জারিকৃত বিভিন্ন আইন-কানুন, বিধি-বিধান, সরকারি-আদেশ-অধ্যাদেশ ইত্যাদির বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে একজন ব্যবসায়ী বা শিল্প উদ্যোক্তাকে ব্যবসায় স্থাপন ও পরিচালনা করতে হয়। ব্যবসায়ের জন্মলগ্ন থেকে বিলুপ্তিকাল পর্যন্ত বিভিন্ন আইনকানুন ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। সরকারি এরূপ আইনকানুনের মধ্যে কর, শুল্ক, ভ্যাট, ব্যবসায় সংগঠন, ব্যাংক, বিমা, বৈদেশিক বিনিময়, পরিবেশ, শ্রমিক, পরিবহন, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি বিষয়ক বিধি-বিধান অন্যতম। ব্যবসায়ের প্রতি সরকারের মনোভাব প্রণীত ও জারিকৃত এসব আইন, বিধি-বিধান ইত্যাদিতে প্রতিফলিত হয় ।
১১। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (Economic system): অর্থনৈতিক পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও একটি দেশের ব্যবসায় প্রয়াসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ‘মুক্ত’ বা পুঁজিতান্ত্রিক' অর্থ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে রাষ্ট্রের তেমন হস্তক্ষেপ না থাকায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে উদ্যোগ প্রাধান্য লাভ করে। অন্যদিকে, ‘নিয়ন্ত্রিত’ বা ‘সমাজতান্ত্রিক' অর্থ ব্যবস্থায় উৎপাদনের সমগ্র প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে বিধায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণ বা শিল্প স্থাপন বাধাগ্রস্ত হয়।
১২। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা (Political stablility): দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শিল্প বা ব্যবসায় পরিবেশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ঘন ঘন সরকার ও নীতির পরিবর্তন ইত্যাদি শিল্প ও বাণিজ্যিক পরিবেশকে বিঘ্নিত করে। কারণ এরুপ পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও এদের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ব্যবসায়ের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি সুষ্ঠু নীতিমালা বহাল থাকলে শিল্প-বাণিজ্যের উন্নয়ন ঘটে ।
১৩। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (Science and technology): মানুষের জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন সাধনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারি উপাদান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। বর্তমান যুগের পেনিসিলিন, ওপেনহার্ট সার্জারি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ইত্যাদি বিস্ময়কর আবিষ্কার ও ব্যবহার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নেরই ফসল। প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন একদিকে যেমন উৎপাদনকে সহজতর করে, উৎপাদনের গুণগত মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি করে, তেমনি তা ব্যবসায়ীদের জন্য বিপর্যয়ও সৃষ্টি করতে পারে। কারণ নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব পুরাতন প্রযুক্তির প্রতিস্থাপনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে ।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ব্যবসায় কর্মকাণ্ড পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান এবং তা থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বা দেশে পরিবেশগত শক্তির এরূপ প্রভাব ভিন্নতর হয়ে থাকে। এজন্য রাষ্ট থেকে রাষ্ট্রে, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে ব্যবসায়ের প্রকৃতি, গতিধারা, উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদিতে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
১। অবকাঠামো সঙ্কট: বাংলাদেশের ব্যবসায় পরিবেশ উন্নয়নে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে অবকাঠামোগত সঙ্কট বা সমস্যা, অবকাঠামো বলতে, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, গ্যাস, কাঁচামালের প্রাপ্যতা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসায়ের লাইসেন্স প্রাপ্যতা ইত্যাদিকে বুঝায়। এই বিষয়গুলো আমাদের
দেশে সহজে পাওয়া যায় না।
২। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের দুর্বলতা: ব্যবসায় পরিবেশ উন্নয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাহায্য প্রয়োজন যেমন- আর্থিক প্রতিষ্ঠান (ব্যাংক, বিমা, শেয়ার বাজার) এই সকল খাতে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে ।
৩। সমষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা: ব্যবসায় ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগে বৈদেশিক বিনিয়োগ পাওয়া যায় না, যার ফলে সমষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
৪। পণ্যবাজার ও শ্রমবাজারের অদক্ষতা: পণ্য সরবরাহে দেরি হওয়া বা ব্যয় বৃদ্ধি আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাত জটিলতা, অর্থায়নের সহজপ্রাপ্যতার অভাব, ও রুলস অব অরিজিন ইত্যাদির জন্য পণ্য বাজার ও শ্রমবাজারে অদক্ষতা দেখা দিচ্ছে।
৫। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ শত সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করছে। বললে অযৌক্তিক হবে না। রাজনৈতিক অস্থিরাতা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি সবই হচ্ছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় । যা জনগণকে বারে বারে হতাশ করছে।
৬। উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রযুক্তি ও দক্ষতার ঘাটতি: উপাদনে ব্যবহৃত প্রযুক্তি ও দক্ষতার ঘাটতির কারণে ক্রেতার চাহিদা অনুপাতে গুণগত মানের পণ্য সরবরাহে ব্যর্থতা দেখা দেয় ।
পৃথিবীর প্রাচীনতম ও সহজ প্রকৃতির ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে একমালিকানা ব্যবসায় পরিচিত । একক মালিক কম পুঁজি নিয়ে যেকোনো জায়গায় স্বাধীনভাবে নিজ সিদ্ধান্তে আইনানুগ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই এ ধরনের সংগঠন গড়ে তুলতে পারে। এতে ঝুঁকির পরিমাণও অত্যন্ত কম। তাই ব্যবসা সংগঠনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা দেখি, ব্যবসায় শুরুর প্রাথমিক পর্যায় থেকেই একমালিকানা ব্যবসায় যাত্রা শুরু করে আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বেও জনপ্রিয়তার সাথে সফলভাবে টিকে আছে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নতিতে একমালিকানা সংগঠন ব্যাপকভাবে অবদান রাখতে পারছে।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা জানতে পারব—
সূত্র: ক্যামব্রিয়ান পাবলিকেশন্স
স্বল্পশিক্ষিত রাতুল যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ একাডেমি থেকে কম্পিউটারের ট্রেনিং নেয়। বাজারে একটি ছোট ফোন ও ফটোস্ট্যাট এর দোকান ছিল তার। এর সাথে কম্পিউটার কম্পোজের কাজটি যুক্ত করে রাতুল। কাজে সহায়তা করার জন্য ছোট ভাই শাকিল ও তার বন্ধু মিনহাজকে সাথে নেয়।
সময়ের সিঁড়ি বেয়ে মানুষের বিভিন্নমুখী চাহিদা পূরণের জন্য যুগে যুগে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ব্যবসায় সংগঠন। ব্যবসায়ের মালিকানা, প্রকৃতি, আয়তন, কার্যক্ষেত্র ইত্যাদি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে। নিম্নে মালিকানার দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবসায় সংগঠনের প্রকারভেদ দেখানো হলো—
একমালিকানা ব্যবসায়ের ধারণা (Concept of Sole Proprietorship Business)
সাধারণভাবে একজন ব্যক্তির মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়কে একমালিকানা ব্যবসায় বলে। একক মালিকানায় পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ব্যবসায় কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এজন্য এটিকে সবচেয়ে প্রাচীনতম ব্যবসায় সংগঠন বলা হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলা যায়, মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে যখন কোনো ব্যক্তি নিজ দায়িত্বে মূলধন যোগাড় করে কোনো ব্যবসা গঠন ও পরিচালনা করে এবং উক্ত ব্যবসায়ে অর্জিত সকল লাভ নিজে ভোগ করে বা ক্ষতি হলে নিজেই তা বহন করে, তখন তাকে একমালিকানা ব্যবসায় বলে। একমালিকানা ব্যবসায় গঠন অত্যন্ত সহজ। যে কোনো ব্যক্তি নিজের উদ্যোগে স্বল্প অর্থ নিয়ে এ জাতীয় কারবার শুরু করতে পারেন এবং অধিক অর্থও বিনিয়োগ করতে পারেন। আইনের চোখে একমালিকানা ব্যবসায়ের গঠন ও পরিচালনায় তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। গ্রামে-গঞ্জে, হাট- বাজার বা রাস্তার পাশে কিংবা নিজ বাড়িতে যে কেউ ছোট-খাটো ব্যবসা শুরু করতে পারে। তবে শহরে বা পৌরসভা এলাকায় উদ্যোক্তাকে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করে ব্যবসা আরম্ভ করতে হয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যবসায় সংগঠন একমালিকানার ভিত্তিতে গঠিত। শুধু তাই নয় ইউরোপ ও আমেরিকার প্রায় ৮০% ব্যবসায় এক মালিকানাভিত্তিক। আমাদের দেশের সাধারণ মুদি দোকান, চায়ের দোকান, অধিকাংশ খুচরা দোকান একক মালিকানার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ।
অংশীদারি ব্যবসায়ের ধারণা (Concept of Partnership Business)
দুই বা ততোধিক ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ হয়ে নিজেদের মধ্যে মুনাফা বণ্টনের নিমিত্তে যে ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তোলে তাকে অংশীদারি ব্যবসায় বলে। ব্যবসায় জগতে একমালিকানা সবচেয়ে প্রাচীন ও জনপ্রিয় হলেও একক মালিকের মূলধনের স্বল্পতা, অসীম দায়, ব্যবসায়ের ক্ষুদ্র আওতা ইত্যাদি সীমাবদ্ধতার জন্য ব্যবসায়ের পরিধি আরো বৃদ্ধি ও ঝুঁকি কমিয়ে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসায় করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তবে অংশীদারি ব্যবসায়ে কিছু কিছু সমস্যাও দেখা দেয়। বিশেষ করে মুনাফা বণ্টন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, দায়িত্ব ও কর্ম বিভাজন, সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে। ফলে অংশীদারি চুক্তিপত্র ও অংশীদারি আইন প্রণয়ন করতে হয়। বাংলাদেশের অংশীদারি ব্যবসায় ‘১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন' দ্বারা পরিচালিত হয়। ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন অনুযায়ী সদস্য সংখ্যা সর্বনিম্ন ২ জন এবং সর্বোচ্চ ২০ জন হবে। তবে অংশীদারি ব্যবসায়টি যদি ব্যাংকিং ব্যবসায় হয় তখন সর্বোচ্চ সদস্য সংখ্যা ১০ এর বেশি হবে না ।
কোম্পানি সংগঠনের ধারণা (Concept of Company Organisation)
একমালিকানা ব্যবসায়ের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে ব্যবসায়ের যে অনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল কালক্রমে তা আর একমালিকানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। একমালিকানা ব্যবসায়ের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা বিশেষ করে মূলধনের স্বল্পতা ও একক পরিচালনা ও ক্ষুদ্র আয়তনের জন্য অংশীদারি ব্যবসায়ের উৎপত্তি হয়। কিন্তু অংশীদারি ব্যবসায়ও মূলধনের সীমাবদ্ধতা, আইনগত সীমাবদ্ধতা, স্থায়িত্বহীনতা ও অসীম দায়ের ভার থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এক সময় মানুষের চাহিদা, প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবসায়ের আওতা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলশ্রুতিতে আইনের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় অধিক মূলধন ও বৃহদায়তনের যৌথ মূলধনী ব্যবসায় যা কোম্পানি সংগঠন নামেও পরিচিত। কতিপয় ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মিলিত হয়ে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সম্মিলিতভাবে পুঁজি সরবরাহ করে সীমাবদ্ধ দায়ের ভিত্তিতে যে ব্যবসায় গঠন করে তাকে কোম্পানি সংগঠন বা যৌথ মূলধনী কোম্পানি বলে ।
যৌথ মূলধনী ব্যবসায় আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট ও পরিচালিত হয়। সর্বপ্রথম কোম্পানি আইন পাস হয় ব্রিটেনে ১৮৪৪ সালে যা `The joint stock Company Act 1844' নামে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম কোম্পানি আইন পাস হয় ১৮৫০ সালে। ১৯১৩ সালে ভারতীয় কোম্পানি আইন আবার নতুন করে পাস হয়। স্বাধীন বাংলাদেশেও অনেক বছর যাবৎ ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইন চালু ছিল । কোম্পানি আইনের ব্যাপক সংষ্কার করে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে নতুন কোম্পানি আইন প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সকল কোম্পানি ব্যবসায় ১৯৯৪ সালের আইন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। কতিপয় ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যৌথভাবে মূলধন বিনিয়োগ করে দেশের প্রচলিত কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোন ব্যবসায় গঠন করলে তাকে কোম্পানি সংগঠন বলে। এ ব্যবসা নিজ নাম ও সীলমোহর দ্বারা পরিচালিত এবং সদস্যদের থেকে ভিন্ন অস্তিত্বের অধিকারী হয়ে থাকে ।
সমবায় সমিতির ধারণা (Concept of Co-operative Society)
সমবায়ের শাব্দিক অর্থ হলো সম্মিলিত উদ্যোগ বা প্রচেষ্টায় কাজ করা। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা ও চিন্তা থেকেই সমবায়ের উৎপত্তি। শিল্পবিপ্লব ও প্রযুক্তিনির্ভর বৃহদায়তন ব্যবসায় সংগঠনের বিকাশের ফলে পূঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ভিত যত মজবুত হতে থাকে, এর প্রভাবে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্যও দেখা দিতে থাকে। স্বল্পবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পেশাজীবী ও ব্যবসায়িরা আর্থিকভাবে দূরবস্থার সম্মুখীন হতে থাকে। পুঁজিবাদি সমাজের সৃষ্ট এ জাতীয় অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দূরবস্থা থেকে মুক্তির প্রয়াসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমবায় সংগঠন গড়ে উঠে। সর্বপ্রথম সমবায় আন্দোলনের সূচনা হয় পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও জাপানে। তবে সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রপথিক সংগঠন হচ্ছে ১৮৪৪ সালে উত্তর ইংল্যান্ডের রচডেল নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত রচডেল সমবায় সমিতি (Rochdale Equitable Pioneers Society)। ২৮ জন তাঁত শ্রমিকের ২৮ স্টার্লিং পাউন্ড পুঁজি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এ সমবায় সমিতিকে বিশ্বের সর্বপ্রথম সমবায় ব্যবসায় হিসেবে গণ্য করা হয়। সমাজের শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত ও স্বল্পবিত্তের কতিপয় ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মিলিত হয়ে সমধিকারের ভিত্তিতে নিজেদের আর্থিক উন্নতির জন্য যে ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তোলে তাকে সমবায় সমিতি বলে । মুনাফা অর্জন নয়, সদস্যদের কল্যাণসাধনই সমবায় সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য ।
রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের ধারণা (Concept of the State Enterprise)
সাধারণ অর্থে সরকার কর্তৃক গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়কে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বলে । এরূপ ব্যবসায় রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আবার ব্যক্তিমালিকানাধীন যেকোনো ব্যবসায়কে রাষ্ট্রের প্রয়োজনের জাতীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ে নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক সম্পদসহ সকল সম্পদের সুসম বণ্টন ও ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এবং বিশেষ কিছু জনকল্যাণমূলক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাছাড়া দেশরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র নির্মাণ শিল্পের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার উদ্দেশ্যেও প্রতিষ্ঠা ও পরিচালিত হয়ে থাকে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় বেশ কিছু ব্যবসায় পরিচালিত হয়ে থাকে ।
ব্যবসায় জোটের ধারণা (Concept of Business Combination)
ব্যবসায় জোট মূলত কোম্পানি সংগঠনেরই ব্যাপকতর ও বর্ধিত রূপ। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ধনি দেশসমূহের কোম্পানি মালিকগণ নিজেদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা হ্রাস, একচেটিয়া ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা এবং সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের জন্য সম্মিলিত হয়ে জোট গঠন করেন। ট্রাস্ট, কার্টেল, হোল্ডিং কোম্পানি, পুল প্রভৃতি এ ধরনের জোটের বিভিন্ন রূপ। জোট গঠনের ফলে সমাজে ধনি-দরিদ্রের পার্থক্য ব্যাপকতর হয় এবং শ্রেণি সংগ্রামের ধারণা দৃঢ়মূল হতে থাকে ।
যৌথ উদ্যোগে ব্যবসায়ের ধারণা (Concept of Joint Venture Business)
দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে কোনো ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করা হলে তাকে যৌথ উদ্যোগে ব্যবসায় বলে। উন্নয়নশীল ও ধনি দেশগুলোর উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে এরূপ ব্যবসায় বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এরূপ ব্যবসায়ের বিশেষ সুবিধা হলো, এতে দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি পুঁজি ও প্রযুক্তির সহজ আগমন ঘটে, অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব হয় এবং বিদেশি উদ্যোক্তাদের সাহচর্যে দেশীয় উদ্যোক্তাগণ দক্ষতা অর্জন করতে পারে। ফলে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হয় ।
এক মালিকানা ব্যবসায়ের স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা অন্যান্য ব্যবসায় থেকে একে পৃথক করে রাখে। এক মালিকানা ব্যবসায় হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীনতম ব্যবসায়। একমালিকানা ব্যবসায়ে আইনগত তেমন ঝামেলা নেই এবং যে কেউ ইচ্ছে করলে স্বল্প পুঁজি নিয়ে এ ব্যবসা শুরু করতে পারে।
নিম্নে একমালিকানা ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ চিহ্নিত করা হলো—
বর্তমানে গতিশীল বিশ্বের জটিল অর্থনৈতিক সমাজে একমালিকানা ব্যবসায়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আগের দিনে আত্মনির্ভরশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষ যখন শুধু প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদন করে তাদের প্রয়োজন মিটাতো তখন একমালিকানা ব্যবসায়ের ততটা গুরুত্ব ছিল না। কিন্ত কালের বিবর্তনে সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি, বৃহদায়তন উৎপাদন, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ইত্যাদি করণে একমালিকানা ব্যবসায়ের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিন্মে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একমালিকানা ব্যবসায়ের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:
১। সহজ গঠন (Easy Formation): একমালিকানা ব্যবসায়ের গঠন প্রণালি অত্যন্ত সহজ । বৃহদায়তন ব্যবসায়ের গঠন ও পরিচালনা পদ্ধতি খুবই জটিল এবং আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। এ কারণে এ ধরনের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সবাই পছন্দ করে।
২। কম ঝুঁকি (Small risk): একমালিকানা ব্যবসায় দায় অসীম হলেও ঝুঁকির পরিমাণ কম । সতর্কতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলে ঝুঁকিকে সাফল্যের হাতিয়ারে রূপান্তরিত করা যায় ।
৩। মূলধনের স্বল্পতা (Limited capital): বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকই দরিদ্র। তাদের সঞ্চয় ও মূলধনের পরিমাণ খুবই কম। তাই একমালিকানা ব্যবসায় তাদের পছন্দের তালিকায় অগ্রাধিকার পায় ।
৪। সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি (Increase of saving and investments): শহর ও গ্রামগঞ্জে ব্যাপক জনগোষ্ঠী এরূপ ব্যবসায় গড়ে তোলার মানসে তাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে একত্রিত করে এ ধরনের ব্যবসায় গঠন করে থাকে। যা দেশের জন্য মূলধন গঠন এবং বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ।
৫। জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন (Raising standard of living): জাতীয় আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়ে থাকে। অন্যদিকে চাহিদা অনুযায়ী পণ্যদ্রব্য সরবরাহ করে এ ব্যবসায় মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে ।
৬। অনুন্নত অর্থনৈতিক অবস্থা (Undeveloped economy): বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা মোটেই উন্নত নয়। অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য প্রধানত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করা হয়। বৃহদায়তন উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি ও প্রযুক্তির ঘাটতি থাকায় ক্ষুদ্ৰায়তনের একমালিকানা ব্যবসায়ই এদেশে জনপ্রিয় ।
৭। ব্যাপক সেবা প্রদান (Rendering of greater service): স্বল্প মূলধন নিয়ে অতি সহজে এ ব্যবসায় শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জের সর্বত্র গড়ে ওঠে। তাই প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবাসামগ্রী সহজে ভোক্তা সাধারণের হাতে তুলে দিয়ে এ ব্যবসায় ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদান করতে পারে।
৮। কর্মসংস্থান (Employment): এককভাবে প্রতিটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে কম সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হলেও সমষ্টিগতভাবে অধিক সংখ্যক লোকের বেকার সমস্যা দূরীকরণে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ।
৯। সম্পদের সুসম বণ্টন (Proper distribution of wealth): একমালিকানা ব্যবসায় দেশের যেকোনো স্থানে গড়ে উঠতে পারে বলে সম্পদের সুসম বণ্টনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ।
১০। জাতীয় আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি (Increase of national income and wealth): সম্পদের সুসম বণ্টনের ফলে ব্যক্তিগত আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি জাতীয় আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। পরিশেষে বলা যায় যে, একমালিকানা ব্যবসায়ে মানুষের রুচি, পছন্দ, ইচ্ছা ইত্যাদিকে প্রাধান্য দেয়া হয় বলে বৃহদায়তন ব্যবসায়ের পাশাপাশি এটি আজও টিকে আছে । তাই একমালিকানা ব্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম ।
একমালিকানা ব্যবসায়ের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ও সুবিধা আছে যে কারণে এ জাতীয় ব্যবসায় সকলের নিকট জনপ্রিয়। যেসব ক্ষেত্রে একমালিকানা ব্যবসায় অধিক উপযোগী নিয়ে সেই ক্ষেত্রগুলো আলোচনা করা হলো—
কিছু কিছু কারবার আছে যেগুলোর গঠন ও পরিচালনার জন্য খুব সামান্য পুঁজি হলেই চলে। এরূপ কারবার একমালিকানা ব্যবসায়ের জন্য উপযুক্ত। যেমন: মুদিখানা, পান-বিড়ির দোকান, চায়ের দোকান, সেলুন, ফেরিওয়ালা ইত্যাদি।
পেশাদারি ব্যবসায়সমূহ প্রায়ই একমালিকানার ভিত্তিতে গঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে । যেমন—ডাক্তারি, আইন ব্যবসায়, প্রতিনিধি ব্যবসায়, চার্টার্ড একাউন্টিং ফার্ম ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায়, স্বল্পপুঁজি, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সহজ স্থানান্তর ইত্যাদি কারণে একমালিকানা ব্যবসা অনেক ক্ষেত্রে বৃহদায়তন ব্যবসায়ের তুলনায় অধিক উপযোগী। এ কারণে একমালিকানা ব্যবসায় উপরিউক্ত ক্ষেত্রসমূহে যথেষ্ট দক্ষতার সাথে টিকে আছে ।
বৃহদায়তন উৎপাদন ও লাভ অর্জন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অধিক সুবিধা ভোগ করলেও ক্ষুদ্রায়তন একমালিকানা ব্যবসায় বিশেষ কতকগুলো ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করেছে। এ কারণে বৃহদায়তন ব্যবসায়ের পাশাপাশি একমালিকানা ব্যবসায় আজও দক্ষতার সাথে টিকে আছে। নিন্মে এ কারণগুলো ব্যাখ্যা করা হলো—
১। গঠন সুবিধা (Easy of formation): একমালিকানা ব্যবসায় গঠন করতে কোনোরূপ আইনের আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় না। যেকোনো লোক অল্প মূলধনে এরূপ ব্যবসায় গঠন করতে পারে । যেকোনো লোক অল্প মূলধনে এরূপ ব্যবসায় গঠন করতে পারে। কিন্তু বৃহদায়তন একমালিকানা প্রতিষ্ঠান গঠন করা কষ্টসাধ্য বলে অনেক লোক বৃহদায়তন ব্যবসায়ের পক্ষপাতি নয়। এ কারণেই বৃহদায়তন ব্যবসায়ের পাশাপাশি একমালিকানা ব্যবসায় টিকে আছে ।
২। বিশেষ ক্ষেত্রের সুবিধা (Suitability of special field): বৃহাদায়তন ও ক্ষুদ্রায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কার্য ক্ষেত্রের প্রকৃতি ভিন্ন। কিছু ব্যবসা আছে যাতে বৃহদায়তন ব্যবসায় নিষ্প্রয়োজন যেমন-পান বিড়ির দোকান, মুদির দোকান, সেলুন প্রভৃতি ।
৩। স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ (Opportunity to act independently): মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। অনেক মানুষ আছে যারা অন্যের চাকরি করতে পছন্দ করে না । তারা স্বল্প পুঁজি নিয়ে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে চায় । এরূপ মনোভাব একমালিকানা ব্যবসায় প্রতিফলিত হতে দেখা যায় ।
৪। অবস্থান (Location): বৃহদায়তন ব্যবসায় সাধাণত শহরের কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত হয় । গ্রামের আনাচে- কানাচে বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্রায়তন একমালিকানা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করা বাঞ্ছনীয়।
৫। আস্থা ও বিশ্বাস (Confidence and trust): এ ধরনের ব্যবসায়ের মালিক একজন মাত্র ব্যক্তি। তাই বৃহদায়তন ব্যবসায়ের মতো অন্যের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রয়োজন পড়ে না ।
৬। স্বল্প ব্যয় (Economy of cost ) : একমালিকানা ব্যবসায় সাধারণত মালিক নিজে বা পরিবারের লোকজন নিয়ে পরিচালনা করে থাকেন। ফলে ব্যবসায়ের সর্বস্তরে ব্যয় সংকোচন সম্ভব হয়। কিন্তু বৃহদায়তন ব্যবসায় এরূপ ব্যয় সংকোচন সম্ভব নয়। ফলে একমালিকানা ব্যবসায় বৃহদায়তন ব্যবসায়ের পাশাপাশি সাফল্যজনকভাবে টিকে থাকে ।
৭। সীমিত উৎপাদন ও চাহিদাসম্পন্ন দ্রব্যের জন্য উপযোগী (Suitable for products having limited production and demand): যেসব পণ্যের উৎপাদন ও চাহিদা সীমিত এবং স্থানীয় গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ সেসব পণ্যের উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে একমালিকানা ব্যবসায় অধিক উপযোগী।
৮। সহজ পরিচালনা (Easy administration): সীমিত আয়তন ও সীমিত পণ্যের ব্যবসায় হওয়ায় একমালিকানা ব্যবসায় পরিচালনা করা সহজ হয়। কেননা বৃহদায়তন ব্যবসায়ের মতো পরিচালনাগত আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় না।
৯। স্বল্প ঝুঁকি (Limited risk): অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ ধরনের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় বলে বৃহদায়তন ব্যবসায়ের তুলনায় ঝুঁকিও কম থাকে ।
১০। চাহিদার নমনীয়তা (Flexibility of demand): বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্রেতার চাহিদা ও রুচি দিন দিন পরিবর্তন হচ্ছে। এরূপ পরিবর্তিত রুচির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বৃহদায়তন ব্যবসায় অপেক্ষা ক্ষুদ্রায়তন একমালিকানা ব্যবসায় অধিক উপযোগী ।
পরিশেষে বলা যায়, বৃহদায়তন উৎপাদন ও বণ্টনের যুগেও একমালিকানা ব্যবসায় বাণিজ্য কার্যকর ভুমিকা রাখছে। বৃহদায়তন ব্যবসায়ে প্রতিযোগী না হয়ে তার সহযোগী হিসেবে একমালিকানা ব্যবসায়ের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ব্যবসায় পরিবারের দ্বিতীয় সদস্য হলো অংশীদারি সংগঠন। একমালিকানা ব্যবসায়ে একক মালিকের পুঁজি ও সামর্থের সীমাবদ্ধতার কারণে এক পর্যায়ে বড় ধরনের সংগঠনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। ফলশ্রুতিতে একাধিক ব্যক্তির মালিকানা ও তত্ত্বাবধানে সৃষ্টি হয় অংশীদারি সংগঠন। এ ব্যবসায়ে ন্যূনতম ২ জন এবং সর্বাধিক ২০ জন সদস্য থাকে। তবে ব্যাংকিং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সর্বাধিক ১০ জন সদস্য থাকে। ১৯৩২ সালের ভারতীয় অংশীদারি আইন অনুযায়ী, “সকল ব্যক্তির দ্বারা বা সকলের পক্ষে একজন দ্বারা পরিচালিত ব্যবসায়ের মুনাফা নিজেদের মধ্যে বণ্টনের নিমিত্তে কতিপয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ সম্পর্কই হলো অংশীদারি ব্যবসায়। বাংলাদেশে বর্তমানে ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনটি প্রচলিত রয়েছে।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা জানতে পারব—
সূত্র: ক্যামব্রিয়ান পাবলিকেশন্স
অংশীদারি ব্যবসায় একটি প্রাচীন ধরনের সংগঠন। শুরুতে একক মালিকানার ভিত্তিতে এ সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও এক পর্যায়ে এসে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক প্রয়োজনেই একাধিক ব্যক্তি সামর্থ্যের সমন্বয় অপরিহার্য হয়ে পড়ে। জন্ম নেয় অংশীদারি ব্যবসায় সংগঠনের। সহজ অর্থে একের অধিক ব্যক্তি মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে অংশীদারিত্ব বা শরিকানার ভিত্তিতে যে ব্যবসায় গঠন করে তাকে অংশদিারি ব্যবসায় বলে। ব্যাপক অর্থে কমপক্ষে দুজন এবং সর্বোচ্চ বিশজন (ব্যাংকিং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দশজন) ব্যক্তি মুনাফা অজন ও তা নিজেদের মধ্যে বণ্টনের নিমিত্তে চুক্তিবদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় যে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে তাকে অংশীদারি ব্যবসায় বলা হয়ে থাকে । ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৪নং ধারায় বলা হয়েছে-“সকলের দ্বারা অথবা সকলের পক্ষে যেকোনো একজনের দ্বারা পরিচালিত ব্যবসায়ের মুনাফা নিজেদের মধ্যে বণ্টন করার উদ্দেশ্যে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে যে সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, তাকে অংশীদারি ব্যবসায় বলে।”
অংশীদারি ব্যবসায় দুই বা ততোধিক ব্যক্তির সম্মিলিত চুক্তির মাধ্যমে গঠিত একটি ব্যবসায় সংগঠন। মালিকানা গঠন ও পরিচালনাগত বিভিন্ন দিক থেকে অংশীদারি ব্যবসায় কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যা এ ব্যবসায়কে অন্যান্য ব্যবসায় থেকে আলাদা করেছে। নিম্নে অংশীদারি ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. অংশীদারের সংখ্যা (Number of partners): বাংলাদেশে প্রচলিত আইন অনুসারে কমপক্ষে দুজন এবং সাধারণ ব্যবসায়ে ২০ জনের অনধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে এ ব্যবসায় গঠিত হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ব্যাংকিং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ১০ জনের অধিক হলে উক্ত প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যেক সদস্যের জন্য এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হতে পারে ।
২. চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক (Contractual relation): চুক্তিই অংশীদারি ব্যবসায়ের মূল ভিত্তি। চুক্তির মাধ্যমেই অংশীদারি ব্যবসায়ের সৃষ্টি হয়। জন্মগত বা সামাজিক অধিকার বলে নয়। দুই বা ততোধিক ব্যক্তি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চুক্তিতে আবদ্ধ হলেই অংশীদারদের চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. সহজ গঠন প্রণালি (Easy formation): অংশীদারি ব্যবসায় সংগঠন যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠনের মতো তত জটিল নয়। দুই বা ততোধিক ব্যক্তি (কিন্তু সাধারণ ব্যবসায়ে ২০ জনের অধিক নয়, এবং ব্যাংকিং ব্যবসায়ে ১০ জনের অধিক নয়) একত্রে মিলিত হয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এ ব্যবসায় গঠন করতে পারবে। ব্যবসায়ের উক্ত চুক্তি মৌখিক বা লিখিত উভয়ই হতে পারে। উক্ত চুক্তি নিবন্ধন বা অনিবন্ধনকৃত হতে পারে। তবে চুক্তির উদ্দেশ্য অবশ্যই আইনসম্মত হতে হবে।
৪. মূলধন (Capital): ব্যবসায়ের মূলধন অংশীদারগণ যোগান দেয়। কে কতটুকু মূলধন যোগান দিবে তা তাদের নিজেদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির উপর নির্ভর করে। এ বিষয়ে কোনো চুক্তি না থাকলে তারা সমানভাবে মূলধন যোগায়। প্রসঙ্গক্রমে উলেখ করা প্রয়োজন যে, কোনো মূলধন না দিয়ে অংশীদার হতে পারে এবং মুনাফা বণ্টনে অংশগ্রহণ করতে পারে।
৫. দায়-দায়িত্ব (Liabilities): অংশীদারি ব্যবসায়ের দেনার জন্য প্রত্যেক অংশীদার ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে দায়ী থাকে। অর্থাৎ ব্যবসায়ে লোকসান হলে লোকসানের ভাগ তাদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে ভাগ করে দেয়া হয়। লোকসানের ভাগ শুধু একজনের পক্ষে বহন করা সম্ভব হলে এবং অন্য সদস্যদের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব না হলে বিত্তশালী একজনকে সকল লোকসানের ঝুঁকি বহন করতে হয় । সংক্ষেপে বলা যায়, অংশীদারের দায় সীমাহীন এবং তারা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে কারবারের দেনার জন্য দায়ী থাকে ৷
৬. লভ্যাংশ বণ্টন (Profit sharing): কোনো অংশীদার কত লভ্যাংশ পাবে তা তাদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির উপর নির্ভর করে । চুক্তিতে মুনাফা বণ্টনের উলেখ না থাকলে বাংলাদেশের অংশীদারি আইন অনুসারে প্রত্যেক অংশীদার সমান অনুপাতে মুনাফা ভোগ করার অধিকারী ।
৭. পরস্পরের প্রতি পরস্পরের আস্থা ও বিশ্বাস (Mutual trust and confidence): অংশীদারদের মধ্যে পারস্পরিক সদ্বিশ্বাস ও আস্থা অংশীদারি কারবারের একটি বৈশিষ্ট্য। একে অপরের প্রতি বিশ্বাসের উপর অংশীদারি ব্যবসায়ের অস্তিত্ব নির্ভর করে। অনেক সময় এক বা একাধিক অংশীদারের পক্ষে হয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করে। সে ক্ষেত্রে অংশীদারগণ উক্ত ব্যক্তির প্রতি আস্থাবান না হলে ব্যবসায় চলতে পারে না। একজন অংশীদার তাহার কার্য দ্বারা প্রত্যেক অংশীদারকে সমভাবে আবদ্ধ করে এবং ব্যবসায় কোনো লোকসান দেখা দিলে তা সমভাবে বা চুক্তি মোতাবেক সকল অংশীদারকে বহন করতে হয়।
৮. নিবন্ধন (Registration): অংশীদারি ব্যবসায়ের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়। এটি নিবন্ধিত হতে পারে নাও হতে পারে। তবে ভবিষ্যৎ বিবাদ এড়ানোর জন্য নিবন্ধন করা ভালো। এটি ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
৯. সত্তা (Entity): ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হতে এর পৃথক কোনো সত্তা নাই । অংশীদারগণের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের সত্তা নেই যৌথ-মূলধনী কোম্পানির ন্যায় ফার্ম (Firm) বা প্রতিষ্ঠান নিজ নামে চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারে না। এ কারণে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান অন্য কোনো অংশীদারি ব্যবসায়ের সদস্য হতে পারে না বা অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে অংশীদারি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারে না ।
১০. অংশীদারদের যোগ্যতা (Capacity of partners): দেশের প্রাপ্ত বয়স্ক যেকোনো নাগরিক অংশীদারি ব্যবসায়ের সদস্য হতে পারে। তবে পাগল, নাবালক, দেউলিয়া প্রভৃতি ব্যক্তি চুক্তি সম্পাদনের অনুপযুক্ত বিধায় অংশীদারি ব্যবসায়ের সদস্য হতে পারে না।
পরিশেষে বলা যায় যে, উলেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ অংশীদারি সংগঠনকে স্বকীয়তা দানের মাধ্যমে উপযোগী ক্ষেত্রে সফলতার সাথে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে সহায়তা করছে।
অংশীদারি ব্যবসায় গঠন করা সহজ। দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজেদের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মূলধন সরবরাহ করে এ ব্যবসায় গঠন করতে পারে। আমাদের দেশে ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন অনুযায়ী এ ব্যবসায় গঠিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। অংশীদারি ব্যবসায় গঠন করতে হলে নিলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।
১। একত্রিত হওয়া (Being united): প্রথমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উদ্যোক্তা বা সদস্য ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে একত্রিত হবেন। ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের বিধান অনুসারে সর্বনি সদস্য সংখ্যা ২ জন এবং সর্বোচ্চ সদস্য সংখ্যা সাধারণ ক্ষেত্রে ২০ জন এবং ব্যাংকিং অংশীদারি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ১০ জন।
২। চুক্তিপত্র সম্পাদন (Sign contract): অংশীদারি ব্যবসায় সম্পর্কিত বিষয় যেমন-মূলধনের পরিমাণ, লাভ লোকসান বণ্টন, পারস্পরিক অধিকার ইত্যাদি উল্লেখ করে সদস্যদের মধ্যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করতে হয় । তবে চুক্তিপত্র ছাড়া মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতেও অংশীদারি ব্যবসায় গঠিত হতে পারে ।
৩। চুক্তিপত্র নিবন্ধন (Register contract): এ পর্যায়ে অংশীদারদের দ্বারা সম্পাদিত চুক্তিপত্র সরকার নির্ধারিত নিবন্ধকের অফিসে নিবন্ধন করাতে হয়। অবশ্য আইনে চুক্তিপত্রের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়নি। অর্থাৎ এর নিবন্ধন না করলেও চলে ।
৪। ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ (Collecting trade licence): ব্যবসায় শুরু করার জন্য এ পর্যায়ে স্থানীয় পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত অফিস থেকে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয় । অবশ্য পৌর এলাকার বাইরে এ ধরনের ট্রেড লাইসেন্স খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় ।
৫। অন্যান্য সরকারি দপ্তরের অনুমতি (Permission from other Govt. authority): এক্ষেত্রে ব্যবসায়ের প্রকৃতি অনুসারে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হয় । যেমন—রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির জন্য রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং ট্রাভেল এজেন্সির ক্ষেত্রে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি প্রয়োজন।
৬। ব্যবসায় শুরু (Start Business) : উপরিউক্ত আনুষ্ঠানিকতাসমূহ সফলভাবে সমাপ্ত হলে অংশীদারগণ মুনাফা অর্জনের জন্য ব্যবসায়িক কর্মকান্ড শুরু করেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, উপরে বর্ণিত আনুষ্ঠানিকতাসমূহ ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করে একটি অংশীদারি ব্যবসায় সংগঠন গঠিত হতে পারে। তবে সব ধরনের অংশীদারি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে উল্লিখিত সকল আনুষ্ঠানিকতা পালন করার প্রয়োজন নাও হতে পারে।
একাধিক ব্যক্তি চুক্তির মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের জন্য যে ব্যবসায় গড়ে তোলে তাকে অংশীদারি ব্যবসায় বলে বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা কয়েক ধরনের অংশীদারি ব্যবসায় দেখি। নিম্নে ব্যবসায়ের প্রকৃতি ও অংশীদারদের দায়-দায়িত্বের ভিত্তিতে এ ব্যবসায়কে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যথা—
১। সাধারণ অংশীদারি ব্যবসায় (General partnership business): যে অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের অংশীদারদের দায় অসীম এবং অংশীদারগণ একক ও যৌথভাবে দেনা পরিশোধের জন্য দায়ী থাকে তাকে সাধারণ অংশীদারি ব্যবসায় বলে। এ ধরনের অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় সকল অংশীদারের সমান অধিকার থাকে। সাধারণ অংশীদারি ব্যবসায় সকলের দ্বারা অথবা সকলের পক্ষে এক বা একাধিক অংশীদারের দ্বারা পরিচালিত। বাংলাদেশে অংশীদারি ব্যবসায় বলতে সাধারণ অংশীদারি ব্যবসায়কে বুঝায়। বাংলাদেশে প্রচলিত ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন অনুযায়ী সাধারণ অংশীদারি ব্যবসায়ের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয় । এরূপ ব্যবসায় দু'ধরনের হতে পারে।
ক. ঐচ্ছিক অংশীদারি ব্যবসায় (Partnership at will):
১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন অনুসারে কোনো অংশীদারি চুক্তিপত্রে অংশীদারগণ ব্যবসায়ের স্থায়িত্ব বা সীমানা নির্ধারণ না করলে তাকে ঐচ্ছিক অংশীদারি ব্যবসায় বলে।
আইন অনুসারে এ ব্যবসায় নিম্নোক্তভাবে গঠিত হতে পারে—
i. অনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ব্যবসায় গঠিত হলে;
ii. নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের পরও ব্যবসায় চালু থাকলে;
iii. নির্দিষ্ট সময়ের পরও ব্যবসায় চালু থাকলে;
খ. নির্দিষ্ট অংশীদারি ব্যবসায় (Particular partnership): অংশীদারি আইনের ৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, একজন ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে একত্রে কোনো নির্দিষ্ট মেয়াদ বা প্রচেষ্টার জন্য অংশীদারি হিসেবে গণ্য হতে পারে। একেই নির্দিষ্ট বা বিশেষ অংশীদারি ব্যবসায় বলে ।
এরূপ ব্যবসায় দুধরনের হতে পারে—
i. নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত অংশীদারি ব্যবসায় (Specific term partnership): একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গঠিত অংশীদারি ব্যবসায়কে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত অংশীদারি ব্যবসায় বলে। এ নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম হওয়ার সাথে সাথে এরূপ অংশীদারি ব্যবসায়ের বিলুপ্তি ঘটে। তবে অংশীদারগণের সম্মতিতে এ ধরনের ব্যবসায়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও চালু থাকতে পারে।
ii. নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রতিষ্ঠিত অংশীদারি ব্যবসায় (Specific Job partnership): বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কোনো অংশীদারি ব্যবসায় গঠন করা হলে তাকে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য স্থাপিত অংশীদারি ব্যবসায় বলা হয়। নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য অর্জিত হলে এর বিলুপ্তি ঘটে। অবশ্য সকল অংশীদার একমত হলে এরপরও চালাতে পারে।
২। সীমাবদ্ধ অংশীদারি ব্যবসায় (Limited partnership): এক বা একাধিক অংশীদারের সীমিত পরিমাণ দায়-দায়িত্ব নিয়ে যে অংশীদারি ব্যবসায় গঠিত হয় তাকে সীমাবদ্ধ অংশীদারি ব্যবসায় বলে । অর্থাৎ যদি কোনো অংশীদারের দায় অসীম না থাকে বা কোনো এক বা একাধিক সদস্যের দায় চুক্তি অনুযায়ী বা আইনগত কারণে সীমাবদ্ধ থাকে তাকে সীমাবদ্ধ অংশীদারি ব্যবসায় বলে ।
এ ব্যবসায় দু'ধরনের অংশীদার থাকে । যথা—
i. সাধারণ অংশীদার, যাদের দায় অসীম থাকে ।
ii. সীমিত অংশীদার, যাদের দায় সীমাবদ্ধ থাকে।
পরিশেষে বলা যায় যে, দেশে যেসব অংশীদারি ব্যবসায় চালু আছে তার মধ্যে সাধারণ অংশীদারি ব্যবসায় বেশি। তবে এর পাশাপাশি সীমাবদ্ধ অংশীদারি ব্যবসায়েরও অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।
অংশীদারি ব্যবসায় পরস্পর চুক্তির ভিত্তিতে গঠিত হয়। চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার প্রাক্কালে অংশীদারি সংগঠন গঠনেচ্ছু ব্যক্তিগণ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবসায় সংগঠন ও পরিচালনা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি নির্ধারণ করে এবং তাদের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত বিষয়াদি লিখিতভাবে একটি দলিলে সন্নিবেশিত করে। উক্ত দলিলকেই অংশীদারি চুক্তিপত্র বলে ।
বাংলাদেশে বহাল ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৫ ধারা মতে, ”অংশীদারির সম্পর্ক চুক্তি হতে জন্ম লাভ করে; সামাজিক মর্যাদা বলে নয়।” (The relation of partnership arises from contract and not from status")
পরিশেষে বলা যায় যে, কারবার পরিচালনার সুবিধাজনক এবং বিলোপসাধন সংক্রান্ত শর্তাবলি সংবলিত লিখিত অংশীদারি চুক্তিকে অংশীদারি চুক্তিপত্র বা দলিল বলে।
“চুক্তিই অংশীদারি ব্যবসায়ের ভিত্তি”-ব্যাখা কর ৷ Contract is the Essence of Partnership"-Explain.
অংশীদারি ব্যবসায়ের মূল ভিত্তি হলো চুক্তি । অর্থাৎ চুক্তির মাধ্যমে একটি অংশীদারি ব্যবসায় জন্মলাভ করে এবং চুক্তি হতে উদ্ভূত সম্পর্ক দ্বারা অংশীদারি ব্যবসায় পরিচালিত হয় । অংশীদারগণের পারস্পরিক সম্পর্কও নির্ধারিত হয়
চুক্তির মাধ্যমে।
অংশীদারি আইনের ৫ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, “অংশীদারির সম্পর্ক চুক্তি হতে জন্ম লাভ করে, আত্মীয়তা বা সামাজিক অধিকার বলে নয়।” (Partnership relation arises from the contract and not from status.")
সাধারণভাবে কোনো ব্যবসায়ে একাধিক সদস্য এবং মুনাফা বণ্টনের বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে অংশীদারি ব্যবসায় মনে করা হয় । কিন্তু আইনগত বিচারে অংশীদারির অস্তিত্ব নির্ণয়ে চুক্তিবদ্ধ সম্পর্কই মুখ্য বলে বিবেচিত।
উল্লেখিত সংজ্ঞা এবং আলোচনার প্রেক্ষিতে পরিলক্ষিত হয় যে, অংশীদারি সম্পর্ক সৃষ্টিতে চুক্তির আবশ্যকতা রয়েছে। যেসব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অংশীদারি চুক্তি সম্পন্ন করা হয় তাহলো—
i. কোনো বিষয়ের ভুল বুঝাবুঝি নিরসন;
ii. অংশীদারিত্বের ভিত্তি ও রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে;
iii. চুক্তিপত্র প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কাজ করে;
iv. তৃতীয় পক্ষ হতে ঋণ বা কোনো প্রকার সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য;
v. চুক্তির ভিত্তিতে ব্যবসায় পরিচালনা করে;
vi. অংশীদারদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ;
vii. মূলধন আনয়ন ও তার ব্যবহার সুনিশ্চিত করার জন্য।
নিচের কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হলো—
১। হিন্দু যৌথ পারিবারিক ব্যবসায় (Hindu joint family business): কোনো হিন্দু পরিবারের সদস্যরা যদিও তাদের পরিবারের মোট আয় নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে থাকে কিন্তু শুধুমাত্র চুক্তি না থাকায় বর্তমানে একে অংশীদারি ব্যবসায় বলা যায় না ।
২।উত্তরাধিকার সম্পর্ক (Heriditary relationship): চলমান ব্যবসায়ের কোনো সদস্যের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী বা সন্তানরা কারবারের মুনাফা ভোগ করলেও তারা ব্যবসায় অংশীদার নয়। অংশীদার হতে চাইলে তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদাভাবে অন্যান্য অংশীদারদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে।
৩। পদমর্যাদা (Designation) : সামাজিক পদমর্যাদার জন্য কোনো কর্মচারী বা কর্মকর্তাকে মুনাফার কিছু অংশ প্রদান করা হলেও তাকে ব্যবসায়ের অংশীদার বলা যাবে না । কারণ শুধুমাত্র সামাজিক পদ- মর্যাদার জন্য মুনাফার অংশ ভোগ করছে কিন্তু চুক্তিতে আবদ্ধ না হওয়ার জন্য অংশীদার নয়।
৪। সামাজিক অবস্থান (Social position) : কয়েকজন গায়িকার গানের অনুষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত আয় নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিলেও তাদের সংগঠনকে অংশীদারি ব্যবসায় বলা যায় না। কারণ তাদের মধ্যে ব্যবসায় বা মুনাফা অর্জন সংক্রান্ত কোনো চুক্তি সম্পাদিত হয়নি।
৫ ৷ ঋণের মুনাফা প্রাপ্তি (Profit receive for status) : অংশীদারি ব্যবসায়ে ঋণ দিয়ে কোনো ব্যক্তি ঋণ চুক্তি অনুযায়ী ব্যবসায় হতে মুনাফা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু তার সাথে অংশীদারি চুক্তি না থাকায় তাকে অংশীদার হিসেবে গণ্য করা যাবে না।
৬। পেশাদারি দলের মুনাফা বণ্টন (Profit distribution in professional group): পেশাদারি সাংস্কৃতিক দল মুনাফা অর্জনের পর তা নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিলেও তাদের অংশীদার বলা যাবে না। কারণ তারা অংশীদারি চুক্তি সম্পন্ন করেনি ।
পরিশেষে বলা যায় যে, অংশীদারি ব্যবসায়ের অস্তিত্ব যাচাইয়ের প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে অংশীদারদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি। মুলত চুক্তি লিখিত বা মৌখিক যেভাবেই হোক না কেন তা ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনার দিক-নির্দেশক (Guide line) হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই বলা হয়, “চুক্তিই অংশীদারি কারবারের মূল ভিত্তি ।”
অংশীদারি চুক্তিপত্রের বিষয়বস্তু (Contents of Partnership Deed)
অংশীদারি চুক্তিপত্র অংশীদারি ব্যবসায় পরিচালনার মূলমন্ত্র হিসেবে পরিচিত। অংশীদারগণ নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেরাই চুক্তিপত্রের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে থাকে। অংশীদারদের মধ্যে ভবিষ্যতে ঝগড়া-বিবাদ ও মামলা-মোকদ্দমা এড়াতে চুক্তিপত্রের শর্তাবলিই কার্যকর ভূমিকা রাখে। নিে
অংশীদারি চুক্তিপত্রের বিষয়বস্তু উল্লেখ করা হলো—
১. অংশীদারি ব্যবসায়ের নাম;
২. ব্যবসায়ের ঠিকানা:
৩. ব্যবসায়ের আওতাভুক্ত এলাকা;
৪. ব্যবসায়ের প্রকৃতি, উদ্দেশ্য ও আওতা;
৫. ব্যবসায়ের কার্যক্রম বিস্তৃতির বর্তমান ও সম্ভাব্য এলাকা;
৬. ব্যবসায়ের স্থায়িত্ব;
৭. অংশীদারদের নাম, ঠিকানা ও পেশা;
৮. ব্যবসায়ের মোট মূলধনের পরিমাণ;
৯. মূলধন আনয়ন ও সংগ্রহ পদ্ধতি;
১০. অংশীদারদের প্রকৃতি নির্ধারণ;
১১. অংশীদারদের প্রত্যেকের প্রদত্ত পুঁজির পরিমাণ ও তা পরিশোধ পদ্ধতি;
১২. মূলধনের ওপর সুদ দেয়া হবে কিনা, হলে কি হারে;
১৩. অংশীদারগণ ব্যবসায় হতে কোনো অর্থ উত্তোলন করতে পারবে কিনা, পারলে কে কত বা কি হারে;
১৪. উত্তোলিত অর্থের ওপর সুদ ধরা হবে কিনা;
১৫. ব্যবসায়ের লাভ-লোকসান বণ্টন পদ্ধতি ও হার;
১৬. ব্যবসায়ের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি;
১৭. ব্যবসায়ের হিসাব বহি রক্ষণ ও হিসাব নিরীক্ষা পদ্ধতি;
১৮. ব্যবসায়ের হিসাব বহি সংরক্ষণ ও পরিদর্শন সংক্রান্ত নিয়ম;
১৯. যে ব্যাংকে হিসাব খোলা হবে তার নাম, ঠিকানা ও হিসাবের ধরন;
২০. ব্যাংকের হিসাব পরিচালনাকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের নাম পদবি ;
২১. ব্যবসায়ের দলিল পত্রে দস্তখত প্রদানকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের নাম পদবী :
২২. ব্যবসায়ের প্রয়োজনে কোনো অংশীদার ঋণ সরবরাহ করলে তার ওপর দেয় সুদের হার;
২৩. ব্যবসায়ের প্রয়োজনে অন্যত্র হতে ঋণ সংগ্রহ পদ্ধতি;
২৪. অংশীদারগণের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা;
২৫. কোনো অংশীদারকে কোনো বেতন বা পারিতোষিক দেয়া হবে কিনা, হলে কী হারে;
২৬. ব্যবসায়ের সুনাম মূল্যায়ন সম্পর্কিত বিধি-বিধান;
২৭. অংশীদারদের মধ্যে কোনো বিবাদ দেখা দিলে তা মীমাংসা পদ্ধতি;
২৮. অংশীদার অপ্রকৃতিস্থ বা দেউলিয়া হলে তার অংশ নিরূপণ, সংরক্ষণ ও পরিশোধ পদ্ধতি;
২৯. ব্যবসায় সম্প্রসারণের নিয়ম;
৩০. নাবালক অংশীদার গ্রহণের নিয়ম;
৩১. নতুন অংশীদার গ্রহণ ও প্রয়োজনে বিদ্যমান কোনো অংশীদারকে বহিষ্কারের নিয়ম;
৩২. কোনো অংশীদারের মৃত্যু বা অবসরগ্রহণকালে ব্যবসায়ের দায়-সম্পত্তি নিরূপণ ও পাওনা পরিশোধ পদ্ধতি;
৩৩. ব্যবসায়ের আর্থিক বছরের শুরু ও শেষ সময়;
৩৪. ঋণ গ্রহণ ও প্রদানের নিয়মাবলি;
৩৫. অংশীদার কর্তৃক প্রদত্ত ঋণের নিয়ম ও সুদের হার;
৩৬. ঋণ পরিশোধ ও আদায় পদ্ধতি;
৩৭. ব্যবসায়ের বিলোপসাধন পদ্ধতি;
৩৮. ব্যবসায়ের বিলোপকালে ব্যবসায়ের দায়-সম্পত্তি মূল্যায়ন ও বণ্টন প্রণালি
৩৯. চুক্তিপত্রের কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজনে নিয়ম পদ্ধতি;
৪০. চুক্তিপত্রের বাইরে কোনো বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলে আমাদের দেশে তা ১৯৩২ সালে অংশীদারি আইন অনুযায়ী অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে মীমাংসা করা হয়। অবশ্য চুক্তিপত্রের কোনো ধারা বা ধারাসমূহ সকল সদস্যের মতানুযায়ী আইনের আওতায় থেকে সর্বদাই পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন বা রহিত করা যায় ।
পরিশেষে বলা যায় যে, চুক্তি মৌখিক হতে পারে, তবে সমস্যা দেখা দিলে মৌখিক চুক্তির কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এজন্য চুক্তি লিখিত হওয়া সুবিধাজনক ।
অংশীদারি ব্যবসায়ের নিবন্ধন বলতে সরকার নির্ধারিত নিবন্ধকের অফিসে ব্যবসায়ের নাম তালিকাভুক্ত করাকে বুঝায়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট এলাকার নিবন্ধকের কার্যালয়ে রক্ষিত বইতে অংশীদারি ব্যবসায়ের নাম ও প্রয়োজনীয় তথ্য লিপিবদ্ধকরণকে অংশীদারি ব্যবসায়ের নিবন্ধন বলা হয় ।
১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৫৮ ধারা অনুযায়ী কোনো অংশীদারি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করতে হলে প্রথমত নিবন্ধকের অফিস হতে নির্ধারিত ফি জমাপূর্বক একটি ফর্ম/ আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হবে। আবেদনপত্রটি যথাযথভাবে পূরণ করে চুক্তিপত্র ও গঠনতন্ত্রসহ নিবন্ধকের অফিসে জমা করতে হবে। সাধারণত আবেদনপত্রে নি লিখিত বিষয়সমূহ উল্লেখ করতে হয়—
১. অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের নাম;
২. প্রধান অফিসের ঠিকানা:
৩. অন্য কোথাও ব্যবসায়ের শাখা অফিস থাকলে তার ঠিকানা;
৪. ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য ও আওতা;
৫. ব্যবসায়ের মেয়াদ (যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য হয়);
৬. প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তারিখ;
৭. প্রত্যেক অংশীদারের নাম, ঠিকানা, পেশা
৮. অংশীদার হিসেবে যোগদানের তারিখ ইত্যাদি ।
আবেদনপত্রটি প্রত্যেক অংশীদার কর্তৃক বা তার উপযুক্ত / আইনগত প্রতিনিধি কর্তৃক স্বাক্ষরিত হতে হবে। নিবন্ধক আবেদনপত্র ও চুক্তিপত্রটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলে ব্যবসায়টি তালিকাভুক্ত করবেন। চুক্তিপত্র কিংবা আবেদনপত্রের কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোগ ও বিয়োজন করতে হলে নিবন্ধকের অনুমতি নিতে হবে এবং তা সম্বন্ধে তাকে অবহিত করতে হবে।
অংশীদারি ব্যবসায়ের নিবন্ধন কি বাধ্যতামূলক (Is Registration of a Partnership Business Compulsory)
নিবন্ধন অংশীদারি ব্যবসায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। অংশীদারি ব্যবসায়ের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক না হলেও বাঞ্চনীয় বটে। কারণ অংশীদারি ব্যবসায় নিবন্ধিত হলে এর আইনগত ভিত্তি সুদৃঢ় হয় এবং ব্যবসায়িক কর্মকান্ড পরিচালনায় বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করে। নিবন্ধন অংশীদারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
অংশীদার ব্যবসায়ের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক না হলেও বাঞ্ছনীয় বটে। কারণ অংশীদারি ব্যবসায়ে নিবন্ধিত হলে পরবর্তীকালে অংশীদারগণের মধ্যস্থিত সম্ভাব্য কলহ অথবা তৃতীয় পক্ষের সাথে দেনা- পাওনা নিষ্পত্তির পরিপ্রেক্ষিতে সহায়ক হয়। নিবন্ধন করলে ব্যবসায়ের চুক্তিপত্রটি আইনসম্মত দলিলরূপে স্বীকৃতি লাভ করে। বস্তুত: নিবন্ধন অংশীদারি ব্যবসায়ের অস্তিত্ব প্রকাশ করে। তাছাড়া নিবন্ধিত অংশীদারি ব্যবসায় কতকগুলো সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে ।
অংশীদারি আইনের ৬৯ (১) ধারা মতে, অংশীদারি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত না হলে, বা নিবন্ধন বহিতে সংশ্লিষ্ট অংশীদারের নাম লিখিত না থাকলে কোনো অংশীদার অপর অংশীদার বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চুক্তি হতে উদ্ভূত অধিকার আদায়ের জন্য মামলা করতে পারবে না ।
পরিশেষে বলা যায় যে, অংশীদারি ব্যবসায় নিবন্ধন আইনত বাধ্যতামূলক নয়। তবে অংশীদারগণ ভবিষ্যৎ সুযোগ-সুবিধার জন্যে নিবন্ধন করে নিতে পারে। কারণ সংগঠন নিবন্ধন করা বা না করা অংশীদারদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। তবে একথা সত্য যে, নিবন্ধন করা হলে কতিপয় আইনগত সুবিধা পাওয়া যায়। তাই এরূপ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করাই উত্তম।
অংশীদারি ব্যবসায়ের নিবন্ধন না করার পরিণাম (Consequences of Non-Registration of Partnership Business)
১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনে ব্যবসায়ের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়নি। তবে নিবন্ধিত অংশীদারি ফার্ম ও অংশীদারকে বেশ কিছু সুবিধা দেয়া হয়েছে। তাই অনিবন্ধিত অংশীদারি ব্যবসায় ও এর সদস্যগণ নিবন্ধিত ব্যবসায়ের তুলনায় কিছুটা অসুবিধাজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় ।
১। পাওনা আদায়ের সমস্যা (Problem in collecting credit): অ-নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান ১০০ টাকার বেশি পাওনা আদায়ের জন্য মামলা করতে পারে না। [৬৯(৪) ধারা]
২। তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে মামলায় সমস্যা (Problem in submit case against third party): অ-নিবন্ধিত অংশীদারি কারবার তার কোনো অধিকার আদায়ের জন্য তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না। কিন্তু তৃতীয় পক্ষ তার কোনো অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অনিবন্ধিত অংশীদারি কারবারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে।
৩। চুক্তিজনিত অধিকার আদায়ের সমস্যা (Problem in Established right in contract): অনিবন্ধিত অংশীদারি প্রতিষ্ঠানে চুক্তিজনিত কোনো অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কোন অংশীদার অন্য কোনো অংশীদারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না । [৬৯(১) ধারা]
৪। স্বার্থরক্ষা (Protect interest) : স্বার্থ আদায়ের জন্য কোনো অংশীদার অপর কোনো অংশীদার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না।
৫। পারস্পরিক মামলা দায়ের-এ সমস্যা (Problem in case file against each other): অনিবন্ধিত অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের অংশীদারগণ পরস্পরের বিরুদ্ধে চুক্তির শর্ত মেনে চলার জন্য আদালতে মামলা করতে পারে না।
তবে উপরিউক্ত অসুবিধাগুলো থাকা সত্ত্বেও অনিবন্ধিত অংশীদারগণের নিম্নোক্ত অধিকারগুলো বলবৎ থাকে—
i. নিজ পাওনা বুঝে পাওয়ার অধিকার: বিলোপ সাধনকৃত ব্যবসায় হতে অংশীদারগণের পাওনা বুঝে নেয়ার অধিকার আছে।
ii. বিলোপসাধন ও হিসাব সংক্রান্ত অধিকার: অনিবন্ধিত অংশীদারি সংগঠনের অংশীদরগণ ব্যবসায় বিলোপ সাধন ও হিসাব সংক্রান্ত বিষয়ে মামলা করতে পারে।
iii.প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি উদ্ধারের অধিকারঃ অনিবন্ধিত অংশীদারি ব্যবসায় সংগঠনের অংশীদারগণ হিসাব-নিকাশ ও সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য আদালতে মামলা করতে পারে ।
iv. চুক্তিজনিত অধিকার: কোনো অংশীদার চুক্তি ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে ।\
ক. অংশীদারগণ পাওনা আদায়ের জন্য তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে;
খ. অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এক অংশীদার অন্য অংশীদারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে না;
গ. এরূপ ব্যবসায়ে তৃতীয় পক্ষকে চুক্তি পালনে বাধ্য করার জন্য মামলা করতে পারবেন; ঘ. তৃতীয় পক্ষ দাবি আদায়ের জন্য কোনো অংশীদারের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করার অধিকার আছে;
ঙ. প্রত্যেক অংশীদারি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে লাভ-লোকসান হিসাবের পর অংশীদারগণের নিজেদের আয়কর প্রদান করতে হয়, ফলে ঝামেলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়;
চ. প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হলে আইনগত মর্যাদা পায়। ফলে এরূপ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট মর্যাদা পেয়ে থাকে ।
পরিশেষে বলা যায় যে, অংশীদারি ব্যবসায় সংগঠন নিবন্ধিত হওয়া বাধ্যতামূলক না হলেও ভবিষ্যতে ভুল বুঝাবুঝি নিরসনের জন্যে এবং অংশীদারদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য এরূপ ব্যবসায় সংগঠনের নিবন্ধন করা বাঞ্ছনীয় হবে।
ব্যবসায় ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন অংশীদারি ব্যবসায় সংগঠন দেখি। তেমনি অবস্থা, ভূমিকা, কর্তব্য, দায়- দায়িত্ব, ক্ষমতা প্রভৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন অংশীদার দেখি।
১. সাধারণ বা সক্রিয় অংশীদার (Active partner): যে ব্যক্তি চুক্তির বলে অংশীদার হয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে নিযুক্ত থাকে তাকে সক্রিয় অংশীদার বলে। ঐ ব্যক্তিকে অন্যান্য অংশীদারগণের প্রতিনিধি বলা হয়ে থাকে। এরূপ অংশীদারের দায়িত্ব হলো—
ক. ব্যবসায়ে প্রয়োজনীয় মূলধন সরবরাহ করা;
খ. দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় অংশগ্রহণ করা;
গ. ব্যবসায় পরিচালনায় সৃষ্ট দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণ বহন করা ইত্যাদি ।
২. নিষ্ক্রিয় বা ঘুমন্ত অংশীদার (Sleeping or Inactive partner): যে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান হতে লাভ ও ক্ষতির অংশ গ্রহণ করে, অথচ নিজে ব্যবসায় পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে না, তাকে নিষ্ক্রিয় অংশীদার বলে । নিষ্ক্রিয় অংশীদারকে কারবার হতে অবসর গ্রহণের জন্য বিজ্ঞপ্তি (Public notice) দেবার কোনো বাধ্যবাধ্যকতা নেই। বিজ্ঞপ্তি না দিলেও অবসর গ্রহণের পরবর্তী সময়ে সম্পাদিত কার্যের জন্য সে দায়বদ্ধ হবে না ।
এরূপ অংশীদারের বৈশিষ্ট্য হলো—
ক. ব্যবসায়ে মূলধন সরবরাহ করে;
খ. ব্যবসায় হতে মুনাফা গ্রহণ করে;
গ. লোকসান ও দায় বহন করে;
ঘ. ব্যবসায় পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে;
ঙ. তারা অন্য অংশীদারের উপর নির্ভর করে;
চ. অন্য অংশীদারের উপর আস্থা রেখে ব্যবসায় পরিচালনায় নিষ্ক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ইত্যাদি ।
৩. নামমাত্র অংশীদার (Nominal partner): এরূপ অংশীদারের অংশীদারি ব্যবসায়ে কোনো স্বার্থ থাকে না। কেবলমাত্র নিজের সুনাম অংশীদার হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়া হয়। কিন্তু বাহিরের পাওনাদারগণের নিকট ঋণের জন্য তিনি দায়ী থাকে। এরা ব্যবসায়ে মূলধন বিনিয়োগ করে না, পরিচালনায়ও অংশ নেয় না, তবে চুক্তি অনুযায়ী লাভের অংশ অথবা নির্দিষ্ট বেতন বা অর্থ নেয়। নামমাত্র অংশীদারের বৈশিষ্ট্য হলো—
ক. এরূপ অংশীদার ব্যবসায়ে মূলধন বিনিয়োগ করে না;
খ. এ অংশীদারের সুনাম ও যশ ব্যবসায়ে ব্যবহৃত হয়;
গ. কেউ সরল বিশ্বাসে ঐ অংশীদারের উপস্থিতির কারণে ব্যবসায়ে ঋণদান করলে তার জন্য নামমাত্র অংশীদার দায়বদ্ধ হন ইত্যাদি ।
৪. আপাতঃদৃষ্টিতে অংশীদার (Quasi-partner): কোনো অংশীদার কারবার হতে অবসর গ্রহণের পর তাঁর প্রদত্ত মূলধন তুলে না নিয়ে ঋণ হিসেবে ব্যবসায় রেখে দিলে তাঁকে আপাতঃদৃষ্টিতে অংশীদার বলে । মূলধনের উপর তিনি । সুদ পেয়ে থাকেন। কার্যত এরুপ ব্যক্তি ব্যবসায়ের পাওনাদার; অংশীদার নয়। তবে কোনো সক্রিয় অংশীদারগণ বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে ব্যবসায়ে থেকে চলে গেলে তার দ্বারা তৃতীয় পক্ষের সৃষ্ট দায় তাকেই বহন করতে হবে ।
৫. নাবালক অংশীদার (Minor admitted as a partner): অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি (অর্থাৎ ১৮ বছরের নিচে) অংশীদারি কারবারে অংশগ্রহণ করলে তাকে নাবালক অংশীদার বলে। ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৩০(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, সকল অংশীদারগণের অনুমোদনক্রমে কোনো বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানে নাবালককে অংশীদারি সুযোগ-সুবিধাগুলো ভোগ করতে দেয়া হয়। কিন্তু সে প্রতিষ্ঠানের কোনো দায়-দায়িত্ব বহন করে না বলে অংশীদাররূপে স্বীকৃতি পায় না।
১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৩০ ধারা অনুযায়ী নাবালক কোন ব্যবসায়ের অংশীদার না হতে পারলেও সে অন্যান্য অংশীদারের সম্মতিক্রমে ব্যবসায়ে মূলধন বিনিয়োগ কওে মুনাফা ভোগ করতে পারে। কিন্তু কোন প্রকারেই তাকে ফার্মের দায়-দায়িত্বের জন্য দায়ী করা যাবে না। কেবল ফার্মে দেয় তার মূলধনের অংশ পরিমাণ দায়ের জন্যই তাকে দায়ী করা যায়, অতিরিক্ত কিছুর জন্য দায়ী করা যায় না। এমনকি তার ব্যক্তিগত সম্পত্তিও এ দায় হতে মুক্ত। কিন্তু সে যখন সাবালক হবে তখনই সে ফার্মেও সবকিছুর জন্য দায়ী হবে। অবশ্য সাবালক হওয়ার ৬ মাসের মধেই তাকে চুক্তিপত্রে দস্তখত দিতে হবে। এমনকি তখন নাবালক অবস্থায় যে দিন হতে সে ফার্মের অংশীদাররূপে গণ্য হয়েছিল, সে সময়কার দায় এবং কার্যকলাপের জন্য তাকে দায়ী করা যাবে। নাবালক অংশীদারকে সীমাবদ্ধ অংশীদার বলে ডাকা হয় ।
৬. আচরণে অনুমিত অংশীদার (Partner by holding out): যে ব্যক্তি প্রকৃত অংশীদার না হয়েও তার কথাবার্তা, আচরণ দ্বারা নিজেকে ব্যবসায়ের অংশীদার বলে পরিচয় দেন তাকে আচরণে অনুমিত অংশীদার বলে। যদি কেউ এতে প্রভাবিত হয়ে ব্যবসায়কে ঋণ দেয় বা চুক্তি করে তবে ঐ দায় আচরণে অনুমিত অংশীদারকে নিতে হবে ।
সংজ্ঞার আলোকে বলতে পারি আচরণে অনুমিত অংশীদার হলো -
ক. আচরণের মাধ্যমে পরিচয়দানকারি অংশীদার;
খ. এ অংশীদার ব্যবসায় পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে না;
গ. ব্যবসায়ে মূলধন সরবরাহ করে না;
ঘ. ব্যবসায় হতে মুনাফাও গ্রহণ করে না;
ঙ. কিন্তু আচরণ দ্বারা প্রভাবিত তৃতীয় পক্ষের দায়ের জন্য আচরণে অনুমিত অংশীদার দায়বদ্ধ হন;
চ. এরূপ অংশীদারের ভোটাধিকার থাকে না ইত্যাদি ।
৭. কর্মী অংশীদার (Working partner): যে অংশীদার ব্যবসায়ে কোনো মূলধন বিনিয়োগ করে না শুধুমাত্র নিজস্ব শ্রম ও দক্ষতা সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত রাখে তাকে কর্মী অংশীদার বলে। চুক্তি অনুযায়ী এরা অন্যান্য অংশীদারের ন্যায় ব্যবসায়ের লাভ-ক্ষতি অংশগ্রহণ করে এবং অসীম দায় বহনে বাধ্য থাকে। অবশ্য ব্যবসায় পরিচালনার জন্য এদেরকে নির্দিষ্ট হারে বেতন বা লাভের অংশ দেয়া হতে পারে।
৮. সীমিত বা সীমাবদ্ধ অংশীদার (Limited partner): চুক্তি অনুযায়ী ব্যবসায়ের কোনো অংশীদারের দায় সীমাবদ্ধ হলে বা আইনগতভাবে সকল অংশীদারের সম্মতিক্রমে কোনো নাবালককে সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করা হলে সেক্ষেত্রে অনুরূপ অংশীদারকে সীমিত অংশীদার বলে। এদের দায় সাধারণত ব্যবসায়ে নিয়োজিত উক্ত অংশীদারের মূলধন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হয়। আইন অনুযায়ী এরূপ অংশীদার ব্যবসায় পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। কোনো সাবালক যোগ্য ব্যক্তিও চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এরূপ অংশীদার হতে পারে। কোনো অংশীদারি ব্যবসায়ে এক বা একধিক সীমিত অংশীদার থাকলেও তাকে সীমাবদ্ধ অংশীদারি ব্যবসায় (limited partnership) বলে।
৯. প্রতিবন্ধ অংশীদার (Patner by estoppel): যদি ব্যবসায়ের অংশীদারগণ কোনো ব্যক্তিকে ব্যবসায়ের অংশীদার হিসাবে পরিচয় দেয় এবং উক্ত ব্যক্তি তা জেনেও মৌনতা অবলম্বন করে তবে তাকে প্রতিবন্ধ অংশীদার বলে। এরূপ প্রচারণার ফলে সৃষ্ট দায়ের জন্য উক্ত ব্যক্তি তৃতীয় পক্ষের নিকট দায়বদ্ধ হয় । প্রতিষ্ঠান নিজের স্বার্থে কোন ব্যক্তি বা তৃতীয়পক্ষকে এধরনের প্রতিবন্ধ অংশীদার হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। এধরনের কাজের জন্য প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধ অংশীদারকে মাসিক হারে সম্মানী বা অন্যকোন সুবিধা দিতে পারে।
পরিশেষে বলা যায় যে, অংশীদারি ব্যবসায়ের অংশীদার হতে হলে কোনো ব্যক্তির অবশ্যই চুক্তি সম্পাদনের যোগ্যতা থাকতে হবে। অবশ্য নাবালক অন্য অংশীদারদের সম্মতিক্রমে সীমিত অংশীদার হতে পারে। তবে পাগল, দেউলিয়া সরকারি কর্মচারী, বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও বিদেশি শত্রু আইন অনুযায়ী অংশীদার হতে পারে না। কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংঘ অংশীদার হওয়ার যোগ্যতা রাখে না ।
দেশের প্রাপ্ত বয়স্ক যেকোনো নাগরিক অংশীদারি ব্যবসায়ের সদস্য হতে পারে। তবে পাগল, নাবালক, দেউলিয়া প্রভৃতি ব্যক্তি চুক্তি সম্পাদনের অনুপযুক্ত বিধায় অংশীদারি ব্যবসায়ের সদস্য হতে পারে না। চুক্তি অংশীদারি ব্যবসায়ের ভিত্তি। আমাদের চুক্তি আইনের ১১ ধারা অনুসারে নাবালক (১৮ বৎসরের কম বয়স্ক) চুক্তি সম্পাদনে অক্ষম ।
অংশীদারি ব্যবসায়ের বিলোপ সাধন বা পরিসমাপ্তি বলতে সকল অংশীদারগণের মধ্যে অংশীদারি সম্পর্কের অবসানকে বুঝায় এবং তার পরিণতিস্বরূপ ব্যবসায়ের বিলোপ ঘটে থাকে। অংশীদারি সম্পর্ক বিলুপ্তি হলেই ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যাবে এমন নাও হতে পারে। কারণ অপর অংশীদারগণ ব্যবসায় বজায় রেখে ব্যবসায় চালাতে পারে। সেক্ষেত্রে একে ব্যবসায়ের পুনঃগঠন বলে ।
অংশীদারি ব্যবসায়ের বিলোপসাধনের সাথে যে বিষয়গুলো জড়িত—
ক. অংশীদারদের চুক্তিজনিত সম্পর্কের অবসান ঘটে;
খ. প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকান্ডের বিলুপ্তি;
গ. প্রতিষ্ঠানের সমুদয় সম্পদ ও দায়-দেনার মূল্যায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে পরিশোধ করা ।
পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যবসায়ের বিলোপসাধনে প্রতিষ্ঠান ও অংশীদারিত্বের- উভয়েরই বিলোপসাধন হয়। কিন্তু অংশীদারির বিলোপ ঘটলে ব্যবসায়ের পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে।
অংশীদারি ব্যবসায়ের বিলোপসাধন পদ্ধতি (Methods of Dissolution of Partnership Business)
অংশীদারি ব্যবসায়ের বিলোপ সাধন বলতে অংশীদারদের মধ্যে ব্যবসায়ের সকল সম্পর্কের সম্পূর্ণ অবসানকে বুঝায়। নিচে বর্ণিত যেকোনো পদ্ধতিতে অংশীদারি ব্যবসায়ের বিলোপ ঘটে—
১। সকলে একমত হয়ে বিলোপ সাধন (Dissolution by mutual agreement): অংশীদারগণ একমত হয়ে কারবার বিলোপসাধনের সিদ্ধান্ত নিলে যেকোনো সময় বা সকলের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির শর্তানুসারে নির্দিষ্ট সময় শেষে কারবারের বিলুপ্তি ঘটানো যায় (ধারা ৪০)।
২। বিজ্ঞপ্তি দ্বারা বিলোপসাধন (Dissolution by notice): ঐচ্ছিক অংশীদারি কারবারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অংশীদারি কারবারের বিলোপসাধন ঘটে থাকে। অর্থাৎ যেকোনো একজন অংশীদারি স্বেচ্ছায় বিজ্ঞপ্তি প্রদানের দ্বারা এ জাতীয় কারবার বিলোপ করতে পারে। কারবার বিলোপ সাধনের যে তারিখ উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে লেখা থাকে সেই তারিখ থেকে কারবারের বিলোপ সাধন কার্যকর হয়ে থাকে। যদি তারিখের উল্লেখ না থাকে তবে যে তারিখে অংশীদারগণ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে অবহিত হন সে তারিখ থেকেই কারবারের বিলুপ্তি ঘটেছে ধরে নেয়া হয় । [ধারা ৪৩ (১) ও (২)]
৩। বিশেষ কোনো ঘটনার জন্য বিলোপ সাধন (Dissolution on the happening of some contingencies): ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৪২ ধারা অনুসারে নিলিখিত বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অংশীদারি কারবারের বিলুপ্তি ঘটে থাকে—
i. অংশীদারগণ একমত হয়ে (By consensus of partners ): সকল অংশীদার স্বেচ্ছায় একমত হয়ে অংশীদারি কারবার গুটিয়ে ফেলতে পারে।
ii. নির্দিষ্ট সময় সমাপনান্তে (After the end of fixed time) : কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অংশীদারি কারবারের চুক্তি হয়ে থাকলে উক্ত সময় উত্তীর্ণ হবার সাথে সাথে কারবার প্রতিষ্ঠানটির বিলোপ সাধন ঘটে ।
iii. অংশীদার উন্মাদ বা পাগল হলে (If a partner becomes lunatic) : কোনো অংশীদারের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটলে কারবারটি ভেঙ্গে যেতে পারে ।
iv. অংশীদারের মৃত্যুর কারণে (On the death of partner): যেকোনো অংশীদারের মৃত্যুর কারণে এ জাতীয় কারবার ভেঙ্গে যেতে পারে ।
v. উদ্দেশ্য অর্জনের পর (After the achievement of the objective): কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কারবার স্থাপিত হলে ঐ উদ্দেশ্য হাসিলের পর কারবারটি বিলুপ্তির প্রশ্ন উঠে।
vi. কোনো অংশীদার অবসর গ্রহণ করলে (On the retirement of a partner): কারবারের যেকোনো অংশীদার যদি অবসর গ্রহণের নিমিত্তে আবেদন পেশ করে তবে আংশীদারি কারবারের বিলোপ সাধিত হয় ।
vii. আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হলে (If a partner is declared insolvent by the court): যদি কোনো অংশীদার বিশেষ কোনো কারণে আদালত মারফত দেউলিয়া ঘোষিত হয় তাহলে উক্ত কারবারের বিলুপ্তি ঘটে।
৪। বাধ্যতামূলক বিলোপ সাধন (Compulsory dissolution ) : নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে অংশীদারি কারবারের বাধ্যতামূলক অবসায়ন হয়ে থাকে—
i. দেউলিয়াত্ব (Insolvency): সকল অংশীদার বা একজন ব্যতীত সকল অংশীদার আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হলে অংশীদারি কারবারের অবসান হবে।
ii. আইনের পরিপন্থী হলে (Illegality): অংশীদারি কারবার পরিচালনায় যদি কোনো অবৈধ ঘটনা ঘটে যায় এবং তাতে প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপ আইন বিরোধী বলে আখ্যায়িত হয় তাহলে কারবারের বিলোপ সাধন ঘটবে। (৪১ ধারা)।
৫। আদালতের নির্দেশ অনুসারে বিলোপ সাধন (Dissolution by the court )
১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৪৪ ধারা মোতাবেক কোনো অংশীদার এক বা তদুর্ধ অংশীদারের বিরুদ্ধে কোনো মোকাদ্দমা দায়ের করলে আদালত নিরে যেকোনো অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কারবার বিলোপ সাধনের নির্দেশ দিতে পারে—
i. কোনো অংশীদার উন্মাদ বা পাগল হলে;
ii.কোনো অংশীদার ইচ্ছাকৃতভাবে অংশীদারি কারবারের চুক্তি ক্রমাগত ভঙ্গ করলে;
iii. কোনো অংশীদার দেউলিয়া বলে প্রমাণিত হলে;
iv. কোনো অংশীদার তার অপরাধের জন্য দন্ড বা সাজাপ্রাপ্ত হয়ে থাকলে;
v. কোনো অংশীদার তৃতীয় পক্ষের নিকট বে-আইনীভাবে তার আংশিক বা সম্পূর্ণ স্বত্ব হস্তান্তর করে থাকলে;
vi. আদালত যদি এ মর্মে নিশ্চিত হয়ে থাকে যে, ক্রমাগতভাবে কারবারের শুধুই লোকসান হচ্ছে;
vii. এছাড়া যেকোনো কারণে আদালত যদি মনে করে যে, কারবার প্রতিষ্ঠানটির বিলোপ সাধনই হচ্ছে যথার্থ হবে; তবে অংশীদারি কারবারের বিলোপ সাধন ঘটবে। (ধারা-৪২ )
বাংলাদেশ ব্যবসা-বাণিজ্যে পশ্চাৎপদ একটি দেশ। বড় ধরনের শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য এখানে এখনও তেমন গড়ে ওঠেনি। বড় বড় শহরে বা তার আশপাশে কিছু বড় ধরনের ব্যবসায়-কোম্পানি সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠলেও গ্রাম-গঞ্জে, হাট-বাজারে এমন কি শহরের কেন্দ্রস্থলে একমালিকানা ব্যবসায়ের সংখ্যাই সর্বাধিক। অংশীদারি ব্যবসায়ের সংখ্যা সে বিচারে নেহায়েত নগণ্য: যা ৫% এর বেশি নয়। অথচ অংশীদারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ দেশের সর্বত্রই মাঝারি ধরনের ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তোলার যথেষ্ট সুযোগ ছিল ।
বাংলাদেশে অংশীদারি ব্যবসায় ব্যাপকতা লাভ করতে না পারার পিছনে যে সকল কারণ বিদ্যমান তা নিম্নে তুলে ধরা হলো-
১. ব্যবসায়িক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাব (Lack of business knowledge and experience): আমাদের দেশে যারা নতুন ব্যবসায়ে নামে তারা এ সম্পর্কে কার্যত তেমন কোনো জ্ঞান নিয়ে আসে না । যারা ব্যবসায়ে লিপ্ত তাদেরও অধিকাংশেরই এ বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার যথেষ্ট অভাব লক্ষ্য করা যায়। এ ধরনের ব্যক্তিবর্গ ক্ষুদ্র একমালিকানা ব্যবসায় গঠন করে পরিচালনায় যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে অংশীদারি ব্যবসায় গঠনে অনুরূপ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না ।
২. পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব (Lack of reciprocal trust and faith): আমাদের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবও প্রকট। অথচ অংশীদারি ব্যবসায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অংশীদারদের মধ্যকার পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস। অন্যদের ওপর আস্থা না থাকার কারণে অনেকেই এরূপ ব্যবসায় পছন্দ করে না ।
৩. সততার অভাব (Lack of honesty ): আমাদের দেশের অনেকের মধ্যে ব্যবসায়িক লেনদেনে সততার মারাত্মক অভাবও লক্ষণীয়। কথাবার্তায় আমরা যতটা সৎ কার্যক্ষেত্রে ততটা নয়। অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, অংশীদারি ব্যবসায় যে চালায় পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ের সকল সম্পত্তিকে সে নিজের ভাবে এবং অন্যদের ঠকানোর হীন চক্রান্তে লিপ্ত হয় ।
৪. মূলধনের সমস্যা (Problem of capital): আমাদের দেশে যারা অংশীদার হিসেবে এরূপ ব্যবসায়ে যোগদান করে তাদের প্রত্যেকেরই আর্থিক সামর্থ অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। ফলে ব্যবসায়ে প্রয়োজনীয় মূলধন যোগাড় করা যায় না। অংশীদারদের নানান মত এবং সৎ ও সামর্থবান বিনিয়োগকারীর অভাবেও নতুন অংশীদার গ্রহণ করে মূলধনের সংস্থান করাও অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব নয় ।
৫. আইনগত সহায়তার অভাব (Lack of legal assistance): আমাদের দেশে অংশীদারি ব্যবসায় পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আইনগত সহায়তা ও নিয়ন্ত্রণও কাম্যমানের নয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৌখিক চুক্তির মাধ্যমে এরূপ ব্যবসায় গঠন করা হয়। যার ফলে পরবর্তী সময়ে নানান সমস্যা দেখা দেয়।
৬. প্রাইভেট কোম্পানির ক্ষেত্রে শিথিল নিয়ম-কানুন ( Loose rules and regulation in case of private company): আমাদের দেশে কোম্পানি আইনে এর গঠন কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা হলেও তা এখনও তেমন যথেষ্ট নয়। কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে ক্ষেত্রবিশেষে সুবিধা লাভের সুযোগ থাকায় অনেকেই অংশীদারি ব্যবসায় গড়তে উৎসাহিত হয় না।
উপরিউক্ত সমস্যাদি ছাড়াও অংশীদারি ব্যবসায়ের যেসব সাধারণ অসুবিধা; যেমন-অংশীদারদের অসীম দায়, স্বাধীন সত্তার অভাব, মালিকানা হস্তান্তরে অসুবিধা, জনআস্থার অভাব, পরিচালনাগত জটিলতা ইত্যাদি সমস্যাও এখানে রয়েছে।
সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারায় সূচনা লগ্নে ব্যবসায়ের পরিসর ছিল অল্প ও সংকীর্ণ, তাই এর সাংগঠনিক রূপ ছিল সহজ, ছোট। যেমন—একমালিকানা, অংশীদারি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি হতে শুরু হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হলে শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। পূর্বেকার কায়িকশ্রমের স্থান দখল করে নেয় যন্ত্রপাতি এবং শুরু হয় বৃহদায়তন উৎপাদনের পালা । এমতাবস্থায় ব্যবসায় সংগঠনের প্রাথমিক রূপ তথা একমালিকানা ব্যবসায় এবং অংশীদারি ব্যবসায়ের পক্ষে এদের কতিপয় সীমাবদ্ধতার কারণে বৃহদায়তন পণ্যদ্রব্যাদির উৎপাদন ও বণ্টন কার্য পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলাতে যেয়ে অধিক মূলধন, সীমাবদ্ধ দায়, দক্ষ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা এবং চিরন্তন অস্তিত্বের সুবিধা নিয়ে যুগোপযোগী ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে যৌথ মূলধনী ব্যবসায়ের উদ্ভব ঘটে।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা জানতে পারব—
সূত্র: ক্যামব্রিয়ান পাবলিকেশন্স
মি. আজিম ও তার পাঁচ বন্ধু একটি কোম্পানির মালিক ও পরিচালক। সম্প্রতি বাজারে শেয়ার বিক্রয়ের জন্যে তারা প্রতিষ্ঠানটির গঠনগত কাঠামো পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ।
রিয়া কসমেটিকস লি. একটি সাবান উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, কিন্তু ২০% বাজার শেয়ার তাদের দখলে আছে। এমতাবস্থায় কেয়া কসমেটিকস লিমিটেড প্রতিষ্ঠানের ৫৫% শেয়ার কিনে নেয়।
প্রকৃতিগতভাবেই কোম্পানি সংগঠন একটি লাভজনক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। এর কৃত্রিম সত্তা, চিরন্তন অস্তিত্ব, নিজস্ব সীলমোহর, প্রভৃতি বিশেষ বৈশিষ্ট্য একে অন্য ব্যবসায় সংগঠন থেকে পৃথক করেছে। নি েকোম্পানি সংগঠনের প্রকৃতি সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়া হলো—
কোম্পানি হলো আইনসৃষ্ট একটি কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা বিশেষ প্রতিষ্ঠান। কোম্পানি আইন যৌথ মূলধনী কোম্পানিকে একজন ব্যক্তির মত স্বতন্ত্র সত্তা দান করেছে। কোম্পানির এই সত্তা আইনগতভাবে স্বীকৃত। এই সত্তা বলে এটি নিজ নামে সর্বত্র পরিচিত এবং এই সত্তা নিয়ে কোম্পানি ব্যবসায় পরিচালনা করতে পারে। যদিও কোম্পানির হাত-পা নেই, সে খেতে পারে না, ঘুমোতে পারে না তবু একে ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়, যাকে কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ আইনের চোখেই এটি একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি, যা অদৃশ্য ও অস্পর্শনীয়। তবে রক্তমাংসের গড়া মানুষ বা ব্যক্তি না হলেও কোম্পানি একজন ব্যক্তির মতোই নিজ নামে তৃতীয় পক্ষের সাথে যেকোন ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারে এবং অপরকেও চুক্তিতে আবদ্ধ করতে পারে। এটি নিজ নামে অন্যের বিরুদ্ধে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের এবং অপরেও কোম্পানির বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারে ।
আইনের দৃষ্টিতে কোম্পানি পৃথক ও চিরন্তন অস্তিত্বসম্পন্ন। কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তাই একে চিরন্তন অস্তিত্ব (Perpetual succession) দান করেছে। কোম্পানির সদস্যের অর্থাৎ মালিকের অস্তিত্বের সাথে এর অস্তিত্বের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কোন কারণে কোম্পানির সদস্য পদ পরিবর্তন কিংবা সকল সদস্যের মৃত্যু ঘটলেও কোম্পানির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় না। এ প্রসঙ্গে সলোমান বনাম সলোমান এন্ড কোং লিঃ-এর মামলার রায়ে বলা হয় যে, কোম্পানি এর সদস্যদের থেকে পৃথক এবং এর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিদ্যমান ।
বর্তমানে ব্যাপক প্রচলিত, জনপ্রিয় ও বৃহৎ পরিসরে কার্যকরী ব্যবসায় সংগঠন হলো কোম্পানি সংগঠন। সাধারণ অর্থে, কয়েকজন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যৌথভাবে মূলধন বিনিয়োগ করে দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় কোনো ব্যবসায় সংগঠন গঠন করলে তাকে কোম্পানি সংগঠন বলে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোম্পানি “কোম্পানি আইন ১৯৯৪” অনুসারে গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে । কোম্পানি নিজ নামের সীলমোহরের চিরন্তন অস্তিত্বের ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার অধিকারী হয়ে থাকে। তাই ব্যাপকভাবে বলা যায় যে, কোম্পানি হলো আইন সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তাবিশিষ্ট, চিরন্তন অস্তিত্বসম্পন্ন সীমিত দায়বিশিষ্ট এমন একটি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যেখানে কিছু লোক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যৌথভাবে মূলধন বিনিয়োগ করে।
১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২ (১) (ঘ) ধারা অনুযায়ী “কোম্পানি বলতে এ আইনের অধিনে গঠিত ও নিবন্ধিত কোম্পানি বা কোনো বিদ্যমান কোম্পানিকে বুঝায়।” ("Company means a company formed and registered under this Act of any existing.")
কোম্পানি সংগঠন বা কোম্পানি হলো আইন-সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তি সত্তার অধিকারী এমন এক ধরনের আধুনিক ও প্রচলিত ব্যবসায় সংগঠন যা অদৃশ্য, অস্পর্শনীয় অথচ চিরন্তন অস্তিত্বের অধিকারী যার নিজস্ব নাম সীল মোহর দ্বারা পরিচিত ও পরিচালিত হয়। এই সংগঠন স্বেচ্ছায় যৌথভাবে শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে মূলধন বিনিয়োগ করে এবং বিনিয়োগকৃত মূলধনের উপর মুনাফা ঘোষণা ও বণ্টন করে ।
বর্তমান বৃহদায়তন ব্যবসায়ের জগতে কোম্পানি সংগঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ব্যবসায় সংগঠন। এটি একটি আইন-সৃষ্ট যৌথ মালিকানার স্বেচ্ছামূলক ব্যবসায় সংগঠন, এর এমন বিশেষ কতকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে যা একে অন্যান্য ব্যবসায় সংগঠন থেকে পৃথক সত্তার অধিকারী করেছে। কোম্পানি সংগঠনের এ বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. জটিল গঠন পদ্ধতি (Complicated formation): যৌথ মূলধনী কোম্পানির গঠন পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট আইনানুগ আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়।
২. স্বেচ্ছামূলক সংস্থা (Voluntary association): যৌথ মূলধনী কোম্পানি একটি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ব্যবসায় সংস্থা। মুনাফার উদ্দেশ্যে কতিপয় ব্যক্তির স্বেচ্ছাকৃত প্রচেষ্টায় কোম্পানি গঠিত হয়ে থাকে । যে কেউ ইচ্ছা করলেই শেয়ার ক্রয় করার মাধ্যমে কোম্পানির মালিক হতে পারে, আবার কেউ ইচ্ছা করলেই শেয়ার হস্তান্তর করে সহজেই ব্যবসায় হতে বিদায় নিতে পারে ।
৩. বিপুল পুঁজি (Huge capital): বহু সংখ্যক ব্যক্তির সংগঠন বিধায় কোম্পানি তুলনামূলকভাবে অধিক মূলধন সংগ্রহ করতে পারে । এটি জনগণের নিকট শেয়ার বিক্রি করে প্রয়োজনীয় মূলধনের সংস্থান করে থাকে ।
৪. বৃহদায়তন ব্যবসায় সংগঠন (Large-scale enterprise): আধুনিক বৃহদায়তন ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে যৌথ মূলধনী কোম্পানি সমধিক পরিচিত। প্রচুর সদস্য সংখ্যা, ব্যাপক মূলধন সর্বক্ষেত্রেই কোম্পানি বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত।
৫. লভ্যাংশ বণ্টন (Distribution of dividend): যৌথ মূলধনী কোম্পানির অর্জিত মুনাফার একটা নির্দিষ্ট অংশ লভ্যাংশ হিসেবে শেয়ার মালিকদের মধ্যে শেয়ারের আনুপাতিক হারে বণ্টিত হয়ে থাকে । কোম্পানির সাধারণ সভার অনুমোদনক্রমে পরিচালকগণ এই লভ্যাংশের পরিমাণ ঘোষণা করেন ৷
৬. করারোপ (Taxation): কোম্পানির ওপর ধার্য করের হার সাধারণত অধিক হয়ে থাকে। এর অর্জিত মুনাফার ওপর করারোপ করা হয়। আবার শেয়ার মালিকদের প্রাপ্ত লভ্যাংশের উপর কর প্রদান করতে হয় ।
৭. বিলোপসাধন (Dissolution): যৌথ মূলধনী কোম্পানির গঠন যেমন আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ তেমনি এর বিলোপসাধনের ক্ষেত্রেও আনুষ্ঠানিকতা পালনের প্রয়োজন হয়। কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী এর বিলোপসাধন ঘটে। এ কারণে কোম্পানির সদস্য বা শেয়ারহোল্ডারগণ ইচ্ছা করলেই এর বিলোপসাধন করতে পারে না ।
৮. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা (Democratic management): যৌথ মূলধনী কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল স্তরে গণতান্ত্রিক নীতিমালা অনুসৃত হয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শেয়ারহোল্ডারগণের ভোটের মাধ্যমে কোম্পানির পরিচালকগণ নির্বাচিত হয়ে থাকে এবং তাদের দ্বারা কোম্পানি পরিচালিত হয়। এছাড়া ব্যবসায়ের উল্লেখযোগ্য নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও শেয়ারহোল্ডারগণের ভোটের ফলাফলের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে।
১. আইন-সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান (Law-created concern): কোম্পানি আইন দ্বারা এ প্রতিষ্ঠান সৃষ্ট হয়। বাংলাদেশে যৌথ মূলধনী কোম্পানিসমূহ ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন অনুযায়ী গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। উক্ত আইনের ২.১ (ঘ) ধারায় বলা হয়েছে যে, ”কোম্পানি বলতে এ আইনের অধীনে গঠিত এবং নিবন্ধনকৃত কোনো কোম্পানি বা কোনো বিদ্যমান কোম্পানিকে বোঝাবে।”
২. সদস্য সংখ্যা (Number of members) : কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী কোম্পানির সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে এর সদস্য সংখ্যা ন্যূনতম ২ এবং সর্বাধিক ৫০ জনে সীমাবদ্ধ থাকে এবং পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির বেলায় সর্বনি সদস্য সংখ্যা ৭ এবং সর্বোচ্চ সংখ্যা কোম্পানির সংঘ-স্মারকে উল্লিখিত শেয়ার সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে ।
৩. পৃথক ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা (Seperate and aritificial entity): কোম্পানি একটি স্বতন্ত্র কৃত্রিম ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। এ কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা এর সদস্যদের সত্তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আইন অনুযায়ী এটি কৃত্রিম ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা ভোগ করে থাকে। এই আইনগত সত্তাবলে কোম্পানি নিজ নামে অন্যের সাথে যেমনি লেনদেন করতে পারে তেমনি মোকদ্দমাও দায়ের করতে পারে।
৪. চিরন্তন অস্তিত্ব (Perpetual succession): আইনের দৃষ্টিতে কোম্পানি চিরন্তন অস্তিত্বের অধিকারী এক কৃত্রিম ব্যক্তি। কোম্পানির সদস্য বা শেয়ার মালিকদের অস্তিত্বের উপর এ অস্তিত্ব নির্ভর করে না। কোম্পানির মালিকানা বা সদস্য পদের পরিবর্তনে এর অস্তিত্ব বিপন্ন হয় না। কেবল কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী কোম্পানির বিলোপসাধন করা হলেই এর অস্তিত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে থাকে।
৫. সীমিত দায় (Limited liability): কোম্পানির সদস্য বা শেয়ারহোল্ডারদের দায় সীমিত। একজন সদস্য যে পরিমাণ অর্থের শেয়ার কিনবে ঠিক সে পরিমাণ অর্থের জন্যই তাকে দায়ী করা যেতে পারে-এর বেশি নয়। অর্থাৎ এর সদস্যদের দায় তাদের ক্রয়কৃত শেয়ারের মোট মূল্য পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে।
৬. বাধ্যতামূলক নিবন্ধন (Compulsory registration ) : যৌথ মূলধনী কোম্পানির নিবন্ধন আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক। কোম্পানি আইন অনুসারে যৌথ মূলধনী কোম্পানিকে অবশ্যই নিবন্ধিত হতে হবে। নিবন্ধন ব্যতীত কোনো কোম্পানি গঠিত এবং পরিচালিত হতে পারে না ।
৭. সাধারণ সীলমোহর (Common seal): প্রতিটি কোম্পানির নিজস্ব নামাঙ্কিত একটি সাধারণ সীলমোহর থাকে। কোম্পানির যাবতীয় দলিল-দস্তাবেজ ও কাগজপত্রে এ সীলমোহর ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। এ সীলমোহরের মাধ্যমেই যৌথ মূলধনী কোম্পানি স্বতন্ত্র ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা নিয়ে জনসাধারণের নিকট পরিচিতি লাভ করে ।
৮. শেয়ারের হস্তান্তরযোগ্যতা (Transferability of shares): যৌথ মূলধনী কোম্পানির শেয়ারগুলো অবাধে হস্তান্তরযোগ্য। শেয়ারের হস্তান্তরের সাথে সাথে কোম্পানির মালিকানায়ও পরিবর্তন সূচিত হয়। অর্থাৎ শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে শেয়ার ক্রয়কারী কোম্পানির মালিক হন ।
পরিশেষে বলা যায় যে, কোম্পানি সংগঠন আইন-সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার অধিকারী বৃহদায়তন প্রকৃতির ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। যা কোম্পানি আইন এবং নিজস্ব স্মারকলিপি ও পরিমেল নিয়মাবলির আওতায় একটি স্বতন্ত্র ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে গঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে ।
একদিকে ব্যবসায় জগতে ব্যাপক উন্নয়ন অন্যদিকে একমালিকানা ও অংশীদারি ব্যবসায়ের সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার কারণে নতুন সংগঠন কাঠামো কোম্পানি সংগঠনের উৎপত্তি ঘটে, পরবর্তী সময়ে ব্যবসায় জগতে আরো ব্যাপক উন্নয়নের ফলে এর ব্যবসায়ের গতি প্রকৃতিতেও পরিবর্তন সূচিত হয়। যার ফলে কোম্পানির ধরনেও পার্থক্য ঘটে । নিম্নে কোম্পানির প্রকারভেদ বিস্তারিত আলোচিত হলো—
সদস্যদের দায়ের প্রকৃতি অনুসারে এরূপ শ্রেণীবিন্যাস করা হয়। দায়-এর প্রকৃতি অনুযায়ী কোম্পানি তিন প্রকার হতে পারে। যথা—
১. শেয়ার দ্বারা সীমাবদ্ধ দায়বিশিষ্ট কোম্পানি (Companies limited by share): যে কোম্পানিতে সদস্যগণের দায় শেয়ারের আংকিক মূল্য পর্যন্ত সীমিত থাকে, তাকে শেয়ার দ্বারা সীমাবদ্ধ দায়বিশিষ্ট কোম্পানি বলে । যেমন-প্রাইভেট লিমিটেড ও পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি।
২. প্রতিশ্রুতি দ্বারা সীমাবদ্ধ দায়সম্পন্ন কোম্পানি (Companies limited by guarantee): যেসব কোম্পানিতে সদস্যগণ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পর্যন্ত দায় পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়, তাদের প্রতিশ্রুতি দ্বারা সীমাবদ্ধ দায়সম্পন্ন কোম্পানি বলে। এরূপ কোম্পানিতে যে সব সদস্য শেয়ার দ্বারা প্রতিশ্রুতি দায় বহন করে, শেয়ারের অপরিশোধিত মূল্য পর্যন্ত তাদের দায় থাকে। শেয়ারমূল্য পরিশোধিত হয়ে গেলে তারা দায়মুক্ত। আর্থিক মূল্য দ্বারা প্রতিশ্রুতি দায়সম্পন্ন সদস্যগণ ঐ পরিমাণ অর্থ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত দায়বদ্ধ থাকেন। সাধারণত অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এ ধরনের প্রতিশ্রুত কোম্পানি গঠিত হয় ।
যেসব কোম্পানিতে সদস্যগণের দায় অসীম হয়, তাদের অসীম দায়সম্পন্ন কোম্পানি বলে। এসব কোম্পানিতে সৃষ্ট দায়ের জন্য কোম্পানির সম্পত্তি ছাড়াও শেয়ারহোল্ডারগণের ব্যক্তিগত সম্পত্তি দায়বদ্ধ হয়। বর্তমানে এ ধরনের কোম্পানি নেই বললেই চলে ।
গঠন প্রকৃতির উপর নির্ভর করে কোম্পানিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়—
১. সনদপ্রাপ্ত কোম্পানি (Chartered company): রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজা বা রানীর বিশেষ আদেশ বলে এ ধরনের কোম্পানি গঠিত হয়। বিশেষ করে কোম্পানি আইন চালু হওয়ার পূর্বে এ ধরনের কোম্পানি গঠিত হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, দি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, দি চার্টার্ড ব্যাংক অব অস্ট্রেলিয়া- এ ধরনের কোম্পানির উদাহরণ। বর্তমানে এখন আর এরূপ কোম্পানি সংগঠন দৃষ্টিগোচর হয় না ।
২. বিধিবদ্ধ কোম্পানি (Statutory company) :
যখন দেশের আইন পরিষদ বা পার্লামেন্টে বিশেষ আইনের মাধ্যমে কোনো কোম্পানি গঠিত হয়, তখন তাকে বিধিবদ্ধ কোম্পানি বলে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া প্রভৃতি এরূপ কোম্পানি ।
৩. নিবন্ধিত কোম্পানি (Registered company) : যেসব কোম্পানি নিবন্ধকের অফিসে তালিকভুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়, সেগুলোকে নিবন্ধিত কোম্পানি বলে। বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ কোম্পানিই নিবন্ধিত কোম্পানি ।
সদস্য সংখ্যার উপর ভিত্তি করে কোম্পানিকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করা হয়—
১. প্রাইভেট লিঃ কোম্পানি (Private ltd. company): আধুনিক বৃহদায়তন ব্যবসায় জগতে স্বাধীন সত্তা ও সীমিত দায় বিশিষ্ট ছোট ধরনের কোম্পানি সংগঠন হল প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। এটি নিজ নামেই সর্বসাধারণ্যে পরিচিত। সাধারণত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব মিলে সীমিত দায়ের ভিত্তিতে যে কোম্পানি গঠিত ও পরিচালিত হয় তাকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলে ।
বস্তুত যে কোম্পানির সদস্য সংখ্যা সর্বনিম্ন দু'জন এবং সর্বোচ্চ পঞ্চাশ জনে সীমাবদ্ধ এবং যার শেয়ার অবাধে হস্তান্তরযোগ্য নয়, তাকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলে ।
১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২(১) (ট) ধারায় বলা হয়েছে যে,“প্রাইভেট লিমিটেড” বলতে এমন কোম্পানিকে বুঝাবে যা এর পরিমেল নিয়মাবলি দ্বারা—
ক. কোম্পানির শেয়ার যদি থাকে, হস্তান্তরের অধিকারে বাধানিষেধ আরোপ করে ।
খ. কোম্পানির শেয়ারে বা ডিবেঞ্চারে (যদি থাকে) চাঁদা দানের নিমিত্ত (Subscription) জনসাধারণের প্রতি আমন্ত্রণ জানানো নিষিদ্ধ করে।
গ. এর সদস্য সংখ্যা কোম্পানির চাকরিতে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ ব্যতীত পঞ্চাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। সদস্য সংখ্যা সীমিত বলে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রায়তনের হয়ে থাকে। কোম্পানি আইন অনুযায়ী এই কোম্পানির গঠন থেকে শুরু করে পরিচালনার বিভিন্ন স্তরে আইনগত ঝামেলা অনেকটা কম । আইন অনুযায়ী এটা স্বাধীন কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা ভোগ করে এবং শেয়ারহোল্ডারদেও দায় সীমাবদ্ধ থাকে ।
সুতরাং, প্রচলিত কোম্পানি আইনের অধীনে নিবন্ধিত হয়ে যে কোম্পানি কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা লাভ করলেও পরিমেল নিয়মাবলি অনুযায়ী ৫০ জনের অধিক সদস্য গ্রহণ করতে পারে না, জনসাধারণের উদ্দেশ্যে শেয়ার বিক্রয়ের আহবান জানাতে পারে না এবং শেয়ার মালিকগণ অবাধে শেয়ার হস্তান্তরের সুবিধা ভোগ করে না তাকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলে ।
২. পাবলিক লিঃ কোম্পানি (Public ltd. company): মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে কমপক্ষে ৭ (সাত) জন এবং সর্বোচ্চ যেকোন সংখ্যক (শেয়ার সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ) সদস্য স্বেচ্ছায় সীমিত দায়ের ভিত্তিতে শেয়ার হস্তান্তরের অধিকার নিয়ে কৃত্রিম সত্তাবিশিষ্ট যে প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়, তাকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি বলে। এই সংগঠনের মূলধন কতকগুলো খন্ড খন্ড শেয়ারে বিভক্ত এবং শেয়ারগুলো অবাধে হস্তান্তরযোগ্য। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ আলাদা। কোম্পানির নির্বাচিত পরিচালক পর্ষদ দ্বারা এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কার্য পরিচালিত হয়। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি নিবন্ধিত হবার পর কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করে তার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে শুরু করে। বাংলাদেশের পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির আইনগত সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো:
১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২(১-ঞ) ধারায় বলা হয়েছে যে, “পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি বলতে প্রাইভেট কোম্পানি নয় এমন কোম্পানি বোঝায়, যা কোম্পানি আইন ১৯৯৪ সাল বা কোম্পানি আইন ১৯১৩ বা ১৮৮২ অথবা কোম্পানি আইন ১৮৮৬ অথবা এতদ্বারা বাতিলকৃত অন্য কোন আইন অনুযায়ী নিবন্ধিত হয়েছে।”
পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি সর্বাপেক্ষা বেশি জনপ্রিয়। মুনাফা অর্জনের নিমিত্তে বহু সংখ্যক ব্যক্তির ক্রীত শেয়ারের ভিত্তিতে কোম্পানি আইন অনুযায়ী এই কোম্পানি গঠিত ও পরিচালিত হয়।
মালিকানার ভিত্তিতে কোম্পানি দু'রকম হতে পারে। যেমন—
১. সরকারি কোম্পানি (Government company): যেসব কোম্পানি সাধারণত সরকারি মালিকানায় গঠিত হয়, অথবা কোম্পানিতে কমপক্ষে ৫১% শেয়ারের মালিকানা সরকারের থাকে তাকে সরকারি কোম্পানি বলে ।
২. বেসরকারি কোম্পানি (Non-government company): যেসবকোম্পানি বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত হয় সেগুলোকে বেসরকারি কোম্পানি বলে ।
১. হোল্ডিং কোম্পানি (Holding Company): কোন কোম্পানি গঠন বা ক্রয়সূত্রে অন্য কোম্পানি নিয়ন্ত্রণের অধিকাংশ ক্ষমতা পেলে তাকে হোল্ডিং কোম্পানি বা নিয়ন্ত্রণকারী কোম্পানি বলে। এরূপ কোম্পানি নিয়ন্ত্রণকৃত কোম্পানির ৫০%-এর অধিক শেয়ারের মালিক এবং অধিকাংশ পরিচালক নিয়োগ ও অপসারণ ক্ষমতা ভোগ করে।
হোল্ডিং কোম্পানির বৈশিষ্ট্য হলো—
ক. কোন কোম্পানির শেয়ার মূলধনের ৫০% এর বেশি সরবরাহকারী;
খ. সাবসিডিয়ারি কোম্পানির অধিকাংশ পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা এ কোম্পানির উপর ন্যস্ত থাকে;
গ. অধীনস্থ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিষদ নির্বাচনের দায়িত্বও এ কোম্পানি বেশিরভাগই ভোগ করে;
ঘ. পরিচালকদের পদচ্যুতি বা অবসরদানের ক্ষমতাও এর উপর ন্যস্ত থাকে;
ঙ. এ কোম্পানির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থেকে অধীনস্থ কোম্পানিটি পরিচালিত হয়; ইত্যাদি।
২. সাবসিডিয়ারি কোম্পানি (Subsidiary company): যেসব কোম্পানির ৫০% -এর অধিক শেয়ারের মালিক অন্য কোম্পানি তাকে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বলে। অর্ধেকের বেশি মূলধন সরবরাহকারী কোম্পানি এরূপ কোম্পানির পুরো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকে। নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিকে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বলা হয় ।
৩. বিদেশি কোম্পানি (Foreign company): যে কোম্পানি দেশের বাইরে গঠিত হয়ে, কোনো নির্দিষ্ট দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তাকে বিদেশি কোম্পানি বলে ।
৪. বহুজাতিক কোম্পানি (Multinational company):
যে কোম্পানির মালিকানা, ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ন্ত্রণে একাধিক দেশের অধিবাসী অন্তর্ভুক্ত থাকে তাকে বহুজাতিক কোম্পানি বলে। যেমন—ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড, নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড ইত্যাদি। পরিশেষে বলা যায় যে, কোম্পানি সংগঠন বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। ব্যবহারের বৈচিত্র্য, উদ্দেশ্যের ভিন্নতা কিংবা সময়ের ভিত্তিতে কোম্পানির বিচিত্রতা প্রসারিত হয়েছে।
কোম্পানি কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা বিশিষ্ট ব্যবসায় সংগঠন। এই বৃহত্তম ব্যবসায় সংগঠনটি অন্যান্য সংগঠন থেকে বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে । বর্তমান ব্যবসায় ও শিক্ষাকর্মের ব্যাপক প্রসারের মূলে রয়েছে যৌথ মূলধনী ব্যবসায়ের অনন্য অবদান । নি েএসমস্ত সুবিধাসমূহ বর্ণনা করা হলো—
১. পর্যাপ্ত মূলধন সংগ্রহ (Enormous capital): কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের মূল্য হয় কম। কম মূল্যে অধিক সংখ্যক শেয়ার বিক্রি করে মূলধন সংগ্রহ করা সহজ হয়। এতে অল্প সঞ্চয়কারীদের নিকট থেকে মূলধন সংগ্রহ করা সুবিধাজনক এবং কোম্পানির মূলধনের পরিমাণও অধিক হয় ।
২. বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান (Establishment of large scale business) : বৃহদায়তন ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনায় কোম্পানি সবচেয়ে উপযোগী সংগঠন। বিপুল পরিমাণ শেয়ার ও ঋণপত্র বিক্রয় এবং দক্ষ ব্যবস্থাপক নিয়োগ করে সহজেই কোম্পানি এ ধরনের ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করতে পারে ।
৩. উত্তম বিনিয়োগ ক্ষেত্র (Proper Investment Field): কোম্পানি সংগঠন সারা বিশ্বেই উত্তম বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। শেয়ারের মূল্যমান কম হওয়ায় সকল ধরনের মানুষ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর শেয়ার কিনে বিনিয়োগ করতে পারে। লভ্যাংশ ছাড়াও শেয়ারের মূল্যমান বৃদ্ধি, রাইট শেয়ার প্রাপ্তি ইত্যাদি সুবিধা থাকায় তা সবার নিকট আরও অধিক আকর্ষনীয় ।
৪. ঝুঁকি বণ্টনের সুযোগ সৃষ্টি (Creating Facilities of Risk Distribution): একক মালিকানা বা অংশীদারিরভিত্তিতে কখনোই বড় ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ খাতে অর্থ বিনিয়োগ সম্ভব হয় না। অথচ কোম্পানি সংগঠনে ঝুঁকি বণ্টনের সুযোগ থাকায় এতে অর্থ বিনিয়োগের সহজ সুযোগ সৃষ্টি হয়। কোম্পানি যত বড় হয় বিক্রিত শেয়ারের সংখ্যাও ততই বৃদ্ধি পায়। ঝুঁকিও ততো বেশি বণ্টনের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে ।
৫. দক্ষ পরিচালনা (Efficient management): এ ধরনের কোম্পানি পরিচালনার ভার পরিচালকমণ্ডলীর উপর ন্যস্ত থাকে। পরিচালকমণ্ডলী গঠিত হয় দক্ষ পরিচালকগণ দ্বারা। অবশ্য পরিচালকমণ্ডলী পরিবর্তনযোগ্য। অর্থাৎ প্রয়োজনে পুরাতন পরিচালকমণ্ডলীকে পরিবর্তন করে দক্ষ পরিচালক নিযুক্ত করা যায় ।
৬. গণতান্ত্রিক পরিচালনা (Democratic management): এ ধরনের কোম্পানি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোম্পানির সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা পরিচালিত হয় বলে এর ব্যবস্থাপনা গণতান্ত্রিক ।
৭. জনগণের আস্থা (Public confidence): কোম্পানির গঠন, পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ আইন দ্বারা নির্ধারণ হয় বলে এতে আইনের বাধ্যবাধকতাও বেশি থাকে। ফলে ব্যবসায়ের উপর জনসাধারণের আস্থা বৃদ্ধি পায় এবং বিনিয়োগকারীগণ নির্ভয়ে তাদের অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে।
৮. আন্তর্জাতিক সুনাম (International goodwill) : বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি শুধু যে দেশের মধ্যে জনসাধারণের আস্থা অর্জন করে তা নয়, বরং দেশের বাহিরেও এদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের ব্যবসায়িক কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়ে। এক কথায় বলা যায় বৈদেশিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যৌথমূলধনী কোম্পানিই হলো একমাত্র উপযুক্ত ব্যবসায় সংগঠন।
৯. গবেষণা (Research): নতুন উৎপাদনের কৌশল আবিস্কার, উৎপাদন-ব্যয় হ্রাস ইত্যাদির উদ্দেশ্যে কোম্পানি গবেষণা কার্যে অর্থ ব্যয় করতে পারে যা একমালিকানা বা অংশীদারি ব্যবসায় সম্ভব নয়।
১০. করের সুবিধা (Tax relief): অন্যান্য ব্যবসায় সংগঠনের করের হার অপেক্ষা কোম্পানির করের হার কম। অপরদিকে নতুন কোম্পানিগুলো কিছুদিন পর্যন্ত কর প্রদান থেকে রেহাই পায়।
পরিশেষে বলা যায়, উপরিউক্ত সুবিধাদি ছাড়াও এ ব্যবসায় হতে সমাজ, সরকার তথা দেশের সকল জনগণই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। এ কারণে বর্তমানে এরূপ ব্যবসায় গঠনে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় ।
১. সীমিত দায়ঃ যৌথ মূলধনী কোম্পানির শেয়ারের আঙ্কিক মূল্য (Face value) অথবা প্রতিশ্রুতি দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে । ফলে জনগণ বিনাদ্বিধায় ও সংগঠনে বিনিয়োগ করে ।
২. অধিক পুঁজি: এ সংস্থা জনগণের নিকট শেয়ার বিক্রি করে পর্যাপ্ত পুঁজি সংগ্রহ করতে পারে। এমনকি প্রয়োজনে ঋণপত্র বিক্রির মাধ্যমেও মূলধন সংগ্রহ করা যায়, যা অন্যান্য সংগঠনগুলো পারে না।
৩. চিরন্তন অস্তিত্বঃ আইনের সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা একে চিরন্তন অস্তিত্ব প্রদান করেছে। ফলে এর স্থায়িত্ব অধিক। এমনকি ঘটনাক্রমে কোম্পানির সকল সদদ্যের মৃত্যু হলেও সংস্থা বিলুপ্ত হয় না। অর্থাৎ এটা নির্দিষ্ট আইনের দ্বারা গঠিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে এর বিশেষ আইনগত সার্বজনীন সত্তা আছে। যা ব্যবসায়ের উন্নতির সহায়ক ।
৪. গণতান্ত্রিকতা: এটা আইনের আওতায় সার্বিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়।
৫. জনসাধারণের আস্থা: নির্দিষ্ট আইনের দ্বারা এ সংস্থা গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় বলে এটা জনগণের অধিক আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়। ফলে বিনিয়োগকারীগণ নিশ্চিন্তে এ সংগঠনে বিনিয়োগ করে এবং কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার কারণে কোম্পানি অধিক ঋণের সুবিধা ভোগ করে।
৬. অধিক উৎপাদনঃ বৃহদায়তনের কারণে এ সংগঠন ব্যাপক উৎপাদন করতে পারে এবং জনগণ কমমূল্যে পণ্যক্রয়ের সুযোগ পায় ।
৭. কর্মসংস্থানের সুযোগঃ অন্য যে কোনো ব্যবসায়ের তুলনায় বৃহদায়তনের কোম্পানিতে জনগণের কর্মের সুযোগ-সুবিধা বেশি। ফলে জনগণের অধিক কর্মসংস্থান করে যৌথ মূলধনী কোম্পানি দেশের বেকারত্ব দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কোম্পানি সংগঠন হলো আইন-সৃষ্ট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান যা কোম্পানি আইনের নির্ধারিত পন্থায় গঠিত ও পরিচালিত হয়। পাবলিক ও প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি উভয় “কোম্পানি আইন ১৯৯৪” অনুসারে গঠিত ও পরিচালিত হয়। কোম্পানি গঠনে বিভিন্ন পর্যায়ে কতকগুলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ বা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে ।
নিম্নে এ আইন অনুযায়ী কোম্পানি আইনের পদক্ষেপ/পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো-
একাধিক ব্যক্তি কোম্পানি গঠনের লক্ষ্যে সর্বপ্রথম উদ্যোগী হন । কোম্পানি গঠনের জন্য পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৭ জন এবং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২ জন উদ্যোক্তার প্রয়োজন হয়। ব্যবসায়ের সম্ভাবনা, সাফল্য ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে তারা কোম্পানি গঠনের প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ।
এ ব্যক্তিবর্গ বা প্রবর্তকগণ এ পর্যায়ে নিম্নোক্ত কাজ সম্পাদন করেন:
ক. প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ
খ. নামের ছাড়পত্র সংগ্রহ
Documents Preparation Stage পরিকল্পনা তৈরির পর উদ্যোক্তাগণ কোম্পানির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিম্নোক্ত দুটি দলিল প্ৰণয়ন করেন—
ক. স্মারকলিপি/সংঘস্মারক বা পরিমেলবদ্ধ (Memorandum of Association): এটি কোম্পানির মূল দলিল বা সনদ। এ দলিলে কোম্পানির নাম, কোম্পানির নিবন্ধিত অফিসের ঠিকানা, কোম্পানির মূল লক্ষ্যসমূহ, শেয়ার, মূলধনের পরিমাণ, শেয়ারের আংকিক মূল্যসহ মূলধনের বিভক্তি এবং এটি প্রাইভেট লিমিটেড না-কি পাবলিক লিমিটেড তা উল্লেখ করা অবশ্যক ।
খ. সংঘবিধি বা পরিমেল নিয়মাবলি (Articles of association): এ দলিলে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ পরিচালনা সংক্রান্ত নিয়ম-পদ্ধতি লেখা হয়। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি আইনে বর্ণিত তফসিল-১ কে সংঘবিধি হিসেবে গ্রহণ করলে সেক্ষেত্রে তাকে আর এ দলিল তৈরি করতে হয় না ।
এ পর্যায়ে প্রবর্তকগণ কোম্পানি নিবন্ধকের অফিস হতে প্রয়োজনীয় ফরম সংগ্রহ করন এবং তা পূরণপূর্বক দলিলপত্র সন্নিবেশিত করে নিবন্ধকের নিকট জমা দেন। অবশ্য জমাদানের সময় মূলধন অনুপাতে প্রয়োজনীয় স্ট্যাম্প ও ফি এর সাথে দাখিল করতে হয়।
আবেদনপত্রের সাথে নিম্নোক্ত দলিল ও কাগজপত্র জমা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে—
ক. কোম্পানির স্মারকলিপির তিন কপি ;
খ. সংঘবিধির তিন কপি; অবশ্য পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি তফসিল-১ কে সংঘবিধি হিসেবে গ্রহণ করলে এ মর্মে ঘোষণাপত্রের কপি;
গ. উদ্যোক্তা পরিচালকদের নাম, ঠিকানা ও পেশা;
ঘ. উদ্যোক্তা পরিচালকেরা নিজ স্বাক্ষরযুক্ত দায়িত্বপালনের সম্মতিপত্র; ঙ. উদ্যোক্তা পরিচালকগণ যোগ্যতাসূচক শেয়ার ক্রয়ে সম্মত আছেন এ মর্মে একটি চুক্তিপত্র ও
চ. হাইকোর্টের উকিল অথবা সংঘবিধিতে উল্লেখ কোনো পরিচালক বা সচিব পদের অধিকারী ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত যথার্থতার ঘোষণাপত্র ।
উপরোক্ত সবকিছু ঠিকভাবে পেয়ে নিবন্ধক নিবন্ধন বইতে কোম্পানির নাম তালিকাভুক্ত করেন এবং প্রবর্তকদের নিবন্ধনপত্র (Certificate of Incorporation) এবং চাইলে প্রত্যায়িত স্বারকলিপি ও সংঘবিধির কপি প্রদান করেন। এর পরই প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি কাজ শুরু করতে পারে কিন্তু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে কাজ শুরু করার জন্য নিবন্ধকের নিকট হতে কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয় ।
পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র পাওয়ার জন্য ন্যূনতম চাঁদা (Minimum Subscription) সংগ্রহের ঘোষণাপত্র এবং জনসাধারণের নিকট শেয়ার বিক্রয়ের ঘোষণাপত্রসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রসহ আবেদন করতে হয়। সব কাগজপত্র ঠিক থাকলে এবং সন্তুষ্ট হলে নিবন্ধক পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র প্রদান করেন। এ পত্র পাওয়ার পরেই পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ব্যবসায় শুরু করতে পারে।
স্মারকলিপি হলো কোম্পানির মূল দলিল, সনদ বা সংবিধান। এতে কোম্পানির মূল বিষয়াবলি; যেমন-নাম, ঠিকানা, উদ্দেশ্য, মূলধন, দায় ও সম্মতির বিষয় লিপিবদ্ধ থাকে। এটা কোম্পানির কার্যক্ষেত্র ও ক্ষমতার সীমা নির্দেশ করে । এতে অন্তর্ভূক্ত নেই এমন কোনো কাজ কোম্পানী সম্পাদন করতে পারে না।
কোম্পানি আইনের ৬ ধারায় শেয়ার দ্বারা সীমাবদ্ধ কোম্পানির ৭ ধারায় প্রতিশ্রুতি দ্বারা সীমাবদ্ধ কোম্পানির এবং ৮ ধারায় অসীম দায় কোম্পানির স্মারকলিপির বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলা হয়েছে।
নিম্নে স্মারকলিপির ধারাসমূহ উল্লেখ করা হলো-
১. নাম ধারা (Name Clause) : কোম্পানির নাম এবং নামের শেষে পাবলিক কোম্পানির ক্ষেত্রে ‘লিমিটেড’ এবং প্রাইভেট কোম্পানির ক্ষেত্রে ‘প্রাইভেট লিমিটেড' -এ শব্দগুলো যোগ করতে হবে। কোম্পানির যেকোনো নাম রাখা যেতে পারে ।
তবে নাম গ্রহণের ক্ষেত্রে অত্র আইনের ১১ ধারায় বর্ণিত নিম্নেক্ত বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়—
i) একটি বিদ্যমান কোম্পানি ইতোপূর্বে যে নামে নিবন্ধিত হয়ে উক্ত নামেই বহাল আছে অথবা যে নামের সাথে প্রস্তাবিত নামের এমন সাদৃশ্য থাকে যে, উক্ত সাদৃশ্যের ফলে প্রতারণা করা সম্ভব।
ii) সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপনের দ্বারা অনভিপ্রেত বলে ঘোষণা করেছে; এমন কোনো নাম সরকারের লিখিত পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে গ্রহণ করা যাবে না ।
iii) জাতিসংঘ বা জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত এর কোনো সহায়ক সংস্থা অথবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নাম বা ঐসব নামের শব্দ সংক্ষেপ সংবলিত কোনো নাম, জাতিসংঘ বা এর সহায়ক সংস্থার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্ষেত্রে এর ডাইরেক্টর জেনারেলের লিখিত পূর্ব অনুমতি ব্যতীত
ব্যবহার করা যাবে না।
২. অবস্থান ও ঠিকানা ধারা (Situation and Address Clause): কোম্পানির নিবন্ধিত কার্যালয় যে অঞ্চলে অবস্থিত থাকবে সে স্থানের নাম। এর সাথে কোম্পানি কোন কোন এলাকায় এর কার্যাবলি বিস্তৃত করবে তাও বর্ণিত থাকবে ।
৩. উদ্দেশ্য ধারা (Objective Clause): কোম্পানি কি ধরনের ব্যবসায়ে লিপ্ত থাকবে তা এ ধারায় বিস্তৃতভাবে লিপিবদ্ধ থাকবে। এ উদ্দেশ্যের বাইরে কোনো ব্যবসায় করা যায় না। এ ধারা একদিকে কোম্পানির ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়িত করে এবং অন্যদিকে কোম্পানি প্রদত্ত ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে। উক্ত ধারায় কোম্পানির সম্ভাব্য ক্ষেত্রসমূহের বর্ণনা থাকে এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে কী কী ব্যবসায় করতে পারবে তাও বিশদভাবে বর্ণিত থাকে ।
৪. দায় ধারা (Liability Clause): কোম্পানির সদস্যদের দায় তাদের ক্রয়কৃত শেয়ারের আংকিক মূল্য (Face value) দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। শেয়ারের অপরিশোধিত মূল্যের জন্য কেবল শেয়ারহোল্ডারদেরকে দায়ী করা যাবে এবং শেয়ারের মূল্য সম্পূর্ণরূপে পরিশোধ করলে তারা সম্পূর্ণ দায়মুক্ত হবেন।
৫. মূলধন ধারা (Capital Clause): প্রস্তাবিত মোট মূলধনের পরিমাণ এবং মূলধন কতকগুলো এবং কী প্রকারের শেয়ারে বিভক্ত থাকবে তা এ ধারায় উল্লেখ থাকে। কোম্পানির এ মূলধনকে নিবন্ধিত বা অনুমোদিত মূলধন বলা হয়। এর অতিরিক্ত মূলধন কোম্পানি সংগ্রহ করতে পারে না ।
৬. সম্মতি ধারা (Consent Clause): স্মারকলিপির শেষ অংশে প্রত্যেক সদস্য তাঁর নামের বিপরীতে কতগুলো শেয়ার ক্রয় করবেন তার সম্মতি ধারা সম্পর্কে নিরূপ বিধান বর্ণিত হয়েছে—
i. সংঘ-স্মারকে স্বাক্ষর প্রদানকারী প্রত্যেক সদস্যকে কমপক্ষে একটি শেয়ার ক্রয় করতে হবে । [ ধারা ৬ (খ)]
ii. প্রত্যেক স্বাক্ষরকারী সদস্যকে তার নামের বিপরীতে ক্রয়কৃত শেয়ারের পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে । [ধারা ৬ (গ)]
iii. প্রত্যেক স্বাক্ষরকারী সদস্য অন্ততঃপক্ষে দু'জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর প্রদান করবেন এবং উক্ত স্বাক্ষর সাক্ষী কর্তৃক সত্যায়িত হতে হবে। [ধারা ৯(গ)
পরিশেষে বলা যায়, উপযুক্ত ধারাসমূহ বর্ণিত সকল ধরনের কোম্পানিকে সর্বদা অনুসরণ করতে হয়। এর কোনো একটি শর্ত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অনুমোদন ও বিশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ক্ষেত্র বিশেষে আদালত ও সরকারের অনুমোদন গ্রহণ করতে হয়।
একটা দেশের জন্য তার সংবিধানের আইনগত মর্যাদা যেমন একটা কোম্পানির জন্য তার সংঘস্মারকের মর্যাদাও ঠিক অনুরূপ বললেও অত্যুক্তি হয় না। সংঘস্মারকের গুরুত্ব বা আইনগত তাৎপর্যকে নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে :
১. ক্ষমতার নির্দেশ (Indication of power): স্মারকলিপি কোম্পানির কার্যক্ষমতার সীমা নির্দেশ করে। এরূপ দলিলের উদ্দেশ্য ধারায় বর্ণিত কাজ বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক কাজ কোম্পানি করতে পারে। এর বাইরে কোনো কাজ করা হলে তা ক্ষমতা বহির্ভুত কাজ বিবেচিত হয়।
২. সম্পর্ক নির্দেশ (Indication of relationship): সংঘস্মারকের শর্তগুলি দ্বারা কোম্পানি ও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে একটি চুক্তি বা আইনগত বন্ধনের সৃষ্টি হয় । অর্থাৎ কোম্পানি ও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যকার সম্পর্ক এর দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে । কোম্পানিতে তাদের অধিকার এবং দায়ও এর মাধ্যমে নিরূপিত হয় ।
৩. যথানিয়মে পরিবর্তন আবশ্যক (Necessary to change at law): আইনে উল্লেখিত কারণ ব্যতিরেকে এবং আইন মাফিক আনুষ্ঠানিকতা পালন না করে শেয়ারহোল্ডারদের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্তের দ্বারা সংঘস্মারক পরিবর্তন করা যায় না । অর্থাৎ এরূপ দলিল যথানিয়মে পরিবর্তন আবশ্যক ।
৪. ক্ষমতা বহির্ভূত কাজের দায় (Liability for ultra vires activites): কোম্পানির পরিচালকরা যদি স্মারকলিপির ক্ষমতা বহির্ভুত কোনো কার্য করে তবে তার জন্য ক্ষেত্রবিশেষে তারা কোম্পানির বা তৃতীয় পক্ষের নিকট দায়ী থাকে।
৫. সংঘস্মারকের অগ্রগণ্যতা (Primacy of memorandum of asociation): সংঘস্মারক ও সংঘবিধির মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে শেয়ারহোল্ডাররা সংঘবিধি সংশোধন করে উক্ত কার্য অনুমোদন করতে পারে। কিন্তু সংঘস্মারক বহাল থাকে। অর্থাৎ এরূপ দলিল সবসময়ই মুখ্য বিবেচিত হয়।
৬. প্রকাশ্য দলিল (Exressed document): সংঘস্মারক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ্য দলিল। সুতরাং কোম্পানির সাথে লেনদেনে সকল পক্ষ তা অবগত আছে বলে ধরা হয়। এরূপ দলিল সম্পর্কে জানা ছিল না এই অজুহাত কখনই আদালতে গ্রাহ্য হয় না ।
উপসংহারে বলা যায় যে, স্মারকলিপি কোম্পানির মুখ্য দলিল, সনদ বা সংবিধান। প্রত্যেক কোম্পানির জন্য এ ধরণের দলিল তৈরি অপরিহার্য। প্রথম পরিচালক ও উদ্যোক্তাদের নাম এবং স্বাক্ষর এতে থাকায় তা কোম্পানির ঐতিহ্যের প্রকাশ করে ।
কোম্পানির স্মারকলিপি পরিবর্তন বেশ আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ ও জটিল কাজ। স্মারকলিপির প্রত্যেকটি বিষয়বস্তু পরিবর্তনের ভিন্ন নিয়ম কোম্পানি আইনে বর্ণনা করা হয়েছে। নিম্নে পদ্ধতিসমূহ আলোচনা করা হলো—
১. নাম ধারার পরিবর্তন (Change of name clause): এই ধারার পরিবর্তনের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের সাধারণ সভায় বিশেষ প্রস্তাব পাস করতে হয় এবং এ বিষয়ে সরকারের অনুমতি সংগ্রহ করতে হয়। অতঃপর বিশেষ প্রস্তাব পাসের ও সরকারের অনুমতির অনুলিপি কোম্পানি নিবন্ধকের নিকট দাখিল করতে হয়।
আইনগত সমস্যা দেখা না দিলে নিবন্ধক, বইতে পুরাতন নাম বাদ দিয়ে নতুন নাম অন্তর্ভুক্ত করেন এবং এ মর্মে সার্টিফিকেট প্রদান করেন । অতঃপর নাম পরিবর্তন কাজ সমাপ্ত হয় ।
২. উদ্দেশ্য ধারার পরিবর্তন (Change of objects clause): এই ধারার পরিবর্তনে শেয়ারহোল্ডারদের সাধারণ সভায় এই মর্মে বিশেষ প্রস্তাব পাস করে আদালতের অনুমোদন লাভ করতে হয়। আদালতের অনুমোদন লাভের পর নব্বই দিনের মধ্যে সংশোধিত স্মারকলিপির মুদ্রিত কপি ও অনুমোদন লাভের প্রতিলিপি নিবন্ধকের নিকট দাখিল করতে হয়। নিবন্ধক সংশোধিত স্মারকলিপি অনুমোদন করলে উদ্দেশ্য ধারার পরিবর্তন সম্পূর্ণ হয়।
অবশ্য নিম্নলিখিত যে কোনো একটি কারণেই শুধুমাত্র এই ধারায় পরিবর্তন করা যায়—
ক. অধিকতর ব্যয় সংকোচ ও ব্যবসায় পরিচালনায় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য;
খ. নতুন অথবা উন্নততর উপায়ে কোম্পানির প্রধান উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য;
গ. স্থানীয় কার্যক্ষেত্র পরিবর্তন করার জন্য:
ঘ. এমন কোনো নতুন ব্যবসায় আরম্ভ করার জন্য যা কোম্পানির বর্তমান ব্যবসায়ের সাথে লাভজনকভাবে যুক্ত করা যায়;
ঙ. স্মারকলিপিতে উল্লেখিত কোনো উদ্দেশ্য সংকোচন বা পরিত্যাগ করার জন্য;
চ. কোম্পানির যাবতীয় ব্যবসায় অথবা ব্যবসায়ের অংশবিশেষ অথবা একাধিক ব্যবসায়ের কোনো একটি বিক্রয় কিংবা হস্তান্তর করার জন্য;
ছ. অন্য কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তিবর্গের সাথে একত্রীভূত হওয়ার জন্য ।
৩. অবস্থান ও ঠিকানা ধারার পরিবর্তন (Change of situation and address clause) : এ ক্ষেত্রেও উদ্দেশ্য ধারা পরিবর্তনের অনুরূপ সাধারণ সভায় বিশেষ প্রস্তাব পাস এবং আদালতের অনুমোদন লাভ করতে হয় এবং তা নিবন্ধককে জানাতে হয়। উদ্দেশ্য ধারার পরিবর্তনের নায় যেকোনো একটি কারণ এরূপ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়ে থাকে। তবে একই শহরের মধ্যে বা স্থানীয় এলাকার মধ্যে ঠিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ঠিকানা স্থানান্তরের ২৮ দিনের মধ্যে এই সম্পর্কে কোম্পানি নিবন্ধককে বিজ্ঞপ্তি দিলেই চলে ।
৪. মূলধন ধারার পরিবর্তন (Change of capital clause): কোম্পানির পরিমেল নিয়মাবলীতে মূলধন পরিবর্তন সম্পর্কে বিধান থাকলে কোম্পানির মূলধন হ্রাস বা বৃদ্ধি করা যায়। মূলধন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাধারণ সভায় সাধারণ প্রস্তাব পাস করলেই চলে। কিন্তু মূলধনের পরিমাণ হ্রাস করতে হলে শেয়ারহোল্ডারদের সাধারণ সভায় বিশেষ প্রস্তাব পাস করে আদালতের অনুমতি নিতে হয়। অতঃপর কোম্পানির স্মারকলিপিতে নতুন মূলধনের পরিমাণ উল্লেখ করে প্রস্তাব গ্রহণের পর ১৫ দিনের মধ্যে মূলধন পরিবর্তনের ঘোষণা নিবন্ধকের নিকট দাখিল করতে হয়।
পরিমেল নিয়মাবলি দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে শেয়ার মূল্য দ্বারা দায় সীমাবদ্ধ কোনো কোম্পানি নিম্নলিখিত যেকোনো উপায়ে মূলধন পরিবর্তন বা হ্রাস বৃদ্ধি করতে পারে—
ক. নতুন শেয়ার বিলি;
খ. বর্তমান শেয়ারের মূল্যমান বৃদ্ধি;
গ. শেয়ারগুলোকে পুনরায় বিভক্ত করে অল্প মূল্যের শেয়ারে পরিবর্তনকরণ;
ঘ. বণ্টন করা হয়নি বা বাতিল করা হয়েছে এমন শেয়ার হিসাব হতে বাদ দিয়ে শেয়ার মূলধন হ্রাস ।
এটি কোম্পানির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এতে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত বিধি-বিধান অর্থাৎ কোম্পানি কীভাবে পরিচালিত হবে তা উল্লেখ থাকে। অবশ্য পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে কোম্পানি আইনে বর্ণিত তফসিল-১ কে কোম্পানির পরিমেল নিয়মাবলি হিসেবে গ্রহণ করা যায়। সেক্ষেত্রে দলিল তৈরির প্রয়োজন হয় না । প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে এটি প্রস্তুত বাধ্যতামূলক।
পরিমেল নিয়মাবলি হলো কোম্পানির দ্বিতীয় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যার মধ্যে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ পরিচালনা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি লিপিবদ্ধ থাকে। স্মারকলিপির অধীনে এ দলিল কোম্পানির অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-কলাপের দিক-দর্শন হিসেবে ভূমিকা রাখে, কোম্পানির পরিমেল নিয়মাবলিতে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত সেগুলো নিরূপ—
১. প্রতিষ্ঠানের নামঃ কোম্পানির নাম এবং নামের শেষে লিমিটেড বা সীমিত সংক্ষেপে লিঃ শব্দটি বসাতে হবে।
২. কোম্পানির পরিচালক সংক্রান্ত নিয়মাবলি—
i.পরিচালক সংখ্যা;
ii. পরিচালক, ব্যবস্থাপকের নাম, ঠিকানা, পেশা ও অন্যান্য বিবরণী;
iii. প্রথম পরিচালকদের নাম, ঠিকানা ও পেশা
iv. ব্যবস্থাপক ও পরিচালকদের দায়-দায়িত্ব, অধিকার ও কর্তব্য;
v. পরিচালকদের যোগ্যতাসূচক শেয়ার ও মূল্য;
vi. পরিচালকদের পারিশ্রমিক;
vii. পরিচালকদের অবসর গ্রহণ, দায়িত্ব অব্যাহতি ইত্যাদি সংক্রান্ত নিয়মাবলি ।
৩. অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োগ পদ্ধতি—
i. ম্যানেজিং এজেন্ট ;
ii. সলিসিটার;
iii. দালাল;
iv. অবলেখকের নাম;
v. পেশা।
৪. মূলধন সংক্রান্ত নিয়মাবলি
i. অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ ;
ii. মূলধনের শ্রেণীবিভাগ ও পরিমাণ;
iii. ন্যূনতম মূলধনের পরিমাণ;
iv. মূলধনের পরিবর্তন বা হ্রাস-বৃদ্ধির নিয়ম;
৫. শেয়ার সংক্রান্ত নিয়মাবলি:
i. মোট শেয়ারের সংখ্যা ও শ্রেণীবিভাগ;
ii. প্রতি শেয়ারের মূল্য;
iii. শেয়ার ক্রয়ের জন্য জনসাধারণকে আহবানের নিয়ম;
iv. শেয়ার হস্তান্তর সংক্রান্ত নিয়মাবলি;
v. শেয়ার বিক্রয়ের কমিশন ও দালালি
vi. শেয়ার মূল্য পরিশোধের নিয়মাবলি;
vii. শেয়ার বিক্রয় পদ্ধতি;
viii. শেয়ার বাজেয়াপ্তকরণ পদ্ধতি ও শর্তাবলি:
ix. শেয়ার হস্তান্তর সংক্রান্ত নিয়মাবলি ;
x. শেয়ারহোল্ডারদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও অধিকার;
xi. বিভিন্ন শ্রেণীর শেয়ারমালিকদের দায়-দায়িত্ব, ক্ষমতা ও অধিকার ।
৬. কোম্পানির ঋণ সংক্রান্ত নিয়মাবলি:
i. কোম্পানির ঋণ গ্রহণ সংক্রান্ত নিয়মাবলি;
ii. কোম্পানির ঋণ গ্রহণ ক্ষমতার বিবরণ;
iii. ঋণ গ্রহণ পদ্ধতি ।
৭. কোম্পানির সভা সংক্রান্ত নিয়মাবলি:
i. কোম্পানির সভা আহ্বান ও সভা পরিচালনা পদ্ধতি;
ii. সভার ভোট গ্রহণ পদ্ধতি;
iii. বিভিন্ন সভার কোরাম সংক্রান্ত নিয়ম;
iv. সাধারণ সভা ও বিশেষ সভা অনুষ্ঠানের নিয়মাবলি ।
৮. কোম্পানির লভ্যাংশ সংক্রান্ত নিয়মাবলি:
i. লভ্যাংশ ঘোষণার পদ্ধতি;
ii. লভ্যাংশকে মূলধনে রূপান্তরিত করার নিয়মাবলি ।
৯. কোম্পানির ব্যাংকের হিসাব সংক্রান্ত নিয়মাবলি ।
১০. কোম্পানির ঋণ গ্রহণের পদ্ধতি ও নিয়মাবলি ।
১১. কোম্পানির সিলমোহর সংক্রান্ত নিয়মাবলি ।
i. এর সংরক্ষণ ও
ii. ব্যবহার-বিধি ।
“Prospectus is an advertisement of a company " সাধারণত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি জনগণের কাছে শেয়ার ও ঋণপত্র বিক্রয়ের জন্য কোম্পানির পরিপূর্ণ তথ্য সম্বলিত যে বিজ্ঞাপন প্রচার করে, সেটি বিবরণ পত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদেরকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা চালানো হয়। একে কোম্পানির দর্পণের (Mirror) সাথে তুলনা করা হয় ।
সাধারণত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি নিবন্ধনের ছাড়পত্র সংগ্রহের পর মূলধন সংগ্রহের নিমিত্তে ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থা জানিয়ে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে যে পত্র রচনা করা হয় তাকে বিবরণপত্র বলে । মূলত কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র পাবার নিমিত্তে নিবন্ধনের ছাড়পত্র অর্জনের সাথে সাথে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির প্রবর্তক বা উদ্যোক্তাগণ যে পত্রের মাধ্যমে জনগণকে শেয়ার বা ডিবেঞ্চার ক্রয়ের আহবান জানায় তাকে বিবরণপত্র বা প্রসপেকটাস বলে ।
প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি যখন পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয় বা নতুন কোম্পানি বাজারে শেয়ার ছেড়ে মূলধন সংগ্রহের সময় জনসাধারণকে অবহিত করা বা উৎসাহিত করার জন্যই বিবরণী প্রচার করে থাকে। বিবরণ পত্রে এমন সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যা জনগণকে এ কোম্পানি সম্পর্কে পূর্ণ
বিবরণ দিতে সক্ষম ।
একটি বিবরণ পত্রে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত তা নিরূপ—
১. কোম্পানির নাম, ঠিকানা, উদ্দেশ্যাবলি ।
২. অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ ও বিবরণ।
৩. শেয়ার ক্রয়ের আবেদন, আবণ্টন ও তলবে প্রদেয় অর্থের পরিমাণ এবং আবেদনপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ ।
8. ন্যূনতম মূলধন সংগ্রহের পরিমাণ।
৫. প্রাথমিক খরচের পরিমাণ।
৬. পরিচালকদের নাম, ঠিকানা ও পেশা ।
৭. পরিচালকদের যোগ্যতাসূচক শেয়ার ক্রয়ের সংখ্যা ও মূল্য।
৮. পরিচালকদের পারিশ্রমিকের পরিমাণ ।
৯. পরিচালক পর্ষদের সদস্যদের স্বাক্ষর।
১০. সম্পত্তির বিস্তারিত বিবরণ।
১১. পরিচালকদের দেয় অর্থ ও অন্যান্য সুবিধা ।
১২. লভ্যাংশ বণ্টন পদ্ধতি ।
১৩. কোম্পানির নিরীক্ষকের নাম ও ঠিকানা ।
১৪. কোম্পানি আইন উপদেষ্টার নাম ও ঠিকানা।
১৫. কোম্পানির ব্যাংকারের নাম ও ঠিকানা।
১৬. কোম্পানির হিসাব নিরীক্ষণের নিয়মাবলি ।
১৭. তৃতীয় পক্ষের সাথে সম্পাদিত চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ।
১৮. স্মারকলিপির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ।
১৯. পরিমেল নিয়মাবলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।
২০. পরিচালকগণের স্বার্থ ।
২১. শেয়ারের শ্রেণীবিভাগ ও প্রত্যেক শেয়ারের সংখ্যা।
২২. প্রতি শেয়ারের বিক্রয়মূল্য এবং পরিশোধ পদ্ধতি ।
২৩. কোম্পানিতে শেয়ার মালিকদের স্বার্থ ।
২৪. শেয়ার বণ্টনের দায় কেউ গ্রহণ করলে তার নাম ও ঠিকানা।
২৫. কোম্পানির পূর্ব ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
২৬. ম্যানেজিং এজেন্ট বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নাম, ঠিকানা, পারিশ্রমিক এবং নিয়োগ পদ্ধতি ।
২৭. চলতি মূলধনের পরিমাণ ।
২৮. শেয়ার আবেদনের সময় এবং বরাদ্ধের জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হবে তার পরিমাণ ।
২৯. কোম্পানির নিকট সম্পত্তি বিক্রেতাদের নাম ঠিকানা ও পরিচয় ।
৩০. কোন উদ্যোক্তাদের নাম, ঠিকানা এবং কোনো অর্থ বা সুবিধা প্রদান করা হলে তার বিবরণ ।
৩১. কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিসমূহের তারিখ, পক্ষসমূহ।
৩২. কোম্পানির ব্যবসায় চালু থাকলে বিগত কয়েক বছরের উদ্বৃত্ত পত্র ও লাভ -ক্ষতির হিসাব বিবরণী।
৩৩. বিবরণপত্র প্রচারের তারিখ ও পরিচালকদের প্রত্যেকের স্বাক্ষর ইত্যাদি।
পরিশেষে বলতে পারি যে, সব ধরনের কোম্পানির বিবরণপত্রেই উল্লেখিত সবগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত নাও থাকতে পারে । প্রবর্তক বা পরিচালকরা বিচার-বিবেচনা করে কোম্পানির বিবরণপত্রের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে থাকে। তবে কোনো অবস্থাতেই বিবরণ পত্রে মিথ্যা তথ্য-পরিবেশন করা যাবে না ।
শেয়ার দ্বারা সীমাবদ্ধ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির বিবরণপত্র নিবন্ধকের নিকট পেশ করা এবং সেগুলো জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রচার করা বাধ্যতামূলক। তবে কোম্পানিকে সর্বক্ষেত্রেই তা প্রচার করতে হবে এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অনেক সময় দেখা যায় কোম্পানির প্রবর্তকগণ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের নিকট থেকে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করতে পারে। সেক্ষেত্রে আর বিবরণপত্র প্রচার করার প্রয়োজন হয় না । তখন ১৯৯৪ সালের আইনে বর্ণিত তফসিল-৪ অনুযায়ী একটি বিকল্প বিবরণপত্র প্রস্তুত করতে হয় এবং তার এক কপি নিবন্ধকের নিকট প্রেরণ করতে হয় । তা না হলে কোম্পানি শেয়ার বা ঋণপত্র বিলি করতে পারে না। অর্থাৎ, একটি কোম্পানি গঠনের প্রয়োজনীয় মূলধন যখন প্রবর্তকগণ তাদের নিজস্ব আত্মীয়স্বজন অথবা অন্য কোনো উৎস থেকে সংগ্রহ করতে সমর্থ হন তখন বিবরণপত্র প্রচারের পরিবর্তে নিবন্ধকের নিকট যে বিবৃতি প্রদান করা হয় তাকে বিবরণপত্রের বিকল্প বিবৃতি বলে অভিহিত করা হয় ।
কোম্পানি আইনের বিভিন্ন বিধান বা আনুষ্ঠানিকতা পালন শেষে কোনো কোম্পানির প্রবর্তক বা উদ্যোক্তাগন কোম্পানি নিবন্ধকের নিকট হতে নিবন্ধনের প্রমান হিসাবে যে দলিল সংগ্রহ করে তাকেই নিবন্ধনপত্র বলে। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি এরূপ দলিল পাওয়ার পরই কাজ শুরু করতে পারে; কিন্তু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে এরূপ দলিল প্রাপ্তির পর অস্তিত্বের সৃষ্টি হলেও কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র সংগ্রহের পূর্বে তারা কাজ শুরু করতে পারে না।
নিম্নে কোম্পানির নিবন্ধনপত্রের একটি নমুনা দেয়া হলো—
পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে নিবন্ধনপত্র পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় দলিল পত্রসহ কোম্পানি নিবন্ধকের নিকট কার্যারম্ভের অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে হয়। আবেদনে ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ৫০ ধারার নিয়ম সঠিকভাবে পালিত হলে নিবন্ধক কোম্পানিকে কার্যারম্ভের অনুমতি দিয়ে একখানা পত্র প্রদান করেন, যা কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র নামে পরিচিত।
কার্যারম্ভের অনুমতিপত্রে যেসব বিষয় উল্লেখ থাকে, তাহলো—
i. নিবন্ধন অফিসের নাম ও ঠিকানা ;
ii. কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র ইস্যুর তারিখ ;
iii. কার্যারম্ভের তারিখ ;
iv. পত্র নম্বর ;
v. অফিস সীল ;
vi. নিবন্ধকের নাম ও পদবিসহ সিল ও স্বাক্ষর ;
vii. কোনো শর্তযুক্ত থাকলে তার বিবরণ ইত্যাদি ।
নিম্নে কার্যারম্ভের অনুমতিপত্রের একটি চিত্র দেয়া হলো—
আধুনিক ব্যবসায়ের জগতে মূলধনকে জীবনীশক্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। অর্থ ছাড়া যেকোনো ব্যবসায়ই অচল যেমন রক্ত ছাড়া মানুষের শরীর। আমাদের চারপাশে যেসব ব্যবসায় সংগঠন আমরা দেখি সেগুলোর মধ্যে ব্যবসায়ের উপাদান সবগুলো একসাথে নাও থাকতে পারে। কিন্তু সব প্রতিষ্ঠানে একটি মূল উপাদান অবশ্যই আছে আর তা হলো অর্থ। ব্যবসায়ের প্রাথমিক ব্যয় নির্বাহ, উৎপাদন কার্য অব্যাহত রাখা, পণ্য বিতরণ ও শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ প্রভৃতি সকল কাজে অর্থের প্রয়োজন। এজন্যই ব্যবসায়ের সফলতা অনেকাংশেই অর্থসংস্থানের উপর নির্ভর করে। অর্থ সংস্থান মূলত প্রতিষ্ঠানের অর্থের প্রয়োজন নির্ধারণ, উৎস অনুসন্ধান, ব্যবহার নিরূপণ, ভবিষ্যতের জন্য অর্থ সংরক্ষণ, সামগ্রিক অর্থ সংরক্ষণ ও সামগ্রিক অর্থ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত।
কোম্পানি ব্যবসায়ে অর্থসংস্থানের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের উৎস সমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো-
অর্থবাজার হতে শিল্প তথা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বল্পমেয়াদি মূলধন বা পুঁজি সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত এক বছরের জন্য স্বল্প মেয়াদি অর্থের সংস্থান করা হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংক, দেশীয় ঋণদাতা গোষ্ঠী, ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিবৃন্দ, বিল বাজার, সমবায় ব্যাংক, ভূমিবন্ধকি ব্যাংক প্রভৃতি নিয়ে স্বল্প মেয়াদি ঋণের উৎস অর্থবাজার গঠিত হয়।
১. মালিকের তহবিল (Owner's Fund):
ব্যবসায়ে স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানের ক্ষেত্রে মালিকের তহবিলকে প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মালিক প্রথমত তার নিজের সঞ্চিত অর্থ ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেন। মালিকের তহবিল হতে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে ব্যবসায়ের চলতি মূলধনের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করা হয়। এক্ষেত্রে এ উৎস হতে সংগৃহীত অর্থ অপর্যাপ্ত হলে অন্যান্য উৎস হতে অর্থায়নের চেষ্টা করা হয় ।
২. ব্যবসায় ঋণ (Trade Credit) : ব্যবসায় ঋণ এমন এক ধরনের ঋণ যা ধারে ক্রয়-বিক্রয়ের ফলে সৃষ্টি হয়। এ ধরনের ঋণের আওতায় পণ্য সামগ্রীর বিক্রেতা পণ্য বিক্রয়ের একটি নির্দিষ্ট সময় পর ক্রেতার কাছ হতে মূল্য গ্রহণ করে থাকে। ফলে ক্রেতার নিকট এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মূল্য পরিশোধ না করার সুবিধা ঋণ হিসেবে বিবেচিত, যাকে ব্যবসায় ঋণ বলা হয়। অর্থাৎ, ব্যবসায় ঋণ এমন এক ধরনের ঋণকে বুঝায় যা একজন ব্যবসায়ের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের ফলে পণ্য সরবরাহকারীর কাছ থেকে পেয়ে থাকে। বর্তমানে উন্নয়নশীল ব্যবসায় জগতে এরূপ ঋণের ব্যবহার ব্যবসায়ের অর্থসংস্থানকে খুবই সহজ করেছে ।
৩. বাণিজ্যিক ব্যাংক (Commercial Bank): বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ব্যবসায়ী বলা হয়। ব্যাংকগুলোর প্রধান কাজ হলো বিভিন্ন ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প কারখানায় স্বল্প মেয়াদি ঋণ দেয়া। সুতরাং যে কোনো ব্যবসায়ীর অর্থের প্রয়োজন হলেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ হতে স্বল্পমেয়াদে অর্থ সংগ্রহ করা যায়। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সহজ শর্তে ধার, নগদ ঋণ ও জমাতিরিক্ত ঋণ হিসেবে অর্থ দিয়ে থাকে ।
৪. আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু বান্ধব (Relatives & Friends): প্রত্যেক মানুষেরই এমন কিছু আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধব থাকে, যারা বিভিন্ন বিপদ-আপদ ও প্রয়োজনের সময় এগিয়ে আসে। ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, ব্যবসায়ে অর্থায়নে নিজস্ব তহবিল হতে সংগৃহীত অর্থ অপর্যাপ্ত হলে নিকটতম আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের শরণাপন্ন হয় এবং তাদের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে অর্থ নিয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করা হয়। আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের ইতিবাচক দিক হচ্ছে কোনো ধরনের জামানত এবং সুদ বা মুনাফা না দিয়েই খুবই সহজ শর্তে ও সহজ প্রক্রিয়ায় ঋণ গ্রহণ করা যায় ।
৫. দেশীয় ব্যাংকার (Indigenous Banks): প্রাচীনকাল হতেই ব্যবসায়ের অর্থসংস্থানে দেশীয় ব্যাংকার মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। দেশীয় ব্যাংকার বলতে অর্থ ব্যবসায়ে লিপ্ত বিভিন্ন ব্যক্তি বা মহাজন শ্রেণীকে বুঝায়। দেশীয় ব্যাংকার চড়া সুদে বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে ঋণ প্রদান করে। গ্রামাঞ্চলে দেশীয় ব্যাংকারদের উপস্থিতি অধিক লক্ষণীয়।
৬. ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধি (Management Agent): ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধি বলতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বুঝায় যারা চুক্তির আওতায় কোনো কোম্পানির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। এরূপ ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধি ব্যবসায়ের স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানের অন্যতম উৎস। ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধি আর্থিক দিক থেকে অত্যন্ত স্বচ্ছল থাকায় খুব সহজেই তারা অর্থের সংস্থান করতে সক্ষম হয়। তাছাড়া বাজারে যথেষ্ট সুনাম থাকায় সহজেই কোম্পানির শেয়ার ঋণপত্র বিক্রি করতে পারে এবং নিজেদের জিম্মায় ব্যাংক হতে ঋণ গ্রহণ করতে পারে।
৭. সমবায় ব্যাংক ও সমবায় ঋণদান সমিতি (Co-operative Banks & Co-operative Credit Society): সমবায় ব্যাংকগুলো বিভিন্ন শিল্প, ব্যবসায় ও বাণিজ্যে ঋণ প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে ছোটখাটো বিভিন্ন শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রদানের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের চলতি মূলধনের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। অন্যদিকে সমবায় ঋণদান সমিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হলো সহজ শর্তে বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ঋণ দান করা। অবশ্য এরূপ প্রতিষ্ঠান প্রধানত সদস্যদের ঋণদানের ক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে ।
৮. অগ্রিম অর্থ (Advance Money): যেসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য সম্পর্কে বাজারে যথেষ্ট সুনাম রয়েছে তাদের স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। কেননা, তাদের পণ্য পাওয়ার জন্যে ক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা, পাইকার, দালাল বা ফড়িয়াগণ অনেক সময় পণ্য উৎপাদন বা সংগ্রহের আগেই অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে থাকে। আবার, কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও বিভিন্ন শিল্প মালিকদের কাছ থেকে কাঁচামালের অগ্রিম মূল্য পেয়ে থাকে ।
৯. সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান (Government and Semi - Govt. Organizations): সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মসূচি রয়েছে দেশের ব্যবসায় ও শিল্প খাতের উন্নয়নে । কারিগরি সহায়তার পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহদাকার ব্যবসায়ের চলতি মূলধনের চাহিদা নিরসনে স্বল্প মেয়াদি অর্থ সরবরাহ করে থাকে।
১০. ভূমি বন্ধকি ব্যাংক (Land Mortgage Banks): ভূমি বন্ধকি ব্যাংকের কাজ হলো ভূমি বা জমি বন্ধক রেখে ঋণ প্রদান করা। বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ তাদের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক সম্পত্তি বন্ধক রেখে ভূমি বন্ধকি ব্যাংক হতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করে থাকে ।
১১. শিল্প ব্যাংক (Industrial Bank): শিল্প ব্যাংক একটি বিশেষায়িত ব্যাংক। এরূপ ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো দেশের শিল্পখাতের উন্নয়নে ঋণ ও পরামর্শ প্রদান করা। শিল্প ব্যাংক মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পাশাপাশি শিল্পের চলতি মূলধনের চাহিদা পূরণের জন্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ মঞ্জুর করে থাকে ।
১২. ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি (Micro Credit Program): আমাদের দেশের ব্যবসায় ও কুটির শিল্পের উন্নয়নে বিশেষ করে স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা (NGO) যেমন–ব্রাক, আশা, প্রশিকা প্রভৃতি গ্রামীণ জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির আওতায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে স্বল্পমেয়াদি অর্থের যোগান দিচ্ছে। বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের জামানতবিহীন ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচিও ব্যবসায়ের স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানে কার্যকর ভূমিকা রাখছে ।
১৩. বিল বাট্টাকরণ (Discounting Bills): ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাপ্য বিল বাট্টাকরণের মাধ্যমেও স্বল্পমেয়াদি অর্থের সংস্থান করে থাকে। এক্ষেত্রে প্রাপ্য বিল কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে বিলের লিখিত মূল্যের (Face Value) চেয়ে কম অর্থের সংস্থান করতে পারে। জরুরি প্রয়োজনে এরূপ বিল বাট্টাকরণের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থান করা হয় ।
১৪. সম্পত্তি বিক্রয় (Sale of Assets): অনেক সময় ব্যবসায় কিছু কিছু সম্পত্তি থাকে যা ব্যবসায়ে কাজে লাগে না বা অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয়। এরূপ সম্পত্তি বিক্রয় করেও ব্যবসায়ের স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয় ৷
পরিশেষে বলা যায় যে, সকল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানই স্বল্প মেয়াদি বিভিন্ন ধরনের অর্থসংস্থানের উপর নির্ভরশীল। স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানের উৎস হচ্ছে প্রধানত উৎপাদন সংশ্লিষ্ট ব্যয়। কর্মীদের পারিশ্রমিক অফিস রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, প্রভৃতি খাতে ব্যয় করা হয়।
দীর্ঘ কালীন সময়ের জন্য অর্থাৎ ৫ বা ১০ বছরের অধিক সময়ের জন্য ব্যবসায়ে যে অর্থসংস্থান করা হয় তাকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান বলে । বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের প্রয়োজন হয় ।
দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের উৎসসমূহ নিম্নে বর্ণনা করা হলো—
১. শেয়ার বিক্রয় (Sale of share): কোম্পানি জনগণের নিকট শেয়ার বিক্রয় করে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান করতে পারে। সাধারণত: কোম্পানি বিলোপসাধনের আগে শেয়ারের অর্থ ফেরত দিতে হয় না । বিভিন্ন প্রকার শেয়ারের মাধ্যমে এ ধরনের অর্থসংস্থানের কাজ হয় ।
২. ঋণপত্র বিক্রয় (Sale of debenture): কোম্পানি জনগণের নিকট শেয়ার বিক্রয় করার পাশাপাশি ঋণপত্র বিক্রয়ের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান করতে পারে ।
৩. সঞ্চিতি তহবিল (Reserve fund ): কোম্পানির মুনাফার যে অংশ বণ্টন না করে রেখে দেয়া হয় তাকে সঞ্চিতি তহবিল বলে। এই অবণ্টিত মুনাফা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সঞ্চিতি তহবিল গঠন করা হয় যা ব্যবসায়ের দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের উৎস বলে বিবেচিত হয়। যেমন- সাধারণ সঞ্চিতি তহবিল, লভ্যাংশ সমতাকরণ তহবিল ।
৪. অবলেখক (Underwriter): যে সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নতুন কোম্পানির শেয়ার ও ঋণপত্র বিক্রয়ের ঝুঁকি গ্রহণ করে তাদেরকে অবলেখক বলে। কোম্পানির শেয়ার ও ঋণপত্র বিক্রয় করা সম্ভব না হলে অবলেখকরাই চুক্তি অনুযায়ী অবশিষ্ট শেয়ার ও ঋণপত্র ক্রয় করে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে ।
৫. শেয়ার বাজার (Share market): যে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়মিত ও অনুমোদিত ভাবে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার ও ঋণপত্র ক্রয়-বিক্রয় করা হয় তাকে শেয়ার বাজার বলা হয়। শেয়ার বাজারে শেয়ার বিক্রয়ের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান করা যায়।
৬. শিল্পব্যাংক (Industrial bank): শিল্পব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থা বৃহদায়তন শিল্প স্থাপন ও উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের কাজ করে থাকে ।
৭. বন্ধকি ব্যাংক (Mortage bank): সাধারণত: বাণিজ্যিক ব্যাংক উপযুক্ত জামানত পেলে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের জন্য ঋণ সরবরাহ করে থাকে। অনেক সময় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে ।
৮. বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান (Investment organisation): বিভিন্ন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংক, বীমা, লিজিং ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করে ।
৯. বীমা প্রতিষ্ঠান (Insurance company): ব্যবসায়ের অনিশ্চয়তা দূর করে ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকে বীমা প্রতিষ্ঠান । এরা এদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ব্যবসায়ের দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান করে থাকে ।
পরিশেষে বলা যায় যে, যেকোনো ব্যবসায় পরিচালনার জন্য প্রচুর পরিমাণ মূলধন বা তহবিলের প্রয়োজন হয়। এ প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদিও হয়। উপরিউক্ত উৎসগুলোর মাধ্যমে ব্যবসায় পরিচালনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান করা যায় ।
নতুন কিংবা পুরাতন কোম্পানি সংগঠনের মূলধন সংগ্রহের প্রধান হাতিয়ার হলো শেয়ার। ইংরেজি ‘Share’” শব্দের আভিধানিক অর্থ 'অংশ' । কোম্পানি সংগঠনের ক্ষেত্রে শেয়ার-এর অর্থ হচ্ছে-কোম্পানির মোট মূলধনের অংশ। কোম্পানির মোট মূলধনকে মোট সমপরিমাণ কতকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককে বিভক্ত করা হয়। এদের প্রত্যেকটি একককে এক একটি শেয়ার বলে। প্রত্যেকটি শেয়ারের নির্দিষ্ট আংকিক মূল্য (Face value) থাকে এবং প্রত্যেকটির মূল্য সমান থাকে। যেমন-কোনো কোম্পানির ১০ লক্ষ টাকার মূলধনকে ১০,০০০ ভাগে ভাগ করা হলে এক একটি ভাগের মূল্য হবে ১০০ টাকা। মূলধনের এ শেয়ারের মালিক হয়ে কোম্পানির মালিকানা দাবি করা যায়। কোম্পানির নির্বাচনে ভোটদানের অধিকার পাওয়া যায়। বৃহদায়তন কোম্পানি চলমান অবস্থায় আর্থিক সংকটে পড়লে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের ব্যবস্থা করে।
সুতরাং কোম্পানির সমগ্র মূলধনকে সমপরিমাণ এককে বিভক্ত করলে প্রত্যেকটি একককে শেয়ার বলে। প্রত্যেকটি এককই সমান মূল্য বহন করে এবং মূলধনের একটি ক্ষুদ্র অংশ নির্দেশ করে, যাকে শেয়ার বলে । পরিশেষে বলা যায় যে, শেয়ার হচ্ছে কোম্পানির মোট মূলধনের অংশ। যে ব্যক্তি শেয়ার ক্রয় করে তাকে শেয়ারহোল্ডার বলে । প্রত্যেকটি শেয়ার মূলধনের অংশ বলে সেটি ক্রয়ের দ্বারা শেয়ারহোল্ডারগণ কোম্পানির আংশিক মালিকানা লাভ করে এবং এর বলে তারা কোম্পানির লভ্যাংশ পাবার অধিকার লাভ করে। কোম্পানির বিলোপ সাধন ঘটলে শেয়ারহোল্ডারগণ কোম্পানির সম্পত্তিতে প্রদত্ত মূলধনের আনুপাতিক অংশ ফেরত পাবার অধিকারী হয়।
শেয়ার হলো যৌথ মূলধনী কোম্পানির মোট মূলধনের ক্ষুদ্রতম অংশ। কোম্পানি মূলধন সংগ্রহ করার জন্য জনগণের কাছে শেয়ার বিক্রি করে দেয়। কোম্পানি নিজের এবং বিনিয়োগকারীদের কথা বিবেচনা করে,বিভিন্ন প্রকার শেয়ার ইস্যু করে।
নিম্নে ছকের মাধ্যমে শেয়ারের শ্রেণিবিভাগ দেখানো হলো—
যে শেয়ারের মালিকগণ অগ্রাধিকারযুক্ত শেয়ারের মালিকদের মধ্যে লভ্যাংশ বণ্টনের পর লভ্যাংশ পায় এবং ব্যবসায় বিলোপ সাধনকালেও অগ্রাধিকার যুক্ত শেয়ার মালিকদের মূলধন দেয়ার পর তাদের মূলধন ফেরত পাবার অধিকারী হয় তাকে সাধারণ বা ইক্যুইটি শেয়ার বলে ।সাধারণ শেয়ারের লভ্যাংশের হারের কোনো স্থিরতা নেই। লাভ বেশি হলে লভ্যাংশ বেশি হবে আর লাভ কম হলে তাদের প্রাপ্য লভ্যাংশও কম হবে। সাধারণ শেয়ারকে ইক্যুইটি শেয়ার বলা হয়। এ ধরনের শেয়ার মালিকগণ পূর্ণ ভোটাধিকার প্রাপ্ত হন এবং ব্যবসায় পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে ।
যে শেয়ারের মালিকগণ ব্যবসায়ের লভ্যাংশ বণ্টনের ক্ষেত্রে বা ব্যবসায়ের বিলোপ সাধনের সময়ে তাদের মূলধনের অর্থ ফেরত পাবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারলাভ করে থাকেন তাকেই বলে অগ্রাধিকারযুক্ত শেয়ার । কোম্পানি আইনের ৮৫ নং ধারায় বলা আছে যে, অগ্রাধিকার শেয়ার হলো কোম্পানির শেয়ার মূলধনের সেই অংশ যা নিরূপ সুবিধাসমূহ ভোগ করে থাকে :
(ক) লভ্যাংশ বণ্টনের সময় এ শেয়ারের নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ পাবার অগ্রাধিকার থাকে।
(খ) কোম্পানি বিলোপ হলে মূলধন ফেরত দেবার অগ্রাধিকার থাকতে পারে ।
লভ্যাংশ বণ্টন পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে অগ্রাধিকার শেয়ারকে আবার কতিপয় শ্রেণীতে ভাগ করা যায়—
i. সঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার (Cumulative Preference Share): যদি কোনো বছর কোম্পানির মুনাফা অর্জিত না হয় তাহলে কোম্পানি তাদের লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ হয় । তবে তাদের অপরিশোধিত লভ্যাংশ বকেয়া রেখে পরে যখন কোম্পানি মুনাফা অর্জিত হয় তখন বর্তমান লভ্যাংশের সাথে পূর্বের অপরিশোধিত বকেয়া লভ্যাংশ পরিশোধ করে দেয়া হয়। অপরিশোধিত লভ্যাংশ কোম্পানির কাছ পাওনা হতে থাকে এবং মুনাফা অর্জিত হলে কোম্পানি তা প্রদান করে। এ ধরনের শেয়ারকে সঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার বলা হয়ে থাকে ।
ii. অসঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-Cumulative Preference Share): এ শ্রেণীর শেয়ার মালিকগণ কেবলমাত্র যে বছর কোম্পানির মুনাফা অর্জিত হয় সে বছরই লভ্যাংশ পাবার অধিকারী হয়। যদি কোনো বছর কোম্পানির মুনাফা অর্জিত না হয় তাহলে তারা কোম্পানির কাছে ঐ বছরের মুনাফা দাবি করতে পারে না এবং এরূপ মুনাফা কোম্পানির কাছে তাদের পাওনা হয় না। এ কারণে এরূপ শেয়ারকে অসঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার বলে ।
iii. পরিশোধ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Redeemable Preference Share): যে অগ্রাধিকার শেয়ারের মূল্য একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে শেয়ার মালিকদের ফেরত দেয়া হয় তাকে পরিশোধ্য অগ্রাধিকার শেয়ার বলে। এরূপ শেয়ার কেবল পরিমেল নিয়মাবলির অনুমোদনক্রমে কোম্পানি আইনের শর্ত অনুযায়ী বিক্রয় করা চলে। এটি মূলত শেয়ার ও ঋণপত্রের মিশ্রিত এক বিশেষ ধরনের শেয়ার।
iv. অপরিশোধ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Irredeemable Preference Share): যে অগ্রাধিকার শেয়ারের মূল্য কোম্পানির বিলোপ সাধনের পূর্বে ফেরৎ পাওয়া যায় না তাকে অপরিশোধ্য শেয়ার বলে ।
v. অংশগ্রহণকারী অগ্রাধিকার শেয়ার (Participating Preference Share): যে অগ্রাধিকার শেয়ারের মালিকগণ মুনাফা হতে প্রথমত নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ প্রাপ্ত হলেও পরবর্তীতে সাধারণ শেয়ার মালিকদের মধ্যে লভ্যাংশ বণ্টনের সময় পুনরায় তার অংশ পায় তাকে অংশগ্রহনকারী অগ্রাধিকার শেয়ার বা পার্টিসিপেটিং শেয়ার বলে ।
vi. অংশ না গ্রহণকারী অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-Participating Preference Share): যে জাতীয় শেয়ারের মলিকগণ মুনাফা হতে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ পায় কিন্তু সাধারণ শেয়ার মালিকদের মাধ্যে লভ্যাংশ বণ্টনের সময় পুনরায় অংশ পায় না তাকে অংশ না গ্রহণকারী অগ্রাধিকার শেয়ার বা নন পার্টিসিপেটিং শেয়ার বলে ।
vii. পরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Convertible Preference Share ) : শেয়ার বিক্রয়ের শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ান্তে যে অগ্রাধিকার শেয়ারকে সাধারণ শেয়ারে রূপান্তরের সুযোগ দেয়া হয় তাকে পরিবর্তনযোগ্য শেয়ার বলে ।
viii. অপরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-Convertible Preference Share): যে অগ্রাধিকার শেয়ারকে কখনই সাধারণ শেয়ারে রূপান্তরিত করা যায় না তাকে অপরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার বলে ।
অগ্রাধিকার শেয়ার ও সাধারণ শেয়ার মালিকদের মধ্যে লভ্যাংশ বণ্টনের পর এ শ্রেণীর শেয়ার মালিকদের মধ্যে লভ্যাংশ বণ্টন করা হয়। আবার কোম্পানির বিলোপ সাধনের ক্ষেত্রে পূর্বোক্ত দুই শ্রেণীর শেয়ার মালিকদের মূলধনের অর্থ প্রত্যার্পণ করার পর যদি মূলধনের বা সম্পত্তির কোনো উদ্বৃত্ত থাকে তাহলে তাদের দাবি মেটানো হয়। কাজেই কোম্পানির লভ্যাংশ বণ্টন বা মূলধন প্রত্যর্পণের বিষয়ে এরা সর্বশেষ দাবিদার বা অধিকারভোগী। কোম্পানির প্রবর্তক বা উদ্যোক্তারাই এ শ্রেণীর শেয়ারের মালিক হয়। এ ধরনের শেয়ারকে প্রবর্তকের শেয়ার বা Founder's Share বলে।
সাধারণভাবে উপরে বর্ণিত তিন ধরনের শেয়ার দেখা যায়। তবে অনেক সময় কোম্পানিকে উপরের শেয়ারগুলো ছাড়াও বিভিন্ন নামে শেয়ার বণ্টন করতে দেখা যায়। বৈশিষ্ট্যের দৃষ্টিতে এ শেয়ারগুলো সাধারণ শেয়ার ।
নিম্নে তিন ধরনের বিশেষ শেয়ারের বর্ণনা দেয়া হলো—
ক. অধিবৃত্তি/বোনাস শেয়ার (Bonus Share): কখনও কখনও কোম্পানি অর্জিত মুনাফার কিছু কিছু অংশ সদস্যদের মধ্যে বণ্টন না করে কোম্পানির উন্নয়নের জন্য সংরক্ষিত তহবিলে তা জমা রাখে । তহবিলে রক্ষিত এই অবণ্টিত মুনাফা থেকে সৃষ্ট লভ্যাংশ পরবর্তীতে শেয়ার মালিকগণকে নগদে প্রদান না করে ঐ লভ্যাংশের বদলে কোম্পানি শেয়ার ইস্যু করে। নগদ লভ্যাংশের বদলে যে শেয়ার ইস্যু বা প্রদান করা হয় সেই শেয়ারকে অধিবৃত্তি বা বোনাস শেয়ার বলে। এ শেয়ারকে বিশেষ ধরনের শেয়ার বলা হলেও এ শেয়ার সাধারণ শেয়ারের অন্তর্গত। বোনাস শেয়ারের আংকিক মূল্য নগদে শেয়ার মালিকগণকে না দিয়ে তা সংরক্ষিত তহবিল থেকে মূলধন তহবিলে রূপান্তর করা হয়।
খ. অধিকার বা রাইট শেয়ার (Right Share): প্রয়োজনের তাগিদে অধিকতর মূলধন সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কোম্পানি আবার নতুন করে শেয়ার বাজারে ছাড়ার সময় বর্তমান শেয়ার মালিকদেরকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বর্তমান (existing) শেয়ার মালিকগণ তাদের অধিকারভুক্ত পূর্বে ক্রীত শেয়ারের অনুপাতে নতুন শেয়ার ক্রয়ের অধিকারী হয়। অধিকার প্রাপ্ত এ নতুন শেয়ারকে রাইট শেয়ার বলে। মনে করা যাক, কোম্পানি সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা ২:১ অনুপাতে রাইট শেয়ার ইস্যু করবে। অর্থাৎ যার পুরাতন ২টি শেয়ার আছে সে ১টি নতুন শেয়ার ক্রয়ের রাইট শেয়ার হিসেবে পাবে। রাইট শেয়ারও কোনো পৃথক ধরনের শেয়ার নয় । এটি সাধারণ বা অগ্রাধিকার শেয়ার হতে পারে।
গ. অনির্ধারিত মূল্য বা অনাঙ্কিক মূল্যের শেয়ার (No-par value Shares): যে শেয়ারের কোনো আঙ্কিক মূল্য পূর্ব হতে নির্দিষ্ট থাকে না, বছর শেষে হিসাব-নিকাশের পর মোট সম্পদ হতে মোট অন্যান্য দায়ের পরিমাণ বাদ দিয়ে শেয়ারের মূল্যমান নিরূপণ করা হয়, তাকে অনাঙ্কিক মূল্যের শেয়ার বলে। আমাদের দেশে এ ধরনের শেয়ারের প্রচলন নেই। আমেরিকায় এ ধরনের শেয়ার বেশি দেখা যায়। প্রবর্তক বা উদ্যোক্তাগণ এ শেয়ারের মালিক হয় ।
পরিশেষে বলা যায় যে, কোম্পানি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের শেয়ারের ব্যবহার ঘটায় শেয়ারহোল্ডারগণ তাদের প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী এসব শেয়ার ধারণ করেন। উপরের আলোচনায় বিভিন্ন ধরনের শেয়ার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে ।
ঋণপত্র হলো ঋণের দলিল। অর্থনৈতিকভাবে সংকটগ্রস্ত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির অর্থ সংগ্রহের অন্যতম হাতিয়ার এ ঋণপত্র। ঋণপত্রের মাধ্যমে কোম্পানি একদিকে অর্থ সংগ্রহ করে অন্যদিকে অর্থ প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ে সুদ প্রাপ্তির মাধ্যমে আয়ের বিষয় নিশ্চিত হয় । যারা ঋণপত্র ক্রয় করে তাদেরকে কোম্পানির পাওনাদার বলে ।
পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি স্বীয় সীলমোহরযুক্ত যে দলিলের সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট হারে প্রতিবছর সুদ প্রদানের প্রতিশ্রুতিতে জনগণের নিকট থেকে ঋণ হিসেবে মূলধন সংগ্রহ করে তাকে ঋণপত্র বলে । ঋণপত্রে কোম্পানির নামযুক্ত সীলমোহর থাকে। এর উপর প্রদেয় সুদ, জামিন, পরিশোধের সময় প্রভৃতি শর্তাবলির উল্লেখ থাকে। শেয়ারের মতো এরও একটি আঙ্কিক মূল্য থাকে। উল্লেখ্য যে, কোম্পানি আইন অনুযায়ী পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ঋণপত্র বিলি করে ঋণ সংগ্রহ করতে পারে। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি ঋণপত্র বিক্রি করতে পারে না ।
ঋণপত্রের শ্রেণিবিভাগ (Classification of Debenture)
ঋণপত্রকে ঋণের দলিল বলা হয়। কোম্পানির মূলধন গঠনের জন্য এ দলিলটি বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে । সুতরাং, ঋণপত্র বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। ঋণের জামানত, ঋণ পরিশোধের শর্ত, হস্তান্তর ও পরিবর্তনের সুযোগ, সুবিধা ইত্যাদির ভিত্তিতে ঋণপত্রকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। কোম্পানির ঋণ দাতারা সুযোগ এবং চাহিদা অনুযায়ী ঋণ প্রদান করে থাকে ।
ঋণপত্রকে নিােক্ত শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়—
১. সাধারণ বা জামানত বিহীন ঋণপত্র (Ordinary or Unsecured Debenture): যে ঋণপত্র বিলি করতে কোম্পানিকে কোনো প্রকারের জামিন দিতে হয় না তাকে সাধারণ বা জামানত বিহীন ঋণপত্র বলে। এ জাতীয় ঋণপত্রে শুধু ঋণের টাকা ও সুদ প্রদানের প্রতিশ্রুতি থাকে। বাজারে কোম্পানির যথেষ্ট সুনাম থাকলে তার উপর ভিত্তি করে জনসাধারণ জামিন ছাড়াই এরূপ ঋণপত্র ক্রয় করে থাকে। সুনামই ক্রেতার কাছে জামানত হিসেবে কাজ করে। এরূপ ঋণপত্রের মালিকগণ কোম্পানির সাধারণ পাওনাদার বলে বিবেচিত হন।
২. বন্ধকী বা জামানতযুক্ত ঋণপত্র (Mortgage or Secured Debenture): ব্যবসায়ের কোনো সম্পত্তি বন্ধক রেখে বা জামিন রেখে কোম্পানি যেসব ঋণপত্র ইস্যু করে, সেগুলোকে বন্ধকী ঋণপত্র বলা হয়। এতে কোম্পানির ঋণগ্রহীতাগণ ঋণের আসল ও সুদ পাওয়ার নিশ্চয়তা লাভ করে। এ জাতীয় ঋণপত্র বিলির ক্ষেত্রে কোম্পানিকে ঋণপত্রের জামানতকৃত সম্পদের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে নিবন্ধকের কাছে জানাতে হয় ।
বন্ধকী/জামানতযুক্ত ঋণপত্রকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা যায়:
৩. নিৰ্দিষ্ট জামানত যুক্ত ঋণপত্র (Fixed Charge Debenture): কোম্পানির বিশেষ সম্পদের উপর জামিন রেখে যে ঋণপত্র বিলি করা হয় তাকে বলে নির্দিষ্ট জামানতযুক্ত ঋণপত্র। এসব ক্ষেত্রে ঋণপত্রধারীদের অনুমতি ছাড়াই লেনদেন করে থাকে ।
১. পরিশোধ্য ঋণপত্র ( Redeemable Debenture): নির্দিষ্ট সময় শেষে ঋণ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে সব ঋণপত্র কোম্পানি ইস্যু করে থাকে সেগুলোকে বলে পরিশোধ্য ঋণপত্র। সাধারণভাবে ঋণপত্রে উল্লেখিত শর্তানুসারে এরূপ ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয়।
২. অপরিশোধ্য ঋণপত্র (Irredeemable Debenture): যে ঋণপত্রের টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ থাকে না এবং ঋণপত্রধারিগণ তাদের প্রদত্ত অর্থ দাবি করতে পারে না তাকে অপরিশোধ্য ঋণপত্র বলে। এরূপ ঋণপত্রকে চিরস্থায়ী ঋণপত্র বলে ।
১. নিবন্ধিত ঋণপত্র ( Registered Debenture): যে ঋণপত্রে ক্রেতার নাম কোম্পানির বইতে লিপিবদ্ধ থাকে তাকে নিবন্ধিত ঋণপত্র বলে। এ ধরনের নিবন্ধন পত্রে ক্রেতার নাম, ক্রমিক নম্বরসহ উল্লেখ থাকে। হস্তান্তর দলিল সম্প্রদান করে এ ধরনের ঋণপত্রের ধারক সংশ্লিষ্ট ঋণপত্র কোম্পানিকে জানিয়ে বিক্রি করতে পারে ।
২. অনিবন্ধিত ঋণপত্র (Un- Registered Debenture): যে ঋণপত্রে ক্রেতার নাম এবং এর বিলিকারী কোম্পানির বইতে লিপিবদ্ধ থাকে না তাকে অনিবন্ধিত ঋণপত্র বলে। এ ঋণপত্রে ক্রেতার নাম ও ক্রমিক নম্বর উল্লেখ থাকে না। এ ধরনের ঋণপত্র হস্তান্তরের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় না ।
১. রূপান্তরযোগ্য ঋণপত্র (Convertible Debenture): শর্তানুসারে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে ঋণপত্রের মালিকগণ ইচ্ছা করলে তাদের ঋণপত্রকে শেয়ারে রূপান্তর করতে পারে। এ ধরনের ঋণপত্রকে পরিবর্তনীয় বা রূপান্তরযোগ্য ঋণপত্র বলে ।
২. অরূপান্তরযোগ্য ঋণপত্র (Unconvertible Debenture): যে ঋণপত্রকে কখনই শেয়ারে রূপান্তর করা যায় না তাকে অরূপান্তরযোগ্য ঋণপত্র বলে। কেবল অর্থের মাধ্যমে এ ঋণপত্রের টাকা পরিশোধ করা হয়ে থাকে।
পরিশেষে বলা যায় যে, কোম্পানি জগতে বিভিন্ন ধরনের ঋণপত্রের ব্যবহার ব্যাপক। বিভিন্ন ধরনের ঋণপত্র কোম্পানির অর্থায়নে বিভিন্নভাবে অবদান রাখছে।
বিলোপসাধন বলতে গুটিয়ে ফেলা বা বিলুপ্ত করা বা বন্ধ করে দেয়াকে বোঝায়। আর কোম্পানির বিলোপসাধন বলতে এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়াকে বোঝায়। যে পদ্ধতিতে কোম্পানির কার্যক্ষমতার অবসান ঘটে তাকে কোম্পানির বিলোপসাধন বলে ।
কোম্পানি আইন-সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার অধিকারী একটি স্বেচ্ছা সংগঠন। আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট বলে এর পরিসমাপ্তিও আইনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে ।
১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের নিয়ম মোতাবেক কোম্পানির কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলাকে ই কোম্পানির বিলোপসাধন বলে । আইনের বিধান পালনের মাধ্যমে কোম্পানির কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়া যায়। আর এর মাধ্যমেই কোম্পানি হারায় তার অস্তিত্ব।
কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী কোনো কোম্পানির কাজকর্ম গুটিয়ে নেয়ার পদ্ধতিকে কোম্পানির বিলোপসাধন বলে। ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২৩৪(১) ধারায় কোম্পানির বিলোপসাধনের তিনটি পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে।
কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার, পাওনাদার বা কোম্পানির নিবন্ধকের আবেদনের প্রেক্ষিতে যে সব কারণে আদালত কর্তৃক বাধ্যতামূলক বিলোপসাধন হতে পারে, সেগুলো হলো-
১. বিশেষ সভায় শেয়ারহোল্ডারগণ কর্তৃক বিলোপ সাধনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ;
২. নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিধিবদ্ধ সভা অনুষ্ঠান ও নিবন্ধকের নিকট বিধিবদ্ধ বিবরণী পেশে ব্যর্থতা;
৩. নিবন্ধনের এক বছর সময়ের মধ্যে কার্যারম্ভে ব্যর্থতা;
৪. যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত এক বছর সময়ের বেশি কার্যক্রম বন্ধ থাকা;
৫. আইন মোতাবেক কোম্পানিতে ন্যূনতম সংখ্যক সদস্য না থাকা;
৬. কোম্পানির পাঁচ হাজার টাকা বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা ;
উল্লেখিত যেকোনো কারণে আদালত অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়ে একজন লিকুইডিটর নিয়োগ করতে পারেন, যিনি কোম্পানির সব সম্পত্তি হতে প্রথমে তৃতীয় পক্ষের দেনা পরিশোধ করে কিছু থাকলে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বণ্টন করেন।
কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার বা পাওনাদারগণ ইচ্ছে করলে নিজেরাই কোম্পানির অবসায়ন ঘটাতে পারেন। সে ক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডার ও পাওনাদারগণ পারস্পরিক যোগাযোগের ভিত্তিতে আদালতের সাহায্য ছাড়াই স্বেচ্ছায় বিলোপসাধন ঘটাতে পারেন।
যেসব কারণে কোম্পানির স্বেচ্ছায় বিলোপসাধন ঘটাতে পারে তা হলো [২৯০(১) ধারা] :
i. বিশেষ সভায় শেয়ারহোল্ডারগণ ও পাওনাদারবৃন্দের বিলোপসাধনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ;
ii. কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে ও সময়ের জন্য কোম্পানি গঠিত হয়ে তা সম্পন্ন হলে;
iii. কোম্পানি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে এবং পরিশোধে অক্ষম হলে;
iv. কোম্পানি পরিচালনা অলাভজনক হলে ইত্যাদি।
কোম্পানির স্বেচ্ছামূলক বিলোপসাধনের ক্ষেত্রে যেকোনো পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের তত্ত্বাবধানে বিলোপসাধন ঘটতে পারে। যেসব কারণে এরূপ বিলোপসাধন ঘটে। সেসব হলো :
i. শেয়ার মালিক বা পাওনাদারদের প্রতারণার উদ্দেশ্যে বিলোপ সাধনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে;
ii. কোম্পানির সম্পদ সংগ্রহ ও বিক্রয়ে অনিয়ম হলে; ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায় যে, উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন পন্থায় কোম্পানির অবসান ঘটানো যায়। এগুলো ছাড়া যেকোনো যৌক্তিক কারণে আদালত যেকোনো কোম্পানির বিলোপ সাধন ঘটাতে পারে ।
প্রায় ১৫ কোটি মানুষের দেশ হওয়ায় এদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার মোটামুটি বড়। তদুপরি সস্তা জনশক্তির কারণে এ দেশের অনেক বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ দেশে বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি সংগঠন বিস্তার লাভ করতে পারে নি। এর পিছনে অন্তরায়সমূহ নিম্নরূপ—
১. দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব (Insufficiency of efficient entrepreneurs): এ ধরনের ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তোলার জন্য একদল দক্ষ, অভিজ্ঞ ও আন্তরিক উদ্যোক্তা শ্রেণী আবশ্যক। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ দেশে তার অভাব রয়েছে।
২. দক্ষ ও পেশাদার ব্যবস্থাপকের অভাব (Insufficiency of shilled and professional managers): কোম্পানি প্রতিষ্ঠানের বিশেষত বৃহদায়তন পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির পরিচালনা পদ্ধতি জটিল হওয়ায় এর পরিচালনায় একদল দক্ষ ও পেশাদার ব্যবস্থাপকের প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থাপকের যথেষ্ট অভাব লক্ষণীয়।
৩. পরিচালকদের ইতিবাচক মনোভাবের অভাব (Lack of the positive mentality of directors): আমাদের দেশের অনেক কোম্পানি পরিচালকের ব্যবসায় পরিচালনায় ইতিবাচক মনোভাবের যথেস্ট অভাব লক্ষণীয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা, শেয়ারের দাম বাড়িয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি মানসিকতা সবাইকে হতাশ করে ।
৪. পরিচালনা ব্যয়ের আধিক্য (Excess management expenses): পরিচালকসহ এর উচ্চ পর্যায়ের অনেক ব্যবস্থাপকের মধ্যে অধিক ব্যয় করার হীন মানসিকতাও লক্ষণীয়। শেয়ারহোল্ডারদের প্রতি দায়িত্ববোধের অভাব থেকে এ ধরনের মানসিকতার সৃষ্টি হয়, যা সবাইকে হতাশ করে ।
৫. শক্তি সম্পদের অভাব (Lack of energy): বৃহদায়তন শিল্প কারখানা গড়ে তোলার জন্য বর্তমানকালে শক্তি সম্পদের প্রাচুর্যতা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতের দুরবস্থা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গঠনে উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করে।
৬. কার্যকর দৃষ্টান্তের অভাব (Absence of effective instance) : পৃথিবীর দেশে দেশে লক্ষণীয় যে, একটা উদ্যোক্তা গ্রুপ দেশে বৃহদায়তন শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছে। যাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণে অন্যরা এগিয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশে এই দৃষ্টান্তের বড়ই অভাব রয়েছে।
৭. কার্যকর ব্যবসায় পরিবেশের অনুপস্থিতি (Absence of effective business environment): আমাদের দুর্ভাগ্য হলো এই যে, দেশে ব্যবসায়ের কার্যকর কোনো পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। পাট, চামড়া ইত্যাদি শিল্প এক সময় এগুলেও পরবর্তীতে তা স্থায়ী হয়নি। সরকারের জাতীয়করণ নীতিও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সফল হয়নি। চোরাকারবারীও এক সময় ব্যবসায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
৮. শক্তিশালী শেয়ার বাজারের অনুপস্থিতি ( Absence of sound share market): যে কোনো দেশেই বৃহদায়তন কোম্পানি সংগঠন প্রতিষ্ঠায় শেয়ার বাজার নেতৃত্ব দেয়। এই বাজারের কারণে ক্ষুদ্ৰ বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে শেয়ার বাজার ফটকাবাজদের অভায়ারণ্যে পরিণত হওয়ায় এর সুফল কোম্পানিগুলো পাচ্ছে না।
মোটকথা বাংলাদেশে কোম্পানি সংগঠন এগিয়ে নেওয়ার মত পরিবেশ কার্যত সৃষ্টি হয়নি। নানান প্রতিকূল পরিবেশ দূরীকরণে যাদের উদ্যোগী হওয়ার কথা তাদের ভূমিকাতে বিনিয়োগকারীর অসন্তুষ্ট। তাই নানান প্রতিশ্রুতি আর কথার ফুলঝুরি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
বায়িং হাউজ ব্যবসায় ( Buying House Business) :
বর্তমানে দেশে পোশাক তৈরী শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। বিদেশ থেকে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারনত সরাসরি কোনো তৈরী পোশাক শিল্পে প্রতিষ্ঠানের সংঙ্গে যোগাযোগ করে না। তারা পণ্য কিনতে তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে বেছে নেয়। দু'পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে তাদের মধ্যে চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক দেশীয় প্রতিষ্ঠানটি ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ধরনের পণ্য সরবরাহ করার যাবতীয় দায়িত্বপালন করে । এই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকেই বায়িং হাউজ ব্যবসায় বলে ।
বায়িং হাউজ ব্যবসায় দিতে হলে লাগবে এ ব্যবসার বৈধ সনদ। এ জন্য প্রথমেই-
১. ট্রেড লাইসেন্স করে নিতে হবে।
২. BGMEA এর সদস্যপদ পেতে আবেদন করতে হবে।
আবেদনপত্রের সঙ্গে ট্রেড লাইসেন্সের কপি, মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেল বা অংশীদারি দলিলের কপি, পাসপোর্ট সাইজের দুই কপি ছবি, ভাড়ার চুক্তিপত্র বা ক্রয় দলিল, ট্যাক্স সার্টিফিকেটের কপি, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যয়নপত্র (যদি থাকে) বিনিয়োগ বোর্ডের ওয়ার্ক পার্মিট প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্যাডে স্বাক্ষর সহ জমা দিতে হবে। বায়িং হাউজের জন্য নিবন্ধন ফি ১৫ হাজার টাকা। এক বছরের সদস্য ফি ৮ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে জমা দিতে হবে ২৩ হাজার টাকা। BGMEA এর নির্ধারিত ব্যাংক হিসাব নম্বরে এ টাকা জমা দিতে হবে। সদস্যপদ নবায়নের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে সহযোগী সদস্য হিসেবে একবছরের জন্য সনদ দেয়া হয়। ফলে এক বছর পর সনদ নবায়ন করে নিতে হবে।
বর্তমানে দেশে BGMEA এর সদস্যভুক্ত বায়িং হাউজের সংখ্যা ৯১১টি এবং BGBA এর ১৭৯টি। এ দুই সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত নয় এমন বায়িং হাউজ রয়েছে প্রায় ৮ শত। অর্থাৎ সবমিলিয়ে দেশে বায়িং হাউজের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার।
শেয়ারবাজার বা স্টক এক্সচেঞ্জ (Stock Exchange)
স্টক এক্সচেঞ্জ একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শেয়ার বাজার সম্পর্কে ধারণা করতে হলে প্রথমেই জানতে হবে শেয়ার ও বাজার সম্পর্কে । অর্থাৎ—
শেয়ার বাজার হচ্ছে এমন একটি সংগঠিত মাধ্যমিক বাজার যেখানে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি গুলো শেয়ার, স্টক বা সিকিউরিটি নির্ধারিত নিয়মে ক্রয়-বিক্রয় করার প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত থাকে ।
ক্ষুদ্র ঋণ (Micro Credit)
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দক্ষ ব্যাংকিং ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু প্রায়ই বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলো সমাজের গরিব শ্রেণীর মানুষকে ঋণ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। আর এই গরীব শ্রেণীর মানুষকে ঋণ প্রদানের উদ্দেশ্যেই ক্ষুদ্র ঋণের উদ্ভব।
সাধারন অর্থে ক্ষুদ্র ঋণ বলতে বুঝায়, বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে সমাজের নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষকে অল্প পরিমাণ ঋণ প্রদান করাকে বুঝায়। ব্যাপক অর্থে ক্ষুদ্র ঋণ বলতে বুঝায়, সঞ্চয়, ঋণ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক পরিসেবা বা উৎপাদন, যার সামান্য পরিমাণে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষ, শহর বা শহরতলির মানুষদের অর্থনৈতিক এবং জীবন ধারনের মান উন্নয়নে সাহায্য করতে পারবে আর ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা হল সেই সংস্থা যারা এই ধরনের অনুদান দিয়ে থাকে ।
ক্ষুদ্র ঋণ ধারণাটি সর্বপ্রথম আনেন বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ডঃ মোহাম্মদ ইউনুস। তিনি ১৯৭৬ সালে সর্ব প্রথম তার নিজ গ্রাম জুবরায় পরীক্ষামূলক ভাবে এই ঋণ চালু করেন। পরবর্তীতে এটির সাফল্যের কারণে ১৯৮৩ সালে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্ষুদ্র ঋণের প্রচলন শুরু হয়। তাই ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৮০০ এর উপর ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাক বিশ্বব্যাপী পরিচিত। বিশ্বের অনেক দেশ ক্ষুদ্র ঋণকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছে। এজন্য জাতিসংঘ ২০০৫ সালকে আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র ঋণের বছর হিসেবে ঘোষণা করেছিল।
বিকাশ (Bkash)
বাংলাদেশের প্রথম স্বয়ংসম্পূর্ণ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশ লিমিটেড ব্র্যাক ব্যাংকের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সম্প্রতি কার্যক্রম শুরু করেছে। মোবাইলের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা জনসাধারণের কাছে আর্থিক সেবা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে বিকাশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিকাশের প্রধান সুবিধা হচ্ছে, এটি টাকা পাঠানোর জন্য নিরাপদ, সুবিধাজনক একটি মাধ্যম । ব্র্যাক ব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মানি ইন মোশন এর যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিকাশের মাধ্যমে ব্র্যাক ব্যাংক কোডবদ্ধ ভিসা টেকনোলজি প্লাটফর্ম ব্যবহার করে, তাই এটি অনেক নিরাপদ ।
বিকাশের মাধ্যমে একজন গ্রাহক অতি দ্রুত টাকা পাঠাতে পারে। এই জন্য বিকাশ পয়েন্টে গিয়ে যেখানে টাকা পাঠাতে চায় সেই মোবাইল নম্বর জানাতে হবে। তারপর বিকাশ পয়েন্ট থেকে ঐ ফোন নম্বরে মেসেজের মাধ্যমে টাকা পৌছে যাবে। মেসেজ পাওয়ার সাথে সাথে গ্রাহককে টাকা পরিশোধ করা হয়। এইজন্য অবশ্য নির্দিষ্ট হারে চার্জ দিতে হয়।
আউটসোর্সিং ব্যবসা (Outsourcing Business)
আউটসোর্সিং তথা ফ্রিল্যান্সিং শব্দের মূল অর্থ হল মুক্ত পেশা। অর্থাৎ মুক্তভাবে কাজ করে আয় করার পেশা । ইন্টারনেট ব্যবস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের কাজ করিয়ে নেয়। নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কাউকে দিয়ে এসব কাজ করানোকে আউটসোর্সিং বলে। যারা আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে দেন তাদেরকে
ফ্রি-ল্যান্সার বলে ।
আউটসোর্সিং ব্যবসায়ের কাজগুলো বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা থাকে। যেমন: ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, নেটওয়ার্কিং ও তথ্যব্যবস্থা, লেখা ও অনুবাদ, প্রশাসনিক সহায়তা, ডিজাইন ও মাল্টিমিডিয়া, গ্রাহকসেবা, বিক্রয় ও বিপণন, ব্যবসাসেবা ইত্যাদি। এইসকল কাজগুলি ইন্টারনেট ব্যবসায়ের মাধ্যমে করে
দিতে পারলেই অনলাইনে আয় করা সম্ভব ।
আউটসোর্সিং এর কাজ পাওয়া যায় এমন অনেক ওয়েবসাইট আছে। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত এবং নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সাইট হলো- www.odesk.com, www.elance.com, www.vworker.com ইত্যাদি ।
ডাটা এন্ট্রি ব্যবসা (Data Entry Business)
ডাটা এন্ট্রি ব্যবসায় হল কম্পিউটারের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ধরনের ডাটা এক স্থান/প্রোগ্রাম থেকে অন্য আরেকটি স্থান/প্রোগ্রাম এ প্রতিলিপি তৈরি করা । ডাটা এন্ট্রি ব্যবসায়ে মূলত অনলাইন এবং অফলাইন ভিত্তিক দুটি উপায়ে কাজের সুযোগ রয়েছে। অনলাইন ভিত্তিক কাজে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরাসরি ডাটাসমূহ প্রদান করতে হবে এবং অফলাইনে প্রদানকৃত ডাটাসমূহ নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী সম্পাদন করতে হবে।
ডাটা এন্ট্রি ব্যবসায়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা—
ডাটা এন্ট্রি ব্যবসায়ে বিভিন্ন ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন হয়:
i. দ্রুত টাইপ করার ক্ষমতা
ii. মাইক্রোসফট অফিসের উপর পরিপূর্ণ দখল
iii. ইংরেজিতে ভাল জ্ঞান
iv. ইন্টারনেটে সার্চ করার দক্ষতা
v. বিভিন্ন ধরনের ওয়েবসাইট, ফোরাম, ওয়েব ডিরেক্টরি সম্পর্কে ভালো ধারনা
ডাটা এন্ট্রি ব্যবসায়ে বাংলাদেশের অবস্থান পূর্বের তুলনায় দিনদিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। উন্নত বিশ্বেও দেশগুলো তাদেও ডাটা-এন্ট্রির কাজগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে করিয়ে নিচ্ছে। আমাদের দেশ যদি ডাটা-এন্ট্রির বিশ্ব বাজারে প্রবেশ করে তবে স্বল্প প্রশিক্ষণে প্রচুর কর্মসংস্থান এবং আয় করা যাবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।
কল সেন্টার (Call Center)
কল সেন্টার হচ্ছে টেলিকমিউনিকেশনের মাধ্যমে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। কল সেন্টারগুলো বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এসব কোম্পানির সুযোগ-সুবিধা, কার্যক্রম প্রাহকদের টেলিকমিউনিকেশনের মাধ্যমে জানায়। অর্থাৎ, কোন কোম্পানি তার গ্রাহকসেবা সম্পর্কিত তথ্য জনসাধারনকে জানানোর জন্য অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়। আর এই দায়িত্বপালনকারী প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে কল সেন্টার।
কল সেন্টারে কাজ হয় দুইভাবে। একটি ইন বাউন্ড কল এবং অন্যটি আউট বাউন্ড কল। ইন বাউন্ড কলের মাধ্যমে ভোক্তার নির্দিষ্ট কোম্পানি বিষয়ক যেকোন প্রশ্নের সমাধান বলে দেয়া হয়। আর আউট বাউন্ড কলের মাধ্যমে কোম্পানির পণ্য বা সেবা বিক্রয় করা হয়। এছাড়া ডকুমেন্ট ম্যানেজমেন্ট, পরামর্শ, ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট, হিসাব সংরক্ষণ, ডকুমেন্ট স্ক্যানিং, ই-পাবলিশিং ইত্যাদি কাজও কল সেন্টারের মাধ্যমে করা হয় । কল সেন্টারগুলো দেশি অথবা বিদেশি দু'ধরনের কোম্পানির হয়েই কাজ করে । যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ পেশা নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে। এমনি একটি নতুন পেশার ক্ষেত্র কল সেন্টার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এজন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দেবার উদ্যোগও নিয়েছে। সম্ভাবনাময় এ পেশায় রয়েছে কাজের বিশাল সুযোগ ।
কুরিয়ার সার্ভিস (Couriar Service)
সরকারি ডাক বিভাগের পাশাপাশি বেসরকারি যে মাধ্যমের সাহায্যে দ্রুত ও বিশ্বস্ততার সাথে চিঠি পত্র ও মালামাল একস্থান হতে অন্যস্থানে প্রেরণ করা হয় তাকেই কুরিয়ার সার্ভিস বলে। মূলত ডাক বিভাগের ব্যর্থতা ও অপ্রতুলতার কারনেই এই ব্যবস্থার উদ্ভব।
ইংরেজি কুরিয়ার (Courier) শব্দের অর্থ দ্রুত বা সংবাদবাহক আর সার্ভিস শব্দের অর্থ হল সেবা। সুতরাং শাব্দিক অর্থে কুরিয়ার সার্ভিস বলতে সংবাদ আদান-প্রদানের বাহক হিসেবে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে বুঝায়। ব্যপকভাবে কুরিয়ার সার্ভিস বলতে ডাক বিভাগের পাশাপাশি বেসরকারি এমন প্রতিষ্ঠানকে বুঝায় যারা বাহক আইনের অধিনে চিঠি পত্র, দলিল দস্তাবেজ, জরুরি ডকুমেন্টস, বিভিন্ন মালামাল ও উপহার সামগ্রী ইত্যাদি বিশ্বস্ততার সাথে দ্রুতগতিতে প্রাপকের নিকট পৌছে দিয়ে থাকে।
১৯৬৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে DHL নামক একটি কুরিয়ার সার্ভিস যাত্রা শুরু করে। ক্যালিফোর্নিয়ার ৩ বন্ধু Adrin Dalsey Larry, Hilbolm ও Robert Lay মিলে দ্রুত সংবাদ ও তথ্য আদান- প্রদানের জন্য নামক কুরিয়ার সার্ভিস চালু করেন। তিন বন্ধুর নামের অদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত DHL নামক কুরিয়ারটি ছিল পৃথিবীর প্রথম কুরিয়ার। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে DHL নামক এ কুরিয়ারটি বর্তমানে নিজস্ব এয়ারপোর্ট ও বিমানের সহযোগিতায় প্রায় ১১৮টি দেশে সেবা প্রদান করে চলেছে। DHL এর সাথেই তাল মিলিয়ে চলছে আরেকটি আন্তর্জাতিক মানের কুরিয়ার সার্ভিস FedEx। উন্নত বিশ্বের ন্যায় এরপর বাংলাদেশেও DHL এবং FedEx কুরিয়ারের পাশাপাশি অন্যান্য বিভিন্ন কুরিয়ার যেমন কন্টিনেন্টাল, সুন্দরবন কুরিয়ার, বৈশাখী, পাইওনিয়ার, সেন্ট্রাল, ড্রিমল্যান্ড, ডলফিন, করতোয়া ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার সাথে তথ্য আদান-প্রদান করে চলেছে। বাংলাদেশের কুরিয়ারগুলো শুধু জেলা শহর, কিছু উন্নত যোগাযোগ সমৃদ্ধ থানায় তাদের কার্যক্রম সর্বোচ্চ ২৪ ঘন্টায় তথ্য পরিবেশন করে থাকে।
সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস (Sundarban Courier Service)
বাংলাদেশের প্রথম এবং দ্রুত কুরিয়ার সার্ভিস হচ্ছে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস। বাংলাদেশ বিমান যখন তার এয়ার এক্সপ্রেস সার্ভিস বন্ধ করে দেয় তখন ১৯৮৩ সালে বেসরকারিভাবে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠিত হয়। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস হচ্ছে বাংলাদেশ কুরিয়ার সার্ভিস এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। এর কেন্দ্রীয় অফিস ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত। এটি দেশ-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে দ্রুত ও পার্সেল সার্ভিস প্রদান করে থাকে।
কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিস (Continantal Courier Serive)
কন্টিনেন্টাল সার্ভিস দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন স্থানে মানুষের বিভিন্ন পার্সেল সংশ্লিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌঁছে দিয়ে থাকে। এটি কন্টিনেন্টাল গ্রুপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৩ সালে এটি তার বাণিজ্যিক কার্যক্রম আরম্ভ করে। এর এজেন্সীর সংখ্যা ১৫,০০০ এবং সার্ভিস পয়েন্ট ৫০,০০০। কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিসের মার্কেট শেয়ার এবং সেবার গুনাগুন অন্যান্য কোম্পানি থেকে ভিন্ন। তাই এটিকে কুরিয়ার সার্ভিসের অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয় । এটির প্রধান অফিস ঢাকার আরামবাগে অবস্থিত।
সফটওয়্যার উন্নয়ন (Software Development)
কম্পিউটার সফটওয়্যার বলতে একগুচ্ছ কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কর্মপদ্ধতি ও ব্যবহার বিধিকে বোঝায়, যার সাহায্যে কম্পিউটারে কোন নির্দিষ্ট প্রকারের কাজ সম্পাদন করা যায়। সফটওয়্যার প্রধানত তিন প্রকার –
i. সিস্টেম সফটওয়্যার:
একটি কম্পিউটার সফটওয়্যার যা কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারকে পরিচালনা করার জন্য এবং এপ্লিকেশন সফটওয়্যারগুলোকে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ প্রদানের জন্য তৈরী করা হয়েছে।
ii. প্রোগ্রামিং সফটওয়্যার:
এক ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রাম অথবা এ্যাপ্লিকেশন যা সফটওয়্যার উন্নয়নকারীরা ব্যবহার করে থাকেন কোন সফটওয়্যার তৈরী, ডিবাগ, নিয়ন্ত্রণ, রক্ষনাবেক্ষণ অথবা অন্য প্রোগ্রাম বা এপ্লিকেশনগুলোকে সহযোগিতা করতে।
iii. এপ্লিকেশন সফটওয়্যার:
এটি একটি কম্পিউটার সফটওয়্যার যেটা ব্যবহারকারীরা প্রয়োজন অনুযায়ী এবং নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনা (এক বা একাধিক) করতে ব্যবহারকারীকে সহায়তা করে থাকে । একে শুধু এপ্লিকেশন বা এপ (App) ডাকা হয়।
মোবাইল সার্ভিসিং (Mobile Servicing)
বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার প্রথম দিকে শুধু ধনীদের ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কম মূল্যে সেবাদানের কারণে অতি দ্রুত হারে সবার হাতেই পৌছে যাচ্ছে মুঠোফোন বা মোবাইল। ধনী-গরিব নিজেদের সাধ্যানুযায়ী মোবাইল সেট ব্যবহার করছে। মোবাইল ফোন সেটটি ব্যবহারজনিত বিভিন্ন কারণে কিংবা অসাবধানতাবশত নষ্ট হতে পারে। এজন্য ঢাকা সহ সারা দেশে কয়েক হাজার মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। যার ফলে মোবাইল ফোনের সমস্যা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা অনেকটাই কমে গেছে। ধীরে ধীরে মোবাইল সার্ভিসিং একটি পৃথক শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।নিজেকে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার একটি সফল উপায় হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে মোবাইল সার্ভিসিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে। এসব প্রশিক্ষণ সেন্টারে মূলত যে কোন মোবাইলের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার সংক্রান্ত সব ধরনের সমস্যা এবং সমাধানের উপায় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ কোর্স গুলোকে শর্ট কোর্স, ডিপ্লোমা এবং হায়ার ডিপ্লোমারূপে বিভক্ত করে একজন প্রশিক্ষণার্থীদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ প্রদান করে। প্রতিষ্ঠানগুলো মোবাইলে ব্লু-টুথের মাধ্যমে রিং-টোন আদান-প্রদান, এমপিথ্রি, ভিডিও, ইমেজ ডাউনলোড, সফটওয়্যার ইনস্টলেশন, মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার ইনস্টলেশন, মোবাইলের আনলক, ডাটা কেবল সমস্যা এবং হার্ডওয়্যারের ক্ষেত্রে রেজিস্টার, ক্যাপাসিটার ডায়েড ট্রান্সফর্ম, বিভিন্ন ধরনের সার্কিট ও সেগুলোর কানেকশন ডায়াগ্রাম, সিকিউরিটি কোড সহ বিভিন্ন ধরনের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান টেলিকম বাজারের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় পেশা হিসেবে মোবাইল টেকনিশিয়ানের পদটিকে মোটেও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টারে ৩ থেকে ১০ জন মোবাইল টেকনিশিয়ানের চাকুরির সুযোগ রয়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশে দক্ষ মোবাইল টেকনিশিয়ানের চাকুরির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এছাড়া মোবাইল সার্ভিসিং ট্রেনিং নিয়ে যে কেউ স্বাধীন ব্যবসায় হিসেবে স্বল্প পুঁজিতে সার্ভিসিং সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে জীবনে সফলতা আনতে পারে। স্বাবলম্বী হতে হলে মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার স্থাপন করা সম্ভব হয় মাত্র ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা খরচ করার মাধ্যমে। দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা সমাধানে মোবাইল সার্ভিসিং শিল্পের প্রসার বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন মোবাইল ফোন সার্ভিসিং শিল্পকে আরও গতিশীল করে তুলতে পারে, ঠিক তেমনি এর মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে অসংখ্য বেকার তরুণ ।
ফটোকপি (Photocopy)
বর্তমান যুগকে বলা হয় যান্ত্রিক যুগ। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার থিউরি অনুযায়ী অফিস আদালতের কাজ এখন আর কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে করতে হবে না বরং নির্দেশ অনুযায়ী যন্ত্রই সমস্ত কাজ করে দিবে। আজকাল তাই অফিসের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় যে সকল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় ফটোকপি বা ফটোস্ট্যাট যন্ত্রটি তাদের অন্যতম ।
ইংরেজি Photocopier বা Photostat শব্দে Photo শব্দের অর্থ আলোকচিত্র আর stat শব্দের অর্থ অবস্থা। অর্থাৎ ফটোস্ট্যাট শব্দ দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের আলোকচিত্রগত অবস্থাকে বুঝায়। অফিসে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের চিঠিপত্র, রেকর্ডপত্র, প্রতিবেদন, বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞপ্তি, দলিলপত্র, প্রমানপত্র, ক্যাশমেমো ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবহৃত ঐ সকল কাগজপত্রের হুবহু নকল কপির প্রয়োজন হয়। সুতরাং যে মেশিন বা যন্ত্র দ্বারা ব্যক্তিগত বা অফিস আদালতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কাগজ প্রত্রের হুবহু অনুলিপি আলোকচিত্রের সাহায্যে প্রস্তুত করা হয় তাকে ফটোকপিয়ার বা ফটোস্ট্যাট মেশিন বলে ।
এ মেশিনের সুবাদে আজকাল অনেক ধরনের জালিয়াতি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি অফিস আদালতের কাজ কর্মেও এসেছে গতিশীলতা। ফটোকপিয়ার যন্ত্রের সাহায্যে অল্প সময়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের হুবহু প্রতিলিপি প্রস্তুত করা যায়। বিভিন্ন ধরনের ফটোকপি মেশিন বাজারে পাওয়া যায়। কিছু যন্ত্র আছে যার দ্বারা কপির সাইজ ইচ্ছামত ছোট বড় করা যায় আবার কিছু যন্ত্র আছে যার দ্বারা রঙিন ফটোকপি করা যায়। অতি সম্প্রতি জাপান স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র আবিষ্কার করেছে যা ব্যবহারকারী ছাড়া নিজে- নিজেই কপির পৃষ্ঠা উল্টাতে সক্ষম।
কম্পিউটার (Computer)
আধুনিক বিজ্ঞানের সব আশ্চর্যতম আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হচ্ছে কম্পিউটার যা মানুষের জীবনধারাকে প্রতিনিয়ত পাল্টে দিচ্ছে।
আধুনিক বিশ্বে কম্পিউটারের গুরুত্ব অপরিসীম। কম্পিউটারের দ্রুত বিকাশ ও ব্যবহার সভ্যতা ও সামাজিক জীবনে নিয়ে আসছে ব্যাপক পরিবর্তন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার অনেক সুফল বয়ে আনছে। উৎপাদনমুখী উন্নয়ন হচ্ছে ত্বরান্বিত, তথ্য প্রক্রিয়াকরণে ঘটছে নতুন ধারার প্রবর্তন, গতিশীলতা বাড়ছে সর্বক্ষেত্রে। কম্পিউটার এখন অফিস-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও গবেষণার দেয়ালে আবদ্ধ নেই। এখন ব্যাপকভাবে গৃহকোণেও ঠাঁই নিয়েছে। কম্পিউটার ছাড়া সভ্যতার অগ্রগতি ভাবাই যায় না। উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ, ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যবস্থাপনা, প্রকাশনা, শিক্ষা, গবেষণা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, শিল্প, বিনোদন, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমাজের সর্ব ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে কম্পিউটার ব্যবহৃত হচ্ছে ।
মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটারের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যক্তিগত কাজে আর সামাজিক কাজে কম্পিউটারের ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে পরেছে। যেমন ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনা ইত্যাদি শেয়ার করার জন্য কম্পিউটার নির্ভর বিনোদন ব্যবস্থা, লেখালেখি করা ও যোগাযোগের জন্য সহজলভ্য ও সুলভ মাধ্যম তৈরি করে দিয়েছে কম্পিউটার। মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার, ইন্টারনেট নির্ভর চ্যাটিং ব্যবস্থা সামাজিক সম্পর্ক বিকাশের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কম্পিউটারের ব্যবহার দিন দিন এত বিস্তৃত হচ্ছে যে, ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনের যে কোন কর্মকান্ডে এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
মানিগ্রাম (Money gram)
মানিগ্রাম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থ স্থানান্তরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এটি বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। এটি বিশ্বব্যাপি প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং গ্রাহকদেরকে সেবা প্রদান করে থাকে। এটি প্রায় ২,৭৫,০০০ প্রতিনিধির মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় ১৯৭ টি দেশে তার সেবা প্রদান করে থাকে । মানিগ্রামের সেবা, ব্যবসায়ীদের দক্ষ এবং অল্প ব্যয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করতে সহায়তা করে। কোম্পানিটির ৮২% মালিকানা হচ্ছে THL এবং Goldman Sachs এর; যার মধ্যে THL এর ৫৩% এবং Goldman Sachs এর ২৯%। মানিগ্রামে বর্তমানে প্রায় ২৬০০ কর্মী নিয়োজিত রয়েছে। ২০০৯ সালে কোম্পানিটি প্রায় ১.১৭ বিলিয়ন ডলার আয় করে। ২০১২ সালের ৯ই নভেম্বর এটি মানিলন্ডারিং আইনে স্বাক্ষর করে ।
মানিগ্রামের উল্লেখযোগ্য সেবাসমূহ:
i. মানিগ্রাম অর্থ স্থানান্তর: মানিগ্রাম বিশ্বব্যাপি থার্ড পার্টি এজেন্ট এর মাধ্যমে ভোক্তাদের অর্থ গ্রহণ ও স্থানান্তরে সহায়তা করে থাকে। ক্যাশ টু ক্যাশ ছাড়াও এটি সরাসরি ব্যাংক হিসাবে, এটিএম এর মাধ্যমে, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে, কিয়োশকস (Kiosks) এর মাধ্যমে, ক্যাশ কার্ডের মাধ্যমে অর্থ আদান-প্রদানে সহায়তা করে থাকে।
ii. মানিগ্রাম বিল পরিশোধ সেবা: মানিগ্রাম তার বিল পরিশোধ সেবার মাধ্যমে ভোক্তাদের বিভিন্ন জরুরী বিল ও নিয়মিত বিল পরিশোধ করে থাকে। এটি বিভিন্ন ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক রাখে ।
মার্চেন্টডাইজিং (Merchandising)
যারা গার্মেন্টস ব্যবসায়ের সাথে জড়িত তাদের কাছে মার্চেন্টডাইজিং শব্দটি অতি পরিচিত। মার্চেন্টডাইজিং শব্দটি আসছে মার্চেন্টডাইজ শব্দ হতে। মার্চেন্টডাইজ শব্দের অর্থ পণ্যদ্রব্যকে বুঝায় যেগুলো কেনা বা বেচা হয়। মার্চেন্টডাইজ সেই সকল কার্যাবলীর সাথে সম্পর্কযুক্ত যা পণ্যদ্রব্য খুচরা ভোক্তাদের নিকট বিক্রয়ে অবদান রাখে। মার্চেন্টডাইজিং বলতে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে পণ্য দ্রব্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে এবং ঐ পণ্যগুলো এমন ভাবে উপস্থাপন করে যা ক্রেতাদেরকে ঐ পণ্যগুলো কিনতে উৎসাহিত করে ।
বাংলাদেশে মার্চেন্টডাইজিং ব্যবসায়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি মার্চেন্টডাইজিংকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছে।
মার্চেন্টডাইজিং এর ভূমিকা—
নিবন্ধিত, বিধিবদ্ধ দায়সম্পন্ন বৃহৎ আকারের ব্যবসায় সংগঠন কোম্পানি সংগঠন। এটি অনেকগুলো সুবিধা ভোগ করলেও বিভিন্ন দিক বিচারে এর বেশ কিছু অসুবিধাও দৃষ্ট হয়। নিম্নে এসব অসুবিধাসমূহ আলোচিত হলো:
১। গঠনে জটিলতা (Complexity in formation): বিশেষত সার্বজনীন কোম্পানি গঠন করা বেশ জটিল। এজন্য বেশ কিছু আনুষ্ঠানিক ও আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করার পর এ কোম্পানি গঠন করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ এটি গঠন করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ।
২। অতি বৃহৎ আকার (Gigantic size): যৌথমূলধনী ব্যবসায়ের আয়তন এত বৃহৎ আকার ধারণ করে যে, এটি পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কষ্টকর হয়।
৩। স্বজনপ্রীতি (Nepotism): পরিচালকগণের মধ্যে উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার পরিবর্তে স্বজনপ্রীতির প্রবণতা বেশি থাকে ।
৪। মালিকানা ব্যবস্থাপনায় বিচ্ছেদ Divorce between ownership ও and management): এ ধরনের কোম্পানিতে শেয়ারহোল্ডারগণ সরাসরি ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করে না। ফলে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় বিচ্ছেদ দেখা দেয় ।
৫। শেয়ার বাজেয়াপ্তকরণ (Forfeiture of shares): শেয়ারের তলবী অর্থ অনাদায়ী থাকলে পরিচালকমণ্ডলী পরিমেল নিয়মাবলি অনুসারে পরিচালকমণ্ডলীর সভায় প্রস্তাব পাস করে এটি বাজেয়াপ্ত করতে পারে। যেসব শেয়ার বাজেয়াপ্ত করা হয় এর প্রদত্ত অর্থ ফেরত দেয়া হয় না, ফলে শেয়ারহোল্ডরগণ বঞ্চিত হয় ।
৬। একচেটিয়া উদ্ভব (Growth of monopoly): বৃহদায়তন কোম্পানিগুলো ব্যবসায় সম্প্রসারণ করতে করতে এমন অবস্থায় এসে দাঁড়ায় যে, তারা তখন একচেটিয়া ব্যবসায় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
৭। শ্রমিক শোষণ (Exploitation of workers): বৃহদায়তন কোম্পানিগুলোর দরকষাকষির ক্ষমতা অধিক থাকায় তারা কর্ম পরিবেশকে দূষিত করে শ্রমিক শোষণ করতে থাকে ।
৮। শ্রমিক-মালিক বিরোধ (Dispute between labour and owner): কোম্পানি পরিচালনার ভার পেশাদারি পরিচালকদের হাতে থাকায় শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে বিরোধ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে ।
৯। সমন্বয়ের অভাব (Lack of co-ordination): বৃহদায়তন কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাব থাকে । ফলে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন হ্রাস পায় ।
১০। সরকারি নিয়ন্ত্রণ (Government Control): বৃহদায়তন কোম্পানিগুলোর কাজকর্মের উপর সরকারি নিয়ম-কানুন আরোপ করা হয়। বস্তুতঃপক্ষে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে, বিভিন্ন দুর্নীতির অবসান ঘটাতে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ খুবই উপযোগী। কিন্তু সরকারি প্রশাসনে গলদ থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করা হয়। ফলে কোম্পানির স্বাভাবিক কাজকর্মে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয় ।
পরিশেষে বলা যায়, যদিও এ ব্যবসায়ের অনেকগুলো অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে তবুও তুলনামূলক বিচারে এর সুবিধাই অনেক বেশি। সতর্কতার সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে এর অনেকগুলো সীমাবদ্ধতাই দূর করা সম্ভব। তাই সকল দেশেই এটি একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে ইতোমধ্যেই তার স্থান করে নিয়েছে।
“দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ”-এ চিন্তাধারা হতেই সমবায়ের জন্ম, সমবায় সংগঠন বা সমিতি হলো কতিপয় ব্যক্তির একটি স্বেচ্ছামূলক সংগঠন। এধরনের সংগঠনে সদস্যরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়ে থাকে। এটি এমন এক ধরনের ব্যবসায় সংগঠন যা মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে সৃষ্টি না হয়ে সদস্যদের পারস্পরিক কল্যাণার্থে সৃষ্টি হয়। সমবায় সমিতি গঠনের মাধ্যমে সমাজে পুঁজিপতিদের শোষণ হতে অপেক্ষাকৃত দূর্বল শ্রেণির মানুষদের কল্যাণ সাধন করা হয় ।
এ অধ্যায় পাঠশেষে আমরা জানতে পারব—
সূত্র: ক্যামব্রিয়ান পাবলিকেশন্স
রংপুরের মাহীগঞ্জ নিবাসী কতিপয় আখচাষী মিলে একটি সংগঠন গঠনের উদ্যোগ নেয়। তারা স্থানীয় সমবায় অধিদপ্তরে সমিতি নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে এবং প্রয়োজনীয় দলিলপত্র জমা দেয়। তবে দীর্ঘ তিনমাস অতিবাহিত হলেও উক্ত সংঘঠন নিবন্ধন হয়নি। এমতাবস্থায় বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে নিবন্ধকের অফিস থেকে উপবিধির কিছু সমস্যার কথা বলা হয় ।
সপ্তদশ শতকের শেষভাগ থেকে সমবায় সংগঠনের ভাবনা দানা বাঁধলেও শিল্প বিল্পবের শুরুর পর এ চিন্তা বাস্তবরূপ লাভ করে । ১৭৫২ সনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সমবায় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বৃটেনে আনুষ্ঠানিকভাবে সমবায় গঠিত হয় ১৮৪৪ সালে। এ সময়ে বৃটেনের রচডেল নামক স্থানের ২৮ জন তাঁতী মাত্র ২৮ পাউন্ড পুঁজি সহযোগে এ ধরনের ব্যবসায় গড়ে তোলে। এর পর সমবায় এক আন্দোলনে রূপ নেয় যার ঢেউ বাংলাদেশেও এসে লেগেছে। বাংলাদেশে সমবায় সমিতি বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে দুর্বল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণের জন্য সমবায়ের যে উদ্দেশ্য তা বাস্তবায়নে সমষ্টিগতভাবে বহুসংখ্যক মানুষের সহযোগিতায় তা সহজেই করা সম্ভব হয়, এটাই সমবায়ের মূল কথা। অর্থাৎ মুনাফা অর্জন নয়-পারস্পারিক কল্যাণসাধনই এ সমবায়ের মূল লক্ষ্য।
সমবায় একটি আইন সৃষ্ট, অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ব্যবসায় সংগঠন। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট পেশাজীবীরা উদ্দেশ্য অর্জনে উৎসাহ বা শক্তি পায়। এটি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি সংগঠন। বাংলাদেশে সমবায় আইন-২০০১ অনুসারে সমবায় সংগঠন গঠিত ও পরিচালিত হয়। নিম্নে সমবায় সমিতির বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করা হলো—
পরিশেষে বলা যায় যে, সমবায় সমিতি আইনের অধীন গঠিত, পরিচালিত, পৃথক সত্তা ও সীমিত দায় বিশিষ্ট একটি স্বেচ্ছা প্রণোদিত ব্যবসায় সংগঠন। এর সদস্যরা গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুসরণে পরিচালিত হয় যার মূল লক্ষ্য হলো এর সদস্যদের আর্থিক কল্যাণ নিশ্চিত করা।
নীতিমালা শব্দটির ইংরেজি শব্দ হলো Principles একে guidence for action বলা যায়। সমবায় সংগঠনও কিছু নীতি বা আদর্শ মেনে চলে। একটি ভিন্নধর্মী ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে সমবায় সংগঠন সমাজের মধ্য ও নিবিত্ত, সম্পন্ন মানুষের নানান সীমাবদ্ধতা নিয়ে পারস্পারিক অর্থনৈতিক কল্যাণের লক্ষ্যে গঠিত ও পরিচালিত হয়। যেসব আদর্শ বা নীতিমালা মেনে সমবায় সমিতি পরিচালিত হয় সেগুলো নিম্নে বর্ণিত হল-
১। একতা (Unity): একতাই বল। সমাজের দরিদ্র ব্যক্তি একতাবদ্ধ হলে ধনীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনায়াসে দাঁড়াতে পারে। একতাই মূলত সমবায়ের সাফল্যের মূল স্তম্ভ।
২। সততা (Honesty): সমবায় সমিতিতে সততা একান্ত প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানে সততা বিরাজমান হলে সদস্যদের মনে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করতে হলে সততা একান্ত অপরিহার্য।
৩। স্বেচ্ছাকৃত মিলন (Voluntary Association): সমবায় সমিতির সদস্যদের মধ্যে সর্বাধিক ব্যক্তি স্বাধীনতা দেয়া হয়। কোনো প্রকার হুমকি বা প্ররোচনা ছাড়া তারা সমবায়ের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় মিলিত হতে পারে ।
৪। সহযোগিতা (Co-operation): সহযোগিতা সমবায়ের একটি অন্যতম নীতি। পারস্পরিক কল্যাণের লক্ষ্যে সমবায়ের সদস্যদের মধ্যে ‘দশে মিলে করি কাজ' অথবা ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে' এরূপ মনোভাব থাকা প্রয়োজন। কেননা একমাত্র সহযোগিতাই সাফল্য লাভের অন্যতম চাবিকাঠি।
৫। গণতন্ত্র (Democracy): সমবায় সমিতিতে সর্বদাই গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসৃত হয়। এ সমিতির ‘পরিচালক কমিটি’ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। সিদ্ধান্তও ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রত্যেক সদস্য স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে।
৬। সমঝোতা (Understanding): সমবায়ের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সমঝোতা অপরিহার্য। কারণ ত্যাগের মনোভাব ছাড়া সমবায় সমিতি টিকে থাকতে পারে না। আর এজন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সমঝোতা ।
৭। সাম্য (Equality): সমবায় সমিতি সাম্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত। এর সদস্যরা সামাজিক, অর্থনৈতিক বা পারিবারিকভাবে যাই হোক না কেন সমবায়ের সদস্য হিসেবে তারা সবাই সমান সামাজিক মর্যাদার অধিকারী। নিজেদের মধ্যে এধরনের সাম্য প্রতিষ্ঠা করা না গেলে সমবায় সাফল্য লাভ করতে পারে না ।
৮। সেবা (Service): সমবায়ের মূলকথা হলো ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে' । একে অপরের সহযোগিতার ভিত্তিতে এ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই বলা যায়, প্রত্যেকের মধ্যে একটি সহযোগিতামূলক মনোভাব থাকা আবশ্যক ।
৯। নৈকট্য (Proximity): সমবায় সমমনা ব্যক্তিবর্গের সংগঠন। তাই এর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নৈকট্যের বিষয়টি বিবেচনা করতে হয় । সদস্যরা সমমনা না হলে প্রতিষ্ঠান চালাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হতে হয় ।
১০। সম-ভোটাধিকার (Equal right of votes): সম-ভোটাধিকার সমবায় সমিতির অন্যতম মূলনীতি । প্রতিষ্ঠানে যে যত বিনিয়োগ করুক না কেন সবার ভোটাধিকার সমান। এক্ষেত্রে সকলে একটি করে ভোট প্রদান করে কার্যকরী কমিটি নির্বাচন করে থাকেন ।
১১। নিরপেক্ষতা (Secularism): সমবায়ের ক্ষেত্রে ধর্ম ও রাজনৈতিক মতাদর্শের নিরপেক্ষতা বজায় থাকে। ফলে ধর্ম ও রাজনৈতিক মত নির্বিশেষে সকলেই এর সদস্য হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায় যে, সমবায়ে সফলতা অর্জন করতে হলে উক্ত মূলনীতি বা আদর্শসমূহ যথাযথভাবে অনুসরণ করা উচিত। এর অধিকাংশই একে অন্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত কার্যক্ষেত্রে এর সবগুলো সমানভাবে অনুসরণ করতে হয়। যে সমবায় উক্ত আদর্শসমূহ যত বেশি অনুসরণ করতে পারে বাস্তবে তার পক্ষেই তত সফলতা অর্জন সম্ভব হয়।
সমবায় সমিতি একটা আইন-সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তাবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান। একাধিক ব্যক্তি নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এ সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে থাকে। বাংলাদেশের সমবায় সমিতিসমূহ “সমবায় সমিতি ২০০১” এবং “সমবায় বিধি ২০০৪” বলে গঠিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সমমনা ও সমস্বার্থবিশিষ্ট কমপক্ষে ১০ জন সদস্যকে সমিতি গঠনের জন্য সম্মত হতে হয় বয়স যাদের ১৮ বছর বা তার ঊর্ধ্বে।
নিম্নে এরূপ প্রতিষ্ঠান গঠনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপসমূহ আলোচনা করা হলো :
সমবায় সমিতি গঠনের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণকারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে অভিহিত করা হয়। একই এলাকার সমমনা, সমপেশা ও সমশ্রেণির কমপক্ষে ২০ (বিশ) জন উদ্যোক্তা সমিতি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। উদ্যোক্তাদেরকে অবশ্যই প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন অর্থাৎ চুক্তি সম্পাদনে যোগ্য হতে হবে। উদ্যোক্তারা প্রথমেই নিজেদের মধ্য হতে কমপক্ষে ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে। ব্যবস্থাপনা কমিটির পদগুলো নিম্নরূপ—
i.চেয়ারম্যান -১ জন
ii. ভাইস চেয়ারম্যান- ১ জন
iii. সেক্রেটারি - ১ জন
iv. সাধারণ সদস্য -৩ জন
(তন্মধ্যে ১ জন কোষাধ্যক্ষ হতে পারে, সেক্ষেত্রে সাধারণ সদস্য হবে ২ জন)
এরূপ কমিটি সমবায় সমিতির নিবন্ধনসহ গঠন সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে থাকে। কমিটির প্রথম দায়িত্ব হলো একটি খসড়া উপবিধি (By-laws) তৈরি করা। উপবিধিতে প্রধানত নিােক্ত বিষয়ের উল্লেখ থাকে-
ক. . সমবায় সমিতির নাম (সসীম দায়সম্পন্ন সমিতির নামের শেষে সীমিত বা Ltd. শব্দের উল্লেখ থাকবে);
খ. ঠিকানা ও কার্য এলাকা;
গ. উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম;
ঘ. উদ্যোক্তাদের নাম, ঠিকানা ও পদবি ;
ঙ. সদস্য অন্তর্ভুক্তি ও অব্যাহতির নিয়ম;
চ. মূলধনের পরিমাণ ও শ্রেণিবিভাগ;
ছ. শেয়ার মূল্য, শ্রেণিবিভাগ ও মোট শেয়ার সংখ্যা;
জ শেয়ার বিক্রয় পদ্ধতিঃ
ঝ. সমিতি পরিচালনা সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়ম-কানুন প্রভৃতি।
উদ্যোক্তারা ইচ্ছা করলে এধরনের উপবিধি প্রস্তুত না করেও সমবায় বিভাগ হতে ছাপানো উপবিধি সংগ্রহ করে উক্ত উপবিধি মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এ পর্যায়ে প্রস্তাবিত সমিতির জন্য সীলমোহর প্রস্তুত করা হয় ।
এ পর্যায়ে সমবায় সমিতি নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়া হয় । যে এলাকায় সমিতি স্থাপন করতে ইচ্ছুক সে এলাকায় সরকার নিযুক্ত সমবায় সমিতি নিবন্ধকের অফিস হতে নিবন্ধন ফরম সংগ্রহ করা হয়। নিবন্ধন ফরম যথাযথভাবে পূরণ করে প্রয়োজনীয় দলিলপত্রাদি ও ফি সহ নিবন্ধকের নিকট জমা দেয়া হয় ।
আবেদন ফরমের সাথে নিম্নোক্ত দলিলপত্র জমা দিতে হয়—
ক. সমিতির সদস্যদের স্বাক্ষরযুক্ত নাম ও ঠিকানা । এক্ষেত্রে ন্যূনতম ২০ (বিশ) জন প্রাপ্ত বয়স্ক সদস্যের নাম ও তারিখসহ স্বাক্ষর থাকতে হয় ।
খ. উদ্যোক্তাদের স্বাক্ষরসহ উপবিধি-২ কপি
গ. সমিতির সিলমোহরের নমুনা-১ টি
ঘ. আবেদন ফরমটি আইনসম্মতভাবে পূরণ করা হয়েছে এবং এতে উল্লিখিত তথ্যসমূহ সঠিক-এমর্মে সেক্রেটারি ও উদ্যোক্তাদের ঘোষণাপত্র ১ কপি ৷
উল্লেখিত কাগজপত্র ও নির্ধারিত ফি পাওয়ার পর নিবন্ধক কাগজপত্রগুলো যাচাই-বাছাই করেন এবং এ বিষয়ে সন্তুষ্ট হলে আবেদনপত্র প্রাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে তা মঞ্জুর করে নিবন্ধন পত্র ইস্যু করেন। ৬০ দিনের মধ্যে নিবন্ধনপত্র ইস্যু না করলে এবং আবেদন পত্র গৃহীত হলে নিবন্ধক নিবন্ধন সনদ হিসেবে নিবন্ধনপত্র ইস্যু করেন। এ পর্যায়ে নিবন্ধক সমিতির উপবিধির ৩ কপির প্রত্যেক পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর ও সীলযুক্ত করে ১ কপি নিবন্ধন অফিসে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রাখেন এবং ২ কপি উদ্যোক্তাদের ফেরত দেন। উল্লেখ্য, আবেদনপত্র প্রাপ্তির পর নিবন্ধক যদি দেখেন কোনো তথ্য বা কাগজপত্রের ঘাটতি রয়েছে তবে সেগুলো অনধিক ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ে বা তদন্ত করে নিবন্ধনের উপযুক্ততা দেখা হয় । এভাবেই সমিতির নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে।
নিবন্ধনের মাধ্যমে সমবায় সমিতি আইনানুগ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং সমিতির নাম ও সীলমোহর ব্যবহার করে উদ্যোক্তাগণ ও কমিটি সমিতির স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারে। এরপর সমিতির কর্মকাণ্ডে আর কোনো বাধা থাকে না ।
পরিশেষে বলতে পারি যে, সমবায় সংগঠন সুনির্ধারিত সমবায়ের গঠনের নিয়ম মেনে গঠিত ও পরিচালিত হয়। একটি নিবন্ধিত ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে সমবায় সংগঠনকে অবশ্যই এসব নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হয় ।
সমবায় ‘একতাই বল’ বা ‘দশে মিলে করি কাজ'-এ জাতীয় নীতিতে বিশ্বাস করে সংগঠিত হয়, অর্থাৎ সমাজের স্বল্প আয় বিশিষ্ট সাধারণ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কল্যাণ ধর্মী যৌথ প্রচেষ্টার সংগঠন হচ্ছে সমবায় সংগঠন। বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ তাদের প্রয়োজন মেটাবার লক্ষ্যে নানাধর্মী সমবায় সংগঠন গড়ে তুলতে পারে । এ কারণে সমাজে বিচিত্রধর্মী সমবায় সংগঠন দেখতে পাওয়া যায় ।
নিম্নে একটি চিত্রসহ বিভিন্ন প্রকার সমবায় সংগঠনের বর্ণনা দেয়া হলো-
১. উৎপাদক সমবায় সমিতি (Producers co-operative society)
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পের মালিক ও উৎপাদকগণ বৃহদায়তন শিল্পগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তাদের স্বল্প অর্থকে একত্রিত করে যে সমবায় গঠন করে তাকে উৎপাদক সমবায় সমিতি বলে। কোনো এলাকায় কতিপয় শ্রমিক একত্রে মিলে কোনো উৎপাদন শুরু করলে বা কতিপয় ব্যক্তি সমবায়ের ভিত্তিতে কোনোরূপ উৎপাদন কাজের সাথে জড়িত হলে তা উৎপাদক সমবায় সমিতি নামে পরিচিত হবে। তাঁতিদের সমবায়, দুগ্ধ উৎপাদক সমবায়, কৃষক সমবায়, জেলে সমবায় ইত্যাদি এ জাতীয় সমবায় সমিতির উদাহরণ।
২. ভোক্তা সমবায় সমিতিConsumers Co-operative Society
যখন কোনো বিশেষ পণ্যের বা কতিপয় পণ্যের ভোক্তাগণ মধ্যস্থব্যবসায়ীর মুনাফার শিকার না হয়ে ন্যায্য মূল্যে জিনিস কিনতে চান তখন তাদের চাহিদা পূরণে যে সমবায় প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয় তাকে ভোক্তা সমবায় সমিতি বলে। এ সমবায় সমিতি উৎপাদনকারী, আমদানিকারক বা পাইকারের নিকট থেকে পাইকারি মূল্যে পণ্যসামগ্রী খরিদ করে সেসব পণ্য সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্যের নিকট ন্যায্যমূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করে থাকে। ভোক্তা সমবায় সমিতিকে বণ্টনকারী সমবায় সমিতি নামেও অভিহিত করা হয়। শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানের গেটে, বড় প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানে, বড় হাউজিং কমপ্লেক্সের গেটে এর মালিকদের উদ্যোগে এধরনের সমবায় সমিতি গড়ে তোলা হতে পারে।
১. ক্রয় সমবায় সমিতি (Purchasing co-operative society): বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ যদি সমবায় সমিতির মাধ্যমে সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সংগ্রহের জন্য ক্রয় সুবিধা গ্রহণ করে তবে তাকে ক্রয় সমবায় সমিতি বলে।
২. বিক্রয়/বিপণন সমবায় সমিতি (Marketing co-operative society): ক্ষুদ্র উৎপাদক, কৃষক ইত্যাদি শ্রেণীর লোকজন তাদের পণ্যদ্রব্য বিক্রি, গুদামজাতকরণ, পরিবহণ ইত্যাদি ব্যাপারে পাইকারি সুবিধা প্রাপ্তির লক্ষ্যে যদি কোনো সমবায় সংগঠন করে তবে বিক্রয় সমবায় সমিতি বলে।
৩. আমদানি সমবায় সমিতি (Import co-operative society): ক্ষুদ্র আমদানিকারকগণ তাদের নানাবিধ সুবিধা ও সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায়ের নিমিত্তে যে সমবায় সমিতি গঠন করে তা আমদানি সমবায় সমিতি নামে পরিচিত।
৪. রপ্তানি সমবায় সমিতি (Export co-operative society): ক্ষুদ্র আমদানিকারকগণ রপ্তানি বিষয়ে পাইকারি সুবিধা, সম্মিলিত অভিজ্ঞতা ও সরকারের নিকট হতে দাবি আদায়ের নিমিত্তে যদি কোনো সমবায় সমিতি গঠন করে তাকে রপ্তানি সমবায় সমিতি বলা হবে ।
৫. বীমা সমবায় সমিতি (Insurance co-operative society): নিজেদের বীমা নিজেরা সংঘবদ্ধভাবে করার জন্য কোনো জনগোষ্ঠী সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করলে তাকে বীমা সমবায় সমিতি বলা হয় ।
৬. ব্যাংক সমবায় সমিতি (Bank co-operative society): ক্ষুদ্র আয়তনের ভিত্তিতে সদস্যদের নিকট হতে আমানত গ্রহণ ও তাদেরকে ঋণদানের জন্য যে সমবায় গড়ে ওঠে তাকে ব্যাংক সমবায় সমিতি বলা হয় ।
৭. ঋণদান সমবায় সমিতি (Credit co-operative society): মহাজন বা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের বদলে কম সুদে নিজেদের সঞ্চয় হতে ঋণ গ্রহণের জন্য যদি পেশাজীবীরা মিলিত হয়ে কোনো সমবায় গঠন করে তাকে ঋণদান সমবায় সমিতি হিসেবে অভিহিত করা হয়।
৮. গৃহনির্মাণ সমবায় সমিতি (Housing co-operative society): যদি মধ্যবিত্ত ও স্বল্পবিত্ত লোকেরা নিজেদের গৃহ নির্মাণের উদ্দেশ্যে কোনো সমবায় গড়ে তোলে তবে তাকেই গৃহ নির্মাণ সমবায় সমিতি বলা হয়।
৯. সমবায় আবাসিক এলাকা (Co-operative housing society): কোনো স্থানে আবাসিক প্লট খরিদের উদ্দেশ্যে যদি কোনো জনগোষ্ঠী একত্রিত হয় তবে তাকে সমবায় আবাসিক এলাকা বা আবাসিক এলাকাভিত্তিক সমবায় বলে ।
১০. বহুমুখী সমবায় সমিতি (Multi purpose co-operative society): যখন কোনো সমবায় সমিতি বিভিন্ন প্রকার ব্যবসায়িক কাজে লিপ্ত হয় তখন তাকে বহুমুখী সমিতি বলে । এরূপ সমবায় সমিতি ক্রয়, বিক্রয়, গৃহ নির্মাণ ঋণদান, ব্যাংকিং, বিমা-এ ধরনের বহুমুখী কার্য সম্পাদন করে থাকে ।
১. প্রাথমিক সমবায় সমিতি (Primary co-operative society): প্রাথমিক সমবায় সমিতি হচ্ছে সে ধরনের সমবায় সংগঠন যা সর্বনি স্তর বা প্রাথমিক পর্যায়ে গঠিত হয়। সমবায় বলতে মূলত এ স্তরের সমবায়কেই বুঝানো হয় । গ্রামীণ সমবায় সমিতিসমূহ এর উদাহরণ ।
২. কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি (Central co-operative society): ন্যূনতম ১০টি প্রাথমিক সমবায় সমিতির সম্মিলিত রূপ হচ্ছে কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি । গ্রামীণ কৃষক সমবায় সমিতিসমূহ মিলে ইউনিয়ন বা থানা পর্যায়ে সমিতিগুলো একত্রিত হয়ে এ জাতীয় সমিতি গঠিত হয়। এটি সমবায়ের দ্বিতীয় স্তর। এ সমিতিতে কোনো ব্যক্তি সদস্য হতে পারে না ।
৩. মিশ্র সমবায় সমিতি (Mixed co-operative society): এটি সমবায়ের তৃতীয় স্তর। ব্যক্তি সদস্যের পাশাপাশি প্রাথমিক সমবায় সমিতিগুলো এর সদস্য হয়ে থাকে। বিভাগীয় (বা প্রদেশ) পর্যায়ে সমবায় সমিতিগুলো একত্রিত হয়ে এ ধরণের সমবায় সমিতি গঠন করে। এ সমবায় সমিতির জন্য ন্যূনতম ২০ জন সদস্যদের মধ্যে কমপক্ষে ১২টি প্রাথমিক সমবায় সমিতির সদস্য থাকতে হয়।
৪. জাতীয় সমবায় সমিতি (National co-opeative society) : এটি সর্বোচ্চ স্তরের (চতুর্থ স্তর) সমবায় সংগঠন। জাতীয় পর্যায়ে যে সমিতি গঠন করা হয় তাকেই জাতীয় সমবায় সমিতি বলে। ১০টি কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি মিলে জাতীয় সমবায় সমিতি গঠিত হয়।
১. অসীম-দায় সমবায় সমিতি (Unlimited co-operative society): অসীম দায় সমবায় সমিতি হচ্ছে সে ধরনের সমবায় সংগঠন যেখানে সদস্যদের দায় তাদের ক্রয়কৃত শেয়ার দ্বারা বা অন্য উপায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না । সমিতির দেনার জন্য এ জাতীয় সমিতির সদস্যরা এককভাবে এবং যৌথভাবে দায়ী থাকে। বাংলাদেশে এ ধরনের সমিতির প্রচলন দেখা যায় না।
২. সসীম দায় সমবায় সমিতি (Limited Co-operative society): সমবায় সমিতির সদস্যদের দায় যখন তাদের ক্রয়কৃত শেয়ারের আংশিক মূল্য দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে তখন সসীম-দায় সমবায় সমিতি বলে। সদস্যদের সীমিত দায়কে বুঝাবার জন্য এরূপ সমিতির নামের শেষে ’লিমিটেড’ বা ‘Ltd’ শব্দ যোগ করা হয়। দেশের অধিকাংশ সমবায়ই এ শ্রেণিভুক্ত।
পরিশেষে বলা যায়, বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন পূরণের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সমবায় সমিতি কাজ করছে, স্বল্প সময়ের মানুষের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও টিকে থাকার জন্য ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন সমবায় সমিতি গড়ে উঠবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় ।
স্বল্পবিত্ত সম্পদ বা বিত্তহীন ব্যক্তিদের পক্ষে সীমিত সামর্থ্য ব্যবহার করে এককভাবে বড় কোনো কাজ করা সম্ভব হয় না। সমিতি গঠনের মাধ্যমে এরূপ সীমিত সামর্থ্যের মানুষ নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করতে পারে। তাই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষ পারস্পারিক কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে সমবায় সমিতি গঠন করে ।
নিম্নে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সমবায় সমিতির অবদান বর্ণনা করা হলো—
১. অর্থনৈতিক সুবিধা (Economic Advantages): সমবায় সংগঠন মূলত সদস্যদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে নানাভাবে কাজ করে। যেমন- কৃষক বা কম আয়ের সদস্যদের আর্থিক সুবিধা প্রদান, পণ্য বা সেবা উৎপাদনের উদ্দেশ্যে বা বিভিন্ন প্রয়োজনে স্বল্প সুদে সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা দান প্রভৃতি । ফলে সমিতির সদস্যরা মহাজনের দৌরাত্ম্য হতে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
২. সামাজিক সুবিধা (Social Advantages): সমবায় গঠনের মাধ্যমে বঞ্চিত জনগণ আর্থিক সুবিধার পাশাপাশি সামাজিক সুবিধা ভোগ করে থাকে। সামাজিক সুবিধার মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, গণতন্ত্রের চর্চা, অর্থনৈতিক শক্তির বিকেন্দ্রীকরণের ফলে সদস্যদের মর্যাদা বৃদ্ধি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
৩. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন (Improving Standard of Living): সমবায় সমিতি সমাজের নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনদের সংগঠন। সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে সদস্যদের আয় বৃদ্ধি, ন্যায্য মূল্যে পণ্য প্রাপ্তি, ঋণ সহায়তা প্রাপ্তি কর্মসংস্থানের সুযোগ, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, যা তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে প্ৰত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে।
৪. কম ব্যবস্থাপনা ব্যয় (Low Management Cost) : সদস্যদের স্বেচ্ছামূলক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের ফলে ব্যবস্থাপনা খরচ বহুলাংশে হ্রাস পায়। ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণকারীদের কোনো প্রকার বেতন-ভাতা প্রদান করতে হয় না। তারা সমিতি পরিচালনায় খুব আগ্রহের সাথেই বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে ।
৫. বৃহদায়তন ব্যবসায়ের সুবিধা (Advantage of Large scale Business) : সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় সমবায় সমিতি অধিক সঞ্চয় সংগ্রহ ও পুঁজি গঠন করতে পারে। যা দিয়ে বৃহদায়তন ব্যবসায়ের বিভিন্ন সুবিধা যেমন- বৃহদায়তন ক্রয়, উৎপাদন ও বিপণন সুবিধা পাওয়া যায়। এতে সমিতির আয় বৃদ্ধি পায় ।
৬. সেবার উদ্দেশ্য (Service Motive) : এরূপ সংগঠন মূলত সদস্যদের সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি হয়, মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে নয়। সদস্যদেরকে বিভিন্নভাবে আর্থিক সহায়তা ও ন্যায্যমূল্যে পণ্য বা সেবা প্রদানের সুযোগ দেয়া হয়। সমিতির সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক মনোভাব কাজ করে।
৭. করের অব্যাহতি (Tax Relief): সমবায় সমিতি গঠনে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এরূপ সংগঠনের আয়ের ওপর কর ধার্য করা হয় না। ফলে সদস্যদের অধিক আর্থিক কল্যাণ নিশ্চিত করা যায় ।
৮. সরকারি সহায়তা (Government Help): দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সমবায় সংগঠনগুলো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। আর এ ভূমিকাকে আরো বেশি উৎসাহিত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সমবায়ীদের বা সমিতিকে আর্থিক ও অনার্থিক বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করা হয় ।
৯. মনোবল উন্নয়ন (Moral Development): সমবায় সমিতি কতিপয় আদর্শের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। যেমন-পারস্পরিক সহযোগিতা, আত্মসহযোগিতা, কঠোর পরিশ্রম, শিক্ষা, আত্মনির্ভরশীলতা, সঞ্চয় সংগ্রহ প্রভৃতি। এসব আদর্শ অনুশীলনের ফলে সদস্যদের মধ্যে যেকোনো কঠিন কাজ খুব সহজে সম্পন্ন করার মনোবল ও মানসিকতা তৈরি হয়।
পরিশেষে বলা যায়, উপরিউক্ত সুবিধার কারণে সমবায় সংগঠন সাধারণত বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছে অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক ও আকর্ষণীয় সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। মোটকথা, ব্যক্তিক, সামাজিক ও জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমবায় সমিতির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ।
Bangladesh Academy for Rural Development” বা BARD পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৯ সালে কুমিল্লার কোটবাড়িতে প্রখ্যাত সমাজকর্মী অধ্যক্ষ আখতার হামিদ খান এ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন ।
এ একাডেমির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে পল্লী তথা গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন। এ উদ্দেশ্যে একাডেমির গৃহীত পদক্ষেপ ও কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পরীক্ষামূলক প্রকল্প পরিচালনা, পল্লী উন্নয়নের উপর সেমিনার, আলোচনা ইত্যাদি। প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে এখানে প্রশিক্ষণ প্রার্থীদের আবাসিক ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ওয়ার্কশপ, ক্যান্টিন প্রভৃতি সর্বাধিক সুযোগ- সুবিধা রয়েছে। বার্ড-এর এ বহুমূখী অবদান ও কার্যকলাপের জন্য একে কুমিল্লা মডেল নামেও অভিহিত করা হয় । প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে এর সুদূরপ্রসারী অবদান অনস্বীকার্য।
তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশ হিসেবেই বাংলাদেশ সবার কাছে পরিচিত। এদেশে নিবিত্ত সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বেশি। এদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য বিশেষ করে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলন গতি পেয়েছে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এ আন্দোলন সফলতার মুখ দেখা যায়না ।
বাস্তবক্ষেত্রে এদেশে সমবায় আন্দোলনে যে সমস্যা লক্ষনীয় তা নিম্নে তুলে ধরা হলো—
১. সঠিক পরিকল্পনার অভাব (Lack of proper planning): বাংলাদেশে সমবায় সমিতির উন্নয়নে কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। ফলে এদের অস্তিত্ব হয় স্বল্পমেয়াদি এবং বিকাশ হয় বাধাপ্রাপ্ত ।
২. প্রশিক্ষণের অভাব (Lack of training): সমবায়ের নির্বাহীগণের কোনোরূপ প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ নেই বলে তারা অনেক সময় ভুল পথে পরিচালিত হয়।
৩. আমলাতান্ত্রিক মনোভাব (Bureaucratic attitude): এদেশে কেউ কোনো দ্বায়িত্ব ও ক্ষমতা পেলেই নিজেকে একজন অসাধারণ ব্যক্তি ভাবতে শুরু করেন। আর সমবায় সমিতি পরিচালনার জন্যে নিযুক্ত ব্যক্তিরাও আমলাতন্ত্রিক মনোভাব ধারণ করায় তারা সদস্যদের সেবার বদলে অনেক সময় অসুবিধা সৃষ্টি করেন। ফলে সমবায় সমিতি ভেঙ্গে যায়।
৪. স্বজন-প্রীতি (Nepotism): সমিতির পরিচালকদের স্বজন-প্রীতি বাংলাদেশের সমবায়গুলোর বিকাশের পথে অন্তরায় । বিশেষ করে ঋণদান সমবায় সমিতিগুলোর ঋণদানের ক্ষেত্রে এ সমস্যা দেখা দেয় বেশি ।
৫. শিক্ষার অভাব (Lack of education): বাংলাদেশে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যাই অধিক। এ বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা সচেতনতা না থাকায় তারা সমবায় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমবায় প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য ।
৬. অসম প্রতিযোগিতা (Un-equal competition): ক্ষুদ্রায়তন প্রকৃতির সংগঠন হওয়ায় সমিতিকে মধ্যম ও বৃহদায়তন সংগঠনের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে।
৭. সততা ও নিষ্ঠার অভাব (Lack of honesty and sincerity): সমবায়ের মতো যৌথ প্রচেষ্টার সফলতা অনেকটাই সততা ও নিষ্ঠার উপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে এ দুটোরই বিসর্জন দিতে বসেছে। ফলে সমবায় সমিতির উদ্দেশ্যও আজ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে।
৮. মূলধনের স্বল্পতা (Defeciency of Capital) : সমবায় দরিদ্রদের সংগঠন। তাদের প্রদত্ত স্বল্প পরিমাণ চাঁদা সমিতির জন্য পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় মূলধন সৃষ্টি করে না ।
৯. সরকারের সহযোগিতা (Co-operation of govt): সমবায়ের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উন্নয়ন করা সম্ভব । কিন্তু বাস্তবতা হলো সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এক্ষেত্রে কম ।
পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে সমবায় সমিতিকে এগিয়ে নেয়ার সম্ভাবনা থাকলেও উপরিউক্ত সমস্যার কারণে তা যথেষ্ট অগ্রগতি লাভ করতে পারছে না। তাই এসব সমস্যা দূর করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবারই মহানুভবতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন ।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য, অনগ্রসরতা ও অভাব-অনটন থেকে নিম্নবিত্তসম্পন্ন ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে উদ্ধার করে উন্নয়নের নতুন পথ দেখাতে হলে সমবায় আন্দোলন যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ লক্ষ্যে অনেক পূর্ব হতেই এদেশে সমবায় আন্দোলন শুরু হলেও কিছু সমস্যার কারণে তা সফলতার মুখ দেখতে পারছে না ।
নিম্নে এ সকল সমস্যা দূরীকরণের প্রয়োজনীয় উপায় উল্লেখ করা হলো:
১. লাল ফিতার দৌরাত্ম্য হ্রাস (Reduction of red tapism ) : লাল ফিতার দৌরাত্ম্য তথা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সমবায় সমিতির অগ্রসরতার জন্য কম-বেশি দায়ী। এক্ষেত্রে গতিশীলতা আনতে হলে সমবায় মন্ত্রণালয়, সমবায় বিভাগ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট অফিসে দক্ষ ও সমবায়ের মন্ত্রে আস্থাশীল কর্মঠ জনবল নিয়োগ করা যেতে পারে।
২. সমবায়মূলক শিক্ষার ব্যবস্থাকরণ (Arrangement of co-operative oriented education): সমবায় আন্দোলনকে বেগবান করতে হলে দেশের সমবায়মূলক শিক্ষার প্রচলন করতে হবে। উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং পাঠ্যক্রমে এ বিষয়ক আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করে সমবায় শিক্ষা জোরদার করা যেতে পারে ।
৩. সমবায় উন্নয়নে বৃহৎ পরিকল্পনা (Master plan for development of co- operatives): সমবায় সমিতির মূল লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিবেচনায় রেখে একটি বৃহৎ বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। সরকারি উদ্যোগে কেন্দ্রীয়ভাবে গৃহীত এ পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে ।
৪. প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ (Adopting training programme): সমবায় সমিতির সাথে পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং সাধারণ সদস্যদের স্বল্পকালীন এবং কখনো বা দীর্ঘকালীন প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে সংশ্লিষ্ট সকলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, কৃষিকাজসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাস্তব ধারণা অর্জনে সক্ষম হবে।
৫. দুর্নীতি ও স্বজন-প্রীতি রোধ ( Measures to prevent corruption and nepotism) : দুর্নীতি ও স্বজন-প্রীতি অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় সমবায়েও শক্তিশালী ভিত গড়েছে। এ ভিতকে উপড়ে ফেলতে হলে নিরপেক্ষভাবে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬. সমবায়ের সুফল সম্পর্কিত প্রচারণা (Publicity regarding the merits of co- operatives): সমবায়ের কল্যাণমুখী ভূমিকা সম্পর্কে বেতার, টিভি, সংবাদপত্র ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে সাধারণ জনগণ সমবায় সম্পর্কে সচেতন হবে এবং এ বিষয়ে উৎসাহী হয়ে উঠবে ।
৭. সাধারণ শিক্ষার সম্প্রসারণ (Expansion of general education): একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক খাত হিসেবে সমবায় আন্দোলন জাতীয়ভিত্তিক আন্দোলনের গুরুত্ব পাবার অবকাশ রাখে। এ কারণে দেশের জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করে তোলা দরকার। দেশের দরিদ্র, অসচেতন সাধারণ লোকের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালাতে পারলে এ বিষয়ে ইতিবাচক ফল আশা করা যায় ।
৮. প্রণোদনার ব্যবস্থা (Taking incentive measures): এ সংগঠনের সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে সমবায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী, ব্যবস্থাপক এবং সদস্যদের বিশেষ পারদর্শিতার ভিত্তিতে প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নিরপেক্ষভাবে পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৯. কার্যকর সমন্বয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ (Taking effective measures for co-ordination): প্রাথমিক, কেন্দ্রীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সমবায় সংগঠনসমূহের মধ্যে এবং সমবায়ের বিভিন্ন দপ্তর, সমবায় বিভাগ ও সমবায় সমিতির সদস্যদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব সমবায়ের উন্নয়নে একটি বড় অন্তরায়। এজন্য এসব ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও কার্যকর সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সমবায়ের বিকাশ ঘটাতে হবে ।
১০. সহজ শর্তে ঋণদান (Providing credit with simple terms & condition): মূলধনের স্বল্পতা সমবায় সমিতিগুলো সচল রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। সমবায়ের সম্প্রসারণে সরকার সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে এ সমস্যা দূর করতে পারে ।
১১. সরকারি সহযোগিতা বৃদ্ধি (Increasing government co-operation): এ সেক্টরের উন্নয়নের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য বিষয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ক মন্ত্রণালয় কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
১২. গতিশীল তথ্য ব্যবস্থা (Dynamic information system): সমবায় সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে হলে এ সম্পর্কিত তথ্য প্রদানের ব্যবস্থাও থাকা দরকার। এ কারণে বিভিন্ন প্রকার প্রকাশনা, মুদ্রণ ও তার যথাযথ বিতরণসহ সকল তথ্য প্রদানের ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও গতিশীল হতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে উপরিউক্ত ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভাগসমূহকে এগিয়ে আসতে হবে। সমবায়ের উৎপত্তি হওয়া বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে সরকার ও জনগণকে তাই একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
খাদিজা বেগম তার দিনমজুর এবং সম্পদহীন পিতামাতার একমাত্র কন্যা। সে তার বাবা-মার তৈরি মাটির ঘরে বড় হয়েছে। মাত্র ১১ বছর বয়সে একজন বেকার ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়। আর বিবাহিত জীবন বোঝার আগেই তিনি দুসন্তানের জননী হন। জীবনের এ সময় এসে তিনি বুঝতে পারলেন তিনি তার স্বামী এবং দুসন্তান তার বাবা-মার সংসারে বোঝা স্বরূপ ঠিক এই সময় তিনি “নিজধারা মহিলা সমবায় সমিতি” নামে একটি সমবায় সমিতির নাম শুনলেন যেটি ছিল ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে' (B.R) এর অধীন। পরে তিনি এ সমবায় সমিতির সদস্য হলেন। প্রথমে তিনি সমবায় সমিতি হতে ১০০০ টাকা ঋণ নিলেন এবং ঋণের ব্যবসা শুরু করলেন। ঋণ ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে যে মুনাফা হলো তা দিয়ে তিনি তার দৈনন্দিন খরচ মিটানোর পাশাপাশি ঋণের ১ম কিস্তির টাকা পরিশোধ করেন। তারপর হতে উদ্দীপনার মাধ্যমে তার সংসার পরিচালনা করছেন। এভাবে তিনি ১৯৯২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মোট ৬৮০০০ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন এবং দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাভী লালন-পালন করেন। তিনি দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাভী ক্রয় করে একটি ডেইরি ফার্ম এবং একটি পোলট্রি ফার্ম স্থাপন করেন। বর্তমানে তার খামারে আটটি গরু রয়েছে। এর মধ্যে ২টি বিদেশি গাভী এবং ৬টি মাঝারি সাইজের গাভী রয়েছে। বর্তমানে সে গাভী হতে প্রতিদিন ৩০ লিটার দুধ পায় যার বর্তমান বাজারমূল্য ৭৫০ টাকা। এ দিয়ে তিনি খামারের সব খরচ এবং তাদের দৈনন্দিন খরচ মিটানোর পর ৩০০ টাকা সঞ্চয় করেন। তিনি একটি পোলট্রি ফার্ম গড়ে তুলেছেন যেখানে ২০টি হাঁস এবং ৩২৫ টি মুরগি লালন পালন করেন। পোলট্রি ফার্ম হতে তিনি দৈনন্দিন চাহিদা মিটানোর পর অবশিষ্ট ডিম বাজারে বিক্রি করেন। তার মোট দৈনন্দিন জমা টাকা দিয়ে স্থানীয় ‘ধরা’ বাজারের নিকটে ২৬ শতাংশ জমি ক্রয় করেন যার বর্তমান বাজারমূল্য ৩,০০,০০০ (তিন লাখ) টাকা। ‘ধরা’ বাজারে তিনি একটি কীটনাশক ঔষুধের দোকার দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি তার বাড়িতে একটি আধা পাকা ঘর দিয়েছেন। তার স্বামী বর্তমানে ট্রাক চালান । তার নিজের এবং তার স্বামীর আয়ে বর্তমানে তার সংসার খুব ভালোভাবে চলছে। এখন তিনি অনেক স্বচ্ছল। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছে। তার বৃদ্ধ বাবা-মার ও দেখাশুনা করছেন। বর্তমানে তিনি তার সমাজে এবং গ্রামে একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি অন্য মহিলাদের জন্য অনুকরণীয়। বর্তমানে তিনি খুবই সুখী এবং এজন্য তিনি সমবায় সমিতির প্রতি কৃতজ্ঞ ।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বা খুশিমতো চলতে দেয়ার নীতির কারণে ধনবাদী সমাজে ধনবৈষম্যের সৃষ্টি হয় ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। তাই এ অবস্থা পরিবর্তন করে সমাজতান্ত্রিক বা মিশ্র অর্থনীতি গড়ে তুলে কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনেক দেশেই রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করা হয়।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা জানতে পারবো—
বাংলাদেশ রেলওয়ে দীর্ঘদিন ধরে লোকসান দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ কথা শুনার পর জীবনের মনে প্রশ্ন জাগে লোকসান হলে এ ব্যবসায় পরিচালনা করার দরকার কী? এ ব্যপারে সে তার বড় ভাইকে প্রশ্ন করলে সে বলে এ ব্যবসায় লোকসান করলেও সাধারণ জনগণের অনেক কল্যাণ করে।
রাষ্ট্র বা সরকারের মালিকানাধীনে গঠিত ও পরিচালিত ব্যবসায়কে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বলে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বা সরকারি প্রচেষ্টায় নতুন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়ে থাকে। আবার, উপস্থিত কোনো বেসরকারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রায়ত্ত বা জাতীয়করণ করে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সাধারণত দেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, সম্পদসমূহের সুষম বণ্টন প্রভৃতির উদ্দেশ্যে এবং কতকগুলো জনকল্যাণমূলক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় স্থাপন করা হয়। তাছাড়া, দেশরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রপাতির নির্মাণ শিল্পের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখার উদ্দেশ্যে সরকার এরূপ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করে থাকে ।
যে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহ রাষ্ট্রের মালিকানায় থাকে এবং দেশের সরকারের অধীনে পরিচালিত হয় সে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহকে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বলে। রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের মালিকানা থাকে রাষ্ট্রের হাতে। সেই হিসেবে সাধারণ ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবসায়ের চেয়ে এ ধরনের সংগঠনের কিছু বাড়তি বৈশিষ্ট্য থাকে।
নিম্নে সেগুলো বিশ্লেষণ করা হলো—
গঠন প্রণালী (Mode of fromation): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় মূলত সরকারি নিয়ম-কানুন পালন করে সরকারি উদ্যোগে গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে বা দেশের আইনসভার বিশেষ আইনবলে অথবা বেসরকারি ব্যবসায় জাতীয়করণ করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় সংগঠিত হতে পারে ।
মালিকানা (Ownership): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের মালিক হলো সরকার বা জনগণ। এর সকল সম্পদ রাষ্ট্রের এবং এর কর্মচারীরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে গণ্য হয়। অবশ্য এরূপ ব্যবসায় সরকারি ও বেসরকারি যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ।
মূলধন (Capital): সরকার এরূপ ব্যবসায়ের মালিক হওয়ার কারণে তাকেই এর প্রয়োজনীয় মূলধনের সংস্থান করতে হয় । এজন্য সরকার নিজস্ব কোষাগার থেকে অথবা প্রয়োজনে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ সংগ্রহ করে এর মূলধন সংগ্রহ করে ।
উদ্দেশ্য (Objectives): রাষ্ট্রীয় সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন নয়। তারপরও বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে এ ব্যবসায় মুনাফা অর্জন করে থাকে। এ মুনাফা সরকারি কোষাগারে জমা হয় অথবা জনস্বার্থে ব্যয় করা হয়।
আইনগত মর্যাদা (Legal status): রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যবসায় কৃত্রিম ও স্বতন্ত্র সত্তার অধিকারী। বিশেষ আইন দ্বারা গঠিত বলে এর একটি পৃথক আইনগত মর্যাদা রয়েছে।
জনকল্যান সাধন (Public Welfare): মুনাফা বৃদ্ধি কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। জনসেবা ও জনকল্যাণই এর মূখ্য উদ্দেশ্য। বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় গঠিত হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একচেটিয়া কর্তৃত্ব ভোগ করে থাকে ।
স্বায়ত্তশাসন (Autonomy): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় সংগঠন কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার অধিকারী । ফলে এ ব্যবসায় চিরন্তন অস্তিত্বের অধিকারী । বিশেষ আইন বা অধ্যাদেশ বলে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের অবসান ঘটানো যায় ।
গণ-কৈফিয়ত (Public accountability): এ ব্যবসায়ের সাফল্য ও ব্যর্থতার জন্য জাতীয় সংসদে সরকারকে জবাবদিহিতা করতে হয়।
সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় কারবারের প্রচলন বেশি। ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় প্রায় ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় উদ্দেশ্যগত দিক থেকে অন্যান্য ব্যবসায়ের চেয়ে ভিন্ন । অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের প্রধান উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন নয়। বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ ব্যবসায় গঠিত ও পরিচালিত হয়।
উপসংহারে বলা যায়, রাষ্ট্রীয়করণকৃত অথবা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত যে সকল শিল্প বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি আওতাধীনে থাকে তাকে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বলে । মুনাফা অর্জন এ ব্যবসায়ের মূল উদ্দেশ্য নয়; মূল উদ্দেশ্য হলো জনকল্যাণ ।
রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় মূলত সরকারি নিয়ম-কানুন পালন করে সরকারি উদ্যোগে গঠিত হয় রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে বা দেশের আইনসভার বিশেষ আইনবলে অথবা বেসরকারি ব্যবসায় জাতীয়করণ করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় সংগঠিত হতে পারে ।
নিম্নে এ ব্যবসায়ের সুবিধা আলোচনা করা হলো:
১ . সামাজিক ন্যায়বিচার (Social justice): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় সমাজের কিছুসংখ্যক ব্যক্তির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করে এবং জনগণের ভাগ্যেন্নয়নের লক্ষ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে ।
২. জনকল্যাণ সাধন (Public welfare): এরূপ ব্যবসায় জনকল্যাণের উদ্দেশ্যেই মূলত গঠিত ও পরিচালিত হয়। জনকল্যাণমুখী বিভিন্ন খাত; যেমন-ওয়াসা, রেলওয়ে, ডাক ও তার ইত্যাদির মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আমাদের দেশে এ ব্যবসায় জনগণের অশেষ উপকার সাধন করে ।
৩. অধিক কর্মসংস্থান (More employment): এ ব্যবসায় শ্রমিক-কর্মীদের শোষণ না করে বরং তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গঠন ও এতে প্ৰয়োজনীয় সংখ্যক লোক নিয়োগ করে অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।
৪. সুষম শিল্পায়ন (Balanced industrialization): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় পরিচালনার ক্ষেত্রে দেশের সকল অঞ্চলের উন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। এ ছাড়া দেশে যাতে ভারসাম্যপূর্ণ অর্থাৎ সকল ধরনের শিল্পের উন্নয়ন ঘটে তার প্রতিও নজর দেয়া হয় । ফলে দেশের সুষম শিল্পায়ন ঘটে ।
৫. চাহিদা ও যোগান সমতা বিধান (Balancing between demand and supply): এক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার মাধ্যমে শিল্প সংক্রান্ত কার্যাবলি বিশেষত উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় ও ভারসাম্য বজায় রাখা যায়। ফলে স্বল্প বা অধিক উৎপাদনের সম্ভাবনা হ্রাস পায় ।
৬. একচেটিয়া প্রভাব রোধ ( Resisting monopoly influence): ব্যক্তিমালিকদের মধ্যে একচেটিয়া প্রভাব সৃষ্টির অসৎ প্রবণতা লক্ষণীয়। এজন্য তারা বিভিন্ন সময় নানান ধরনের অপকৌশল গ্রহণ করে জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তা বন্ধ করা যায়।
৭. দুর্নীতি ও অপচয় রোধ (Resisting corruption and wastage): ব্যক্তিমালিকগণ অধিক মুনাফার আশায় অনেক সময় নানা ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতায় ভোগে। যা রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ঘটে না। এছাড়া এ ব্যবসায় ভারসাম্যহীন প্রতিযোগিতা রোধ করে অপচয় হ্রাস করতে সাহায্য করে।
৮. ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ (Control of business) : দেশের শিল্প-বাণিজ্যের উপর সরকারের প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। দেশের আমদানি-রপ্তানির উপরও সরকারের প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োজনীয় ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে সরকার দেশের অর্থ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
৯. প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার (Best utilization of natural resources): বেসরকারি খাতে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ছেড়ে দেয়া হলে ব্যক্তিস্বার্থ বিবেচনায় তার অপব্যবহারের সম্ভাবনা বেশি থাকে। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার করা হলে দেশের সকল মানুষ এর সুফল পায়।
১০. মন্দাজনিত সংকট রোধ (Resisting problem relating to recession): অর্থনৈতিক মন্দার সময় দেশের দেশের বেসরকারি খাতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষত কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার বেকার সমস্যা প্রকট হয়। উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাজারে পণ্যের তীব্র সংকট দেখা যায় । কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যবসায় এ ধরনের সংকট সৃষ্টি করে না।
১১. গবেষণা ও উন্নয়ন (Research and development): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বৃহদায়তন প্রকৃতিতে গড়ে উঠায় এবং আর আর্থিক সামর্থ্য ভালো থাকায় এক্ষেত্রে গবেষণা ও উন্নয়নের সুযোগ বেশি থাকে । উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে এ ব্যবসায় সহজেই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।
মুনাফা বৃদ্ধি কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। জনসেবা ও জনকল্যাণই এর মূখ্য উদ্দেশ্য। বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় গঠিত হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একচেটিয়া কৰ্তৃত্ব ভোগ করে থাকে।এর ফলে কিছু অসুবিধা দেখা দেয় নিম্নে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের অসুবিধা সমূহ আরোচনা করা হলো:
১. স্বাভাবিক অর্থনৈতিক বিকাশে বাধা (Hindrance towards normal economic development): সরাসরি মালিকানায় ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করা হলে বেসরকারি উদ্যোক্তাগণ নিরুৎসাহিত হয়। এতে দেশের কার্যকরী কারবারি পরিবেশ বিপন্ন হয় ও স্বাভাবিক অর্থনৈতিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় ।
২. দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসুবিধা (Problem of taking quick decision): যথাসময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নের উপর ব্যবসায় সাফল্য নির্ভর করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার কারণে সকল বিষয়ে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়। যা সিদ্ধান্ত গ্রহণকে বিলম্বিত ও অকার্যকর করে।
৩. লালফিতার দৌরাত্ম্য (Suffering of red tapisim): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপক ও কর্মচারীদের মধ্যে আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা বিদ্যমান থাকায় ধরাবাঁধা নিয়ম-কানুনের নিগড়ে সব কাজ গণ্ডিবদ্ধ হয়ে পড়ে। এতে লালফিতার দৌরাত্ম্যের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ সকল কাজের গতি অত্যন্ত ধীর ও মন্থর হয়ে থাকে ।
8. অলাভজনক সংস্থা (Unprofitable organisation): এরূপ ব্যবসায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং সরকারি সাহায্যে টিকে থাকে। অনবরত লোকসানের ফলে এরুপ ব্যবসায় সম্পর্কে জনমনে খারাপ ধারণা জন্মে এবং জাতির জন্য তা বোঝা হয়ে দাঁড়ায় ।
৫. নমনীয়তার অভাব (Lack of flexibility): এরূপ ব্যবসায় সরকারি নিয়ম-নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ থাকে বিধায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল কারবারি অবস্থার সাথে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়। ফলে তা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না ।
৬. দুর্নীতি ও স্বনজনপ্রীতি (Corruption and nepotism): সাধারণভাবে এ ব্যবসায়ে কর্তাব্যক্তিদের আলাদা কোন স্বার্থ না থাকায় তাদের মধ্যে অন্যায় পথে স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে এর অভ্যন্তরে দুর্নীতি বাসা বাঁধে। এ ছাড়া এরূপ ব্যবসায় সরকারি আমলা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আত্মীয় পোষণের ক্ষেত্রে পরিণত হয় ।
৭. নীতির ঘন ঘন পরিবর্তন (Frequent change of policies): সরকারি প্রশাসনের ন্যায় এর পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকেও ঘন ঘন বদলি করা হয়। ফলে নির্বাহী বদলের সাথে নীতিরও পরিবর্তন ঘটে। এ ছাড়া সরকার পরিবর্তনের সাথেও এর নীতিতে অনেক পরিবর্তন হয়। আর এরূপ নীতির পরিবর্তন ব্যবসায়ের অগ্রগতি ব্যাহত করে।
৮. গোপনীয়তা প্রকাশ (Expressing secrecy): আইনসভার বিশেষ আইনবলে এরূপ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয় বিধায় সংসদে এর কার্যক্রম নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা হয়। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি বিভাগীয় সংগঠনের কাজ নিয়েও সরাসরি আলোচনার সুযোগ থাকে। ফলে ব্যবসায় গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়ে।
৯. বিলোপের অসুবিধা (Problem in dissolution): সরকারি প্রতিষ্ঠান বিধায় এর বিলোপের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সংসদে ও জনসাধারণ্যে নানান কথা উঠে। শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক আন্দোলনের সৃষ্টি হয় । এতে সরকার জনসমর্থনের বিষয় বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না । ফলে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও এর বিলোপ করা যায় না।
বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ড, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এটি ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ড মূলত ল্যান্ডফোন সেবা প্রদান করে থাকে। এটির সেবা শহর অঞ্চল, উপশহর এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিস্তৃত। যদিও সরকার বেসরকারি ক্ষেত্রে টেলিফোনের লাইসেন্স প্রদান করেছে তথাপি ল্যান্ডফোনের ক্ষেত্রে এটি এখনো একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে চলেছে। এটি শুধু ল্যান্ড ফোনের সেবাই প্রদান করে থাকে তা নয়, এটি আমাদের ৬৪ জেলায় ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে থাকে ।
শ
১৯৯৮ সালে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এটিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। গ্রাহকদের আরও উন্নত সেবা প্রদান করার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালে “টেলিটক” নামের আলাদা একটি কোম্পানি খোলে যেটি বর্তমানে মোবাইল সেবা প্রদান করছে। টেলিটক হচ্ছে দেশের একমাত্র পাবলিক মোবাইল অপারেটর। ২০১২ সালে টেলিটক 3G প্রযুক্তি যুক্ত করে মোবাইল ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। এ প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমানে মোবাইল গ্রাহকরা কথা বলার সাথে সাথে যার সাথে কথা বলছে তার ছবিও দেখতে পারছে। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানও দেখতে পাচ্ছে। আরো নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ড প্রতিনিয়ত কাজ করছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি) একটি রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা। এটি ১৯৬১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ সালের ৭নং সরকারি অধ্যাদেশ এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় । ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর এটি বর্তমান নাম ধারন করে। বিআরটিসি যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের একটি আধা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এটির গভর্ণিংবডির সদস্যদের মধ্যে রয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রী, যোগাযোগ সচিব, প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং অন্যান্য অফিসার যাদের দ্বারা সরকার কর্তৃক একজন চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয়।
বিআরটিসি যাত্রীসেবা এবং পণ্য পরিবহন সেবা দুটোই প্রদান করে। বিআরটিসি তিনটি আন্তর্জাতিক বাসরুট রয়েছে; এগুলো হচ্ছে ঢাকা-কলকাতা, ঢাকা-আগরতলা ও ঢাকা-শিলিগুড়ি। বাংলাদেশের মধ্যে এটি চট্টগ্রাম বগুড়া, কুমিল্লা, পাবনা, রংপুর, বরিশাল, সিলেট, ঢাকা বাস ডিপো থেকে আন্তঃজেলা বাস সেবা দিয়ে থাকে । বর্তমানে ঢাকার যানযট নিরসনে বিআরটিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রতিনিয়ত বিআরটিসির বহরে নতুন নতুন বাস যোগ হচ্ছে। জানুয়ারি ২০১২ সাল পর্যন্ত বিআরটিসির মোট বাসের সংখ্যা ছিল ১১১৬টি। পরবর্তীতে ২০১২ সালে আরো কিছু দোতালা বাস আমদানি করা হয়। বিআরটিসির সবচেয়ে আধুনিক সংযোজন হচ্ছে আর্টিকুলেটেড বা জোড়া বাস যেটি ২০১৩ সালে উদ্ভোধন করা হয়। বিভিন্ন উৎসব বা অনুষ্ঠানের সময় বিআরটিসি স্পেশাল সার্ভিস চালু করে; যেমন ঈদ স্পেশাল সার্ভিস।
বাস ছাড়াও পণ্য পরিবহনের সুবিধার জন্য বিআরটিসি ট্রাক সেবা প্রদান করে থাকে। বিআরটিসি সাধারণত বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের খাদ্য, সার, কাগজ এবং জীবন রক্ষাকারী ঔষধ পরিবহনের ব্যবস্থা করে থাকে । তাছাড়া বিভিন্ন দূর্যোগের সময় ত্রান পরিবহনে সহায়তা করে থাকে। বর্তমানে প্রায় ১৭১ টি ট্রাক বিআরটিসি বহরে রয়েছে।
বাস ও ট্রাক সেবা ছাড়াও বিআরটিসি চালকদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। এটির প্রধান চালক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র অবস্থিত গাজিপুরের জয়দেবপুর। এছাড়াও ঢাকা, চট্রগ্রাম, বগুড়া, খুলনা, ঝিনাইদাহেও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং সার্ভিসিং সেন্টার রয়েছে। বিআরটিসির প্রধান ওয়ার্কশপ ঢাকার তেজগাঁও এ অবস্থিত।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থা (BSFIC) একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয় পহেলা জুলাই ১৯৭৬ সালে । এটি ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ ১৯৭২ এর ২৬ নং অর্ডারের ভিত্তিতে দুটি প্রতিষ্ঠান যথা বাংলাদেশ চিনিকল মিল কর্পোরেশন (BSMC) এবং বাংলাদেশ খাদ্য এবং সহায়ক শিল্প কর্পোরেশন (BFAIC) একিভূত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থা খাদ্য মন্ত্রনালয়ের একটি প্রতিষ্ঠান। এটির সাধারণ প্রশাসনিক কার্যাবলি “বোর্ড অব ডিরেক্টরস” এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। “বোর্ড অব ডিরেক্টরস” এ থাকে একজন চেয়ারম্যান এবং ৫ জন পরিচালক যার মধ্যে থাকে একজন অর্থায়ন, একজন বিপণন, একজন উৎপাদন ও প্রকৌশলী, একজন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন এবং একজন আখ উন্নয়ন ও গবেষণা।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Goal & Objective)
বাংলাদেশ চিনি ও শিল্প সংস্থার অধীনে চিনিকল গুলো নিম্নরূপঃ
ক্রমিক | প্রতিষ্ঠানের নাম | অবস্থান |
১ | পঞ্চগড় চিনিকল লি. | পঞ্চগড় |
২ | খেতাবগঞ্জ চিনিকল লি | খেতাবগঞ্জ, দিনাজপুর |
৩ | ঠাকুরগাঁ চিনিকল লি. | ঠাকুরগাঁ |
৪ | শ্যামপুর চিনিকল লি. | শ্যামপুর, রংপুর |
৫ | জয়পুরহাট চিনিকল লি. | জয়পুরহাট |
৬ | নাটোর চিনিকল লি. | নাটোর |
৭ | উত্তরবঙ্গ চিনিকল লি. | গোপালপুর, নাটোর |
৮ | রাজশাহী চিনিকল লি. | রাজশাহী |
৯ | কুষ্টিয়া চিনিকল লি. | কুষ্টিয়া |
১০ | মোবারকগঞ্জ চিনিকল লি. | ঝিনাইদহ |
১১ | কেরু এন্ড কোম্পানি লি. | দর্শনা, চুয়াডাঙ্গা |
১২ | ফরিদপুর চিনিকল লি. | মধুখালি, ফরিদপুর |
১৩ | পাবনা চিনিকল লি. | পাবনা |
১৪ | ঝিল-বাংলা চিনিকল লি. | দেওয়ানগঞ্জ, জামালপুর |
১৫ | রংপুর চিনিকল লি. | মহিমাগঞ্জ, গাইবান্ধা |
ওয়াসা (Wasa-Water and Swearage Authority)
পানি সরবরাহ এবং নর্দমা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত একটি আধা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৩ সালে ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রনালয়ের অধীনে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে ।
বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থা (BCIC)
বাংলাদেশে রাসায়নিক শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশ সাধনে BCIC অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ১৯৭২ সালে BCIC প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে সে সময় এটি (১) বাংলাদেশ সার, রসায়ন ও ভেষজ শিল্প সংস্থা (২) বাংলাদেশ কাগজ বোর্ড (৩) বাংলাদেশ টেনারিজ কর্পোরেশন এ তিনটি সংস্থায় বিভক্ত ছিল। পরবর্তীতে এ তিনটি সংস্থাকে একত্রিত করে BCIC প্রতিষ্ঠা করা হয়। BCIC বাংলাদেশের চামড়া শিল্প, কাগজ শিল্প, ভেষজ পেট্রোলিয়াম, রাসায়নিক সার প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণা, মানোন্নয়ন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি কার্যাবলি পালন করে থাকে । বর্তমানে এর অধীনে ৩০টি শিল্প ইউনিট রয়েছে। বিদেশের সাথেও এ সংস্থার সংযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ শিল্প মন্ত্রনালয়ের অধীনে BCIC পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন (BPC)
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পর্যটন শিল্পের উন্নত প্রসার ও বিকাশে সরকার ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন গঠন করেছে। এ কর্পোরেশনের প্রধান লক্ষ্য ও কর্মসূচি হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক আকর্ষণীয় স্থান সমূহ চিহ্নিত করা এবং প্রকৃতি প্রেমিক পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার জন্য সেগুলোর সংস্কার, উন্নয়ন, সময়োপযোগী যোগাযোগ ও নিরাপত্তা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য পুস্তিকা, পোস্টার, স্পটসমূহের পরিচিতিমূলক হ্যান্ডবিল, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ইত্যাদি প্রকাশ করার ব্যবস্থা করে থাকে। এসব কাজের জন্য ঢাকায় এর কেন্দ্রীয় দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হলেও কক্সবাজার, রাঙামাটি, কুমিল্লা, রংপুর, সিলেট বিভিন্ন স্থানে এর শাখা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্পট গুলোতে অভিজাত হোটেল, রেস্তোরা ও ক্রীড়াকেন্দ্রও স্থাপিত হয়েছে পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্যোগে। আমাদের দেশের প্রধান প্রধান পর্যটন স্পটগুলো হলো কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সুন্দরবন, জাফলং, রাঙামাটি, সিলেট, বাগেরহাট, কুমিল্লার ময়নামতি, দিনাজপুর।
ডাক যোগাযোগ (Postal Communication )
মানব সভ্যতার এক বিশেষ অবদান হচ্ছে ডাক ব্যবস্থা। প্রতিটি দেশেই ডাক ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশে ডাক বিভাগ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। এর শাখা বাংলাদেশের গ্রামে- গঞ্জে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। বস্তুত বাংলাদেশ ডাক বিভাগ তার প্রায় ৮০০০ পোস্ট অফিসের মাধ্যমে দেশের আপামর জনসাধারনের অবিরাম সেবা করে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার রাজধানীর সাথে সকল জেলা সদর এবং জেলা সদরের সাথে সকল থানা সদরে ডাক যোগাযোগ ত্বরান্বিত করার ব্যবস্থা নিয়েছেন। এ জন্য ঢাকা থেকে সকল জেলা সদর ও জেলা সদর থেকে থানা সদরে সরাসরি মেইল ব্যাগ প্রবর্তনের মাধ্যমে নূন্যতম সময়ে ডাক আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জনগণের কল্যাণে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বেশকিছু সার্ভিস বা সেবা প্রদান করে:
১. সাধারণ চিঠি: বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ৩ টাকা ফি নিয়ে সাধারণ চিঠি বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তের প্রাপকের নিকট পৌঁছে দেয়।
২.পার্সেল: পার্সেলের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাপের পণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানো যায় । পার্সেল রেজিস্ট্রিকৃত এবং বিমা করা যায়।
৩. মানি অর্ডার: মানি অর্ডারের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে যেকোনো স্থানে টাকা প্রেরণ করা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে চাকরিজীবিদের জন্য এটি খুবই সাহায্যকারী।
৪. পোস্টাল অর্ডার: অর্থ হস্তান্তরের জন্য ডাক বিভাগে পোস্টাল অর্ডার বিক্রয় এবং ভাঙানোর ব্যবস্থা রয়েছে ।
৫. টেলিগ্রাফ: ডাক বিভাগের পুরাতন একটি সেবা হচ্ছে টেলিগ্রাফ। বর্তমানে অবশ্য টেলিগ্রাফ ব্যবহার কম হয়ে থাকে ।
৬. ডাকঘর সঞ্চয়পত্রঃ ডাক ঘর সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা নির্দিষ্ট মেয়াদের ভিত্তিতে জমা রেখে সুদ প্রদান করে।
৭. স্ট্যাম্প: জমি, ফ্ল্যাট, দোকান ক্রয়-বিক্রয়, চুক্তি ইত্যাদি কাজে দলিল লিখনে স্ট্যাম্প ব্যবহৃত হয়, ডাক বিভাগ এটি বিক্রয় করে থাকে ।
৮. প্রাইজবন্ড ক্রয়-বিক্রয়: বিভিন্ন উপহার এবং নির্দিষ্ট সময়ান্তে ড্র-এর মাধ্যমে জনসাধারণকে সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তোলার জন্য ডাক বিভাগে প্রাইজবন্ড ক্রয় ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা আছে ।
বাংলাদেশ রেলওয়ে (BR)
বাংলাদেশের রেলপথের পরিমাণ অল্প হলেও তা এদেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রেলপথ দেশের প্রধার শহর, বন্দর, বাণিজ্য ও শিল্প কেন্দ্রের সঙ্গে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সংযোগ রক্ষা করে। বাংলাদেশ রেলওয়ের ইতিহাস অত্যন্ত পূরাতন। এটির যাত্রা শুরু হয় ১৫ই নভেম্বর ১৮৬২ সালে। রেলওয়ে একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এটি বাংলাদেশ রেলওয়ে মন্ত্রনালয়ের অধীন। আর ট্রেন পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন মহাপরিচালক । বাংলাদেশে বর্তমানে তিন ধরনের রেলপথ চালু আছে। পথগুলো হচ্ছে-মিটারগেজ রেলপথ, ব্রডগেজ রেলপথ ও ডুয়েলগেজ রেলপথ। যমুনা নদীর পূর্বাংশে মিটারগেজ ও ডুয়েলগেজ এবং পশ্চিমাংশে ব্রডগেজ রেলপথ চালু আছে। যমুনা সেতু চালুর পূর্বে রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৭৬৮ কি.মি. । বর্তমানে রেলপথের দৈর্ঘ্য ২৮৫৫ কি.মি. এবং প্রায় ৩৪,১৬৮ জন কর্মরত আছে। এর মধ্যে ৬৬০ কি.মি. ব্রডগেজ (বেশিরভাগ পশ্চিমাঞ্চল), ১৮৩০ কি.মি. মিটারগেজ (বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় এবং পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত) এবং ৩৬৫ কি.মি. ডুয়েল গেজ। ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু চালু হওয়ার পর পূর্বে বিচ্ছিন্ন পূর্ব-পশ্চিম অঞ্চলের সাথে যুক্ত হয় ।
উন্নত সেবা প্রদান করার জন্য রেলপথকে দুটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে-পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিম অঞ্চল। দুটি অঞ্চলে দুজন ব্যবস্থাপক থাকেন যিনি মহাপরিচালকের নিকট দায়বদ্ধ থাকেন। প্রত্যেক অঞ্চলে দুটি ওয়ার্কসপ আছে; একটি পাহাড়তলী এবং অন্যটি সৈয়দপুরে অবস্থিত। রেলওয়ের নিজস্ব প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে বিভিন্ন সেবা প্রদান করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সাটল ট্রেন সেবা থেকে শুরু করে যাত্রী সেবা এবং পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা করে থাকে। এত সেবা প্রদান করার পরেও রেল এখনো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হতে পারে নাই। এখনো সরকারকে এ খাতে ভর্তুকী দিতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের রেলপথ বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান সমস্যাগুলো হলো; ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, ত্রুটিপূর্ণ সংকেত পদ্ধতি, ইঞ্জিন ও বগির অপ্রতুলতা, ইঞ্জিন ড্রাইভার সংকট, ওয়াগন স্বল্পতা, দুর্ঘটনা, রেলওয়ে স্লিপার, রেলওয়ে পাথরের অপর্যাপ্ততা, দুর্নীতি ইত্যাদি।
তবে আশার কথা বর্তমানে সরকার এ খাতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। কিছু কিছু রেলপথ যেগুলো বন্ধ ছিল তা সংস্কারের ব্যবস্থা করেছে। নতুন লাইন স্থাপনের পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি ভারত থেকে নতুন কোচ আমদানি করেছে এবং জাইকার সাথে মেট্রো রেলের চুক্তি হয়েছে। এগুলো সম্পাদিত হলে বাংলাদেশ রেলওয়ে তার সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করতে পারবে।
যে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহ রাষ্ট্রের মালিকানায় থাকে এবং দেশের সরকারের অধীনে পরিচালিত হয় সে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহকে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বলে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের যৌক্তিকতা আলোচনা করা হলো:
পরিশেষে বলা যায় যে, উপরোক্ত কারণে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় এ ব্যবসায় প্রয়োজনীয়তার যথাথতা রয়েছে।
সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় কারবারের প্রচলন বেশি। ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় প্রায় ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়। তার পরেও রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় দেশের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ,সম্পদসমূহের সদ্ব্যবহার ও সুষম বন্টনের ক্ষেত্রে অপিরিসীম অবদান রেখেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় নিম্নোক্তভাবে আমাদের দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বভিত্তিক ব্যবসায় (PPP) বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়। নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে প্রায় ৫০ টি প্রকল্প এই ব্যবসায়ের মাধ্যমে সম্পাদিত হয় যার মধ্যে ছিল টেলিযোগাযোগ, বন্দর নির্মাণ এবং অবকাঠামো উন্নয়ন। সরকারও তাদের বাজেট পরিকল্পনায় সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বভিত্তিক ব্যবসায়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বভিত্তিক (PPP) ব্যবসা বলতে কোন সরকারি সেবা বা বেসরকারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে বুঝায় যেটি অর্থায়ন ও পরিকল্পনা করে সরকার এবং এক বা একাধিক প্রাইভেট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বভিত্তিক ব্যবসায় বলতে বুঝায় পাবলিক কর্তৃপক্ষ এবং প্রাইভেট পক্ষের মধ্যে এমন একটি চুক্তি যেখানে বেসরকারি পক্ষ কোন পাবলিক সেবা দেয় বা প্রকল্পের যাবতীয় আর্থিক এবং কারিগরী ঝুঁকি বহন করে। কিছু কিছু সরকারী বেসরকারী অংশীদারিত্ব ভিত্তিক ব্যবসায়ে সেবা ব্যবহারের ব্যয় শুধূমাত্র এর ব্যবহারকারীরা বহন করে কোন কর প্রদানকারী বহন করে না। অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী মূলধন বিনিয়োগ বেসরকারি পক্ষ বহন করে এবং সেবা সরবরাহের ব্যয় সম্পূর্ণ বা আংশিক সরকার বহন করে। অনেক সময় সরকার বেসরকারি বিনিয়োগকারীদেরকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এককালীন অনুদান প্রদান করে মূলধন ভর্তুকী হিসাবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকার মুনাফা জাতীয় ভর্তুকী প্রদান করে সাহায্য করে থাকে। মুনাফা জাতীয় ভর্তুকী বলতে একটি নির্দিষ্ট সময় কর সুবিধা প্রদান করা হয়। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে GDP এর লক্ষ মাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮% – ১০% । এ লক্ষ অর্জনের জন্য সরকার শক্তি উৎপাদন, জ্বালানি, বন্দর, যোগাযোগ, খাবার পানি, বর্জ ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী খুঁজছে। কারণ এ প্রকল্পগুলো অত্যধিক ব্যয়বহুল। এগুলো সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয় । তাই সরকারি-বেসরকারিভিত্তিক (PPP) ব্যবসায় প্রয়োজন।
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে মানুষের যে কোনো বৈধ অর্থনৈতিক কাজকেই ব্যবসায় বলে। অর্থাৎ কোনো কাজকে ব্যবসায় হতে হলে তার আইনগত বৈধতা অপরিহার্য। এই বৈধতা প্রমাণের সাথে দেশের আইনের যোগসূত্র রয়েছে । যদি কোনো ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য ও কার্যকরণ দেশের আইন বিরুদ্ধ হয় তবে তা ব্যবসায় হতে পারে না। ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করতেও আইন মানার প্রয়োজন পড়ে। এজন্য আইনে নির্দিষ্ট বিভিন্ন অানুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। ব্যবসায় সংক্রান্ত আইনের একটা বড় উদ্দেশ্য হলো ব্যবসায়ী ও এর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অধিকার যেন ভঙ্গ না হয় তা নিশ্চিত করা। তাই এরূপ অধিকার কী রয়েছে তাও ব্যবসায়ীদের জানার প্রয়োজন পড়ে। ব্যবসায় এখন আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাই দেশের বাইরে ব্যবসায় করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট দেশের ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার প্রয়োজন পড়ে। তাই ব্যবসায়ের ইনগত দিক সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্যই মূলত এ অধ্যায়ের অবতারণা ।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে শিক্ষার্থীরা (শিখন ফল)
১. ব্যবসায়ের বিভিন্ন আইনগত দিক ব্যাখ্যা করতে পারবে
২. পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক আইনের ধারণা ব্যাখ্যা করতেপারবে
৩. পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক এর সুবিধা বিশ্লেষণ করতে পারবে
৪ . পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রি করার পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে পারবে
৫ . কপিরাইট আইনের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারবে
৬ . কপিরাইট নিবন্ধন করার পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে পারবে
৭. কপিরাইট ভঙ্গ করার পরিণতি বিশ্লেষণ করতে পারবে
৮. বিমার ধারণা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবে
৯. ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে বিমা করার প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করতে পারবে
১০. ব্যবসায় ও পরিবেশ আইনের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারবে
১১. ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিবেশ দূষণের কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ করতে পারবে
১২. ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিবেশ দূষণরোধে করণীয় চিহ্নিত করতে পারবে
১৩. আই এস ও (ISO) ধারণা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবে
১৪. বি এস টি আই ধারণা ও কার্যাবলি ব্যাখ্যা করতে পারবে
জনাব আকবর একজন তুলা ব্যবসায়ী। তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে তুলা আমদানি করে নিজস্ব গুদামে সংরক্ষণ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন স্পিনিং মিলে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করেন। গুদামে পণ্য থাকা অবস্থায় সম্ভাব্য ক্ষতির বিপক্ষে তিনি একটি বিমা কোম্পানির সাথে বিমা চুক্তি সম্পাদন করেন। ক্ষতি সংঘটিত হলে বিমা কোম্পানি যথারীতি বিমা দাবি পরিশোধ করে ।
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যে কোনো বৈধ অর্থনৈতিক কাজকে ব্যবসায় বলে । এই বৈধতার প্রশ্নটি আইনের সাথে সম্পর্কিত । আইনে যে সকল ব্যবসায়কে বা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যকে অবৈধ বলা হয়নি তাই বৈধ ব্যবসায় হিসেবে গণ্য । তিন বন্ধু অংশীদারি চুক্তি করে চোরাচালানির ব্যবসায়ে নেমে পড়লো। এতে ব্যবসায়ের সকল বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকলেও আইনগতভাগে উক্ত কাজ বৈধ না হওয়ায় তা ব্যবসায় নয়। এভাবেই ব্যবসায় করতে হলে আইনে বিভিন্ন বিধি-বিধান মেনে চলার বাধ্য-বাধকতা আরোপ করা হয়েছে। কোম্পানি গঠন করতে হলে নিবন্ধন নিতে হয় । ব্যাংক ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান সদস্য ভিন্ন জনগণ থেকে আমানত সংগ্রহ করতে পারে না- এগুলো আইনের বিধান। এখন যদি কোনো সমবায় সমিতি অধিক লাভ দেখিয়ে জনগণ থেকে আমানত সংগ্ৰহ করে তবে তা আইনগতভাবে বৈধ না হওয়ায় বৈধ ব্যবসায় হতে পারে না । ডেসটিনি, যুবক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান বৈধ কার্যক্রম পরিচালনা না করায় তা সরকার বন্ধ করে দিয়েছে এবং এ সকল প্রতিষ্ঠান জনগণের জন্য ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে । বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী ব্যবসায় চালাতে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয় । নির্ধারিত মান অনুসৃত হবে এটা নিশ্চিত করার শর্তে মান বিষয়ক সনদে বাংলাদেশে BSTI-এর অনুমোদন লাগে। একজন একটা বই লিখলো । আরেকজন উক্ত বই হুবুহু নকল করে ছাপিয়ে বাজারে বাজারজাত করলো । এটা আইনের পরিপন্থি। লেখকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আইনের বিধান রয়েছে । ইউনিলিভার ‘লাক্স' ব্রান্ড নামে বাজারে গায়ে মাখা সাবান বাজারজাত করে । আরেকজনও লাক্স নামে বাজারে সাবান বাজারজাত শুরু করলো । এক্ষেত্রে Lux ব্রান্ড নাম নিবন্ধিত করা থাকলে অন্যে তা ব্যবহার করতে পারবে না । যেই প্রতিষ্ঠান তার প্রয়াস-প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে গ্রান্ড নাম, লোগো ইত্যাদি জনপ্রিয় করেছে, তাদের পরিচিতির বাহন হিসেবে এগুলো তুলে ধরেছে তাদের সেই স্বার্থ সংরক্ষণে আইন রয়েছে । Bata একটা ব্রান্ড নাম। এখন একইভাবে মানুষকে প্রতারিত করার জন্য Bala, Beda, Rata ইত্যাদি নাম ব্যবহার করা হয় যা অন্যায় । গার্মেন্টস শিল্পে শিশু শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না এটা মেনেই এ ব্যবসায় চালাতে হয়। ইট ভাটা করতে হলে অধিক পরিবেশ দূষণ করে এমন চিমনি ব্যবহার করা যাবে না, শিল্প বর্জ্য শোধন করতে হবে, ভেজাল পণ্য বিক্রয় করা যাবে না- এ সকল নানান বিষয়ে বিভিন্ন আইন দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রবর্তন ও প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ বৈধতার সাথে ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন আইন মেনে চলা প্রয়োজন । এ সকল আইন মিলিয়ে ব্যবসায়ের যে আইনগত দিক ফুটে ওঠে তাকেই ব্যবসায়ের আইনগত দিক বলে । তাই এ সম্পর্কে জানা ও মানা প্রত্যেক ব্যবসায়ীর জন্য অবশ্য করণীয় ।
আজকের শিল্পজগত যার আবিষ্কারের কাছে ঋণী তিনি হলেন শিল্প বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃত স্কটিশ ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জেমস ওয়াট (James Watt) (১৭৩৬-১৮১৯)। তিনি প্রখ্যাত Glasgow বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রপাতি উৎপাদক হিসেবে কাজ করার সময় দেখতে পান যে, যে সকল ইঞ্জিন ডিজাইন ব্যবহার হচ্ছে তাতে ইনার্জির যথেষ্ট অপচয় ঘটছে এবং সিলিন্ডারকে বারে বারে ঠাণ্ডা করতে যেয়ে সময়েরও অপচয় হচ্ছে। তিনি | এমন একটা নতুন ডিজাইন উপস্থাপন করেন যেখানে আলাদা কনডেন্সার (Condenser) ব্যবহারের নির্দেশ করা হয় এবং ঘূর্ণায়মান যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। এতে সময় ও শক্তির অপচয় ব্যাপক হ্রাস পায়। এতে নতুন ইঞ্জিন আবিষ্কারের ধারণা তার মধ্যে শক্তিশালী হয় । অতঃপর তিনি তার আবিষ্কারকে বাণিজ্যিকভাবে সফল করার জন্য বিত্তবান ব্যক্তি মি. ম্যাথিউ বোল্টনকে পার্টনার করে সোহো ফাউথ্রি নামে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন । এখানেই গবেষণার মধ্য দিয়ে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হয়। এরপর এটি পেটেন্টের রাজকীয় সনদ লাভ করে । এরপর অনেকেই এই আবিষ্কারকে নকল করে এগুতে চেয়েছে কিন্তু প্রতিটা মামলায় রায় এসেছে জেমস্ ওয়াটসের পক্ষে। প্যাটেন্ট নামক এই আইনগত সুরক্ষা পরবর্তীতে হাজারো আবিষ্কারে মানুষকে উৎসাহ জুগিয়েছে। আর এভাবেই ঘটেছে শিল্প বিপ্লব ।
প্যাটেন্ট হলো নতুন আবিষ্কৃত ও নিবন্ধিত পণ্য বা বস্তুর ওপর আবিষ্কারকের এমন একচ্ছত্র অধিকার যার বলে তিনি এটি তৈরি, উন্নয়ন, ব্যবহার ও বিক্রয়ের একক অধিকার ভোগ করেন । এর বলে আবিষ্কারক অন্যকে লাইসেন্সও প্রদান করতে পারেন । কোনো আবিষ্কারকে প্যাটেন্ট সনদ পাওয়ার উপযোগী হতে হলে তাতে নিম্নের চারটি উপাদান থাকা আবশ্যক :
প্যাটেন্টের মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন প্রযুক্তি ও শিল্পের উন্নয়নে আবিষ্কারককে উৎসাহ প্রদান করা । এর ফলে আবিষ্কারক তার আবিষ্কারের সুফল ভোগের বিষয়ে যেমনি নিরাপত্তা বোধ করে তেমনি এটা দেখে অন্যরাও নতুন আবিষ্কারে মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত হয়। আইনানুযায়ী প্যাটেন্ট নবায়নযোগ্য নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিধান অনুযায়ী প্যান্টেন্ট সনদ ১৭ বছর পর্যন্ত বহাল থাকে। বাংলাদেশে ১৯১১ সালের প্যাটেন্ট ও ডিজাইন আইন প্রচলিত রয়েছে । এর বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্যাটেন্ট সনদের সময়কাল ১৬ বৎসর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ । উল্লেখ্য, ২০০১ সালে সরকার নতুন একটা প্যাটেন্ট ও ডিজাইন আইনের খসড়া প্রস্তুত করলেও অদ্যাবধি পার্লামেন্টে তা পাস হয়নি ।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ধারায় নতুন আবিষ্কার ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে প্যাটেন্ট যে অনেক আগে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বৃটেনকে আধুনিক সভ্যতার সুতিকাগার হিসেবে গড়ে উঠতে প্যাটেন্ট-এর যে মূল্যবান ভূমিকা ছিল তা অনস্বীকার্য । চতুর্দশ শতকেই ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাজা প্যাটেন্ট সনদ চালু করেন। তখন নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বা আমদানিকৃত প্রযুক্তির ওপর উদ্ভাবক বা আমদানিকারককে বিশেষ সংরক্ষণ অধিকার Letter of Patent মঞ্জুর করা হতো যাতে তাদের একক কর্তৃত্ব বজায় থাকে । বর্তমানকালে প্যাটেন্ট আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। World Intellectual Property Organization (WIPO) কোনো দেশকে প্যাটেন্ট দেয়ার পূর্বে তা যেন আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ এবং যথাযথ Patent Documentation এর ব্যবস্থা করা হয় এজন্য চাপ দিচ্ছে । অর্থাৎ প্যাটেন্ট সববিচারে এখন প্রযুক্তির জগতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । নিম্নে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এর সুবিধা তুলে ধরা হলো:
১. উদ্ভাবকের সুবিধা (Advantages of innovator) : প্যাটেন্টের মাধ্যমে একজন উদ্ভাবক প্রথমত তার কাজের আইনগত স্বীকৃত পায়। সেই সাথে অন্যদের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সে মুক্তভাবে ও নিরাপদে এর ব্যবহার, ভোগ বা বিক্রয় করতে পারে। উদ্ভাবক প্যাটেন্ট নিবন্ধন পাওয়ার পর প্যাটেন্ট অফিস নিজ দায়িতেই তা জনগণের উদ্দেশ্যে প্রচার করে; যা উদ্ভাবককে এটি বিক্রয় ও রপ্তানিতে সহযোগিতা দিয়ে থাকে। এটি আবিষ্কারককে তার আবিষ্কার নিয়ে এগিয়ে যেতে ও নতুন নতুন আবিষ্কারে প্রণোদনা যোগায় ।
২. আমদানিকারকদের সুবিধা (Advantages of importer) : প্যাটেন্ট সনদপ্রাপ্ত নতুন প্রযুক্তি আমদানিতে আমদানিকারকগণ উৎসাহ বোধ করেন। আমদানিকারক যখন উদ্ভাবকের সাথে চুক্তি করে নিজ দেশে উত্ত প্রযুক্তির ব্যবহারপূর্বক উৎপাদন ও বিক্রয়ের নিরাপদ সুবিধা ভোগ করে তখন অন্যান্য দেশ থেকেও সে এভাবে প্রযুক্তি আমদানিতে উৎসাহিত হয়। আমদানিকারক প্রাপ্ত লাইসেন্স বলে উক্ত আবিষ্কারকে নিজ দেশেও প্যাটেন্ট। করতে পারে। এতে অন্য প্রতিষ্ঠানের এ নিয়ে কোনো অন্যায় সুবিধা লাভের সুযোগ থাকে না ।
৩. অন্যান্যদের সুবিধা (Advantages of others) : প্যাটেন্টের ফলে আবিষ্কারের ওপর আবিষ্কারকের নিরঙ্কুশ অধিকার লাভের ফলে শুধুমাত্র আবিষ্কারকই উপকৃত হয় না অন্যরাও এরূপ আবিষ্কারে উৎসাহিত হয়। কষ্ট ও সাধনার মধ্য দিয়ে লেখা একটা বই যখন নকল হয়ে যায় বা কপিরাইট আইন ভঙ্গ করে অন্যরা এর সুবিধা ভোগ করে তখন লেখকই শুধু নয় অন্য নতুন লেখকরাও হতাশ হয় । তাই যদি এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকে তবে লেখকরা যেভাবে উৎসাহিত হয় প্যাটেন্টের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। বৃটেনে নতুন নতুন আবিষ্কারক সৃষ্টি হওয়ার পিছনে প্যাটেন্টের যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল তা অনস্বীকার্য ।
৪ রাষ্ট্রের সুবিধা (Advantages of state) : রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো জনগণের জীবন মানের উন্নতি বিধান করা । এজন্য দেশের শিল্পখাত, কৃষিখাতসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন অপরিহার্য। এরূপ উন্নয়ন নির্ভর করে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর । নতুন আবিষ্কার যেমনি একটা জাতিকে উপকৃত করে তেমনি প্যাটেন্ট আমদানির সুযোগ থাকায় নতুন নতুন প্রযুক্তি আমদানির ফলে দেশ উপকৃত হয়। চীনের দ্রুত উন্নতির পিছনে বড় কারণ হলো নতুন নতুন প্রযুক্তি আমদানিতে তাদের ব্যাপক আগ্রহ। এতে তাদের দেশের আবিষ্কারকগণও উৎসাহিত হয়ে প্যাটেন্ট সুবিধার বিষয় মাথায় রেখে নতুন নতুন আবিষ্কারে এগিয়ে এসেছে। যা আধুনিক চীন গঠনে ভূমিকা রেখেছে।
নতুন আবিষ্কারের মর্যাদা লাভের পাশাপাশি এর ওপর একচ্ছত্র অধিকার ভোগের জন্যই আবিষ্কারককে প্যাটেন্ট সনদ সংগ্রহ করতে হয়। প্যাটেন্ট নিবন্ধন পাওয়ার প্রথম অধিকারী হলেন এর আবিষ্কারক বা উদ্ভাবক । উদ্ভাবক থেকে লাইসেন্সবলে প্রাপ্ত ব্যক্তিও প্যাটেন্টের জন্য আবেদন করতে পারেন। দেশে বা দেশের বাইরেও প্যাটেন্ট সনদের জন্য আবেদন করা যায়। নিম্নে বাংলাদেশে বহাল ১৯১১ সালের প্যাটেন্ট ও ডিজাইন আইন অনুযায়ী প্যাটেন্ট নিবন্ধনের বিভিন্ন পদক্ষেপ উল্লেখ করা হলো :
১. আবেদন পেশ (Submission of application) : কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের হোন বা না হোন একলা বা কারও সাথে একত্রে প্যাটেন্ট নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত ফরমে ও নির্ধারিত পদ্ধতিতে ফি সমেত প্যাটেন্ট নিবন্ধকের কার্যালয়ে আবেদন জমা দেবেন। যৌথ আবেদনের ক্ষেত্রে প্রথম আবিষ্কারক কে তার উল্লেখ করতে হবে। অন্য কেউ আবেদন করলে এরূপ আবেদন দাখিলের পক্ষে আবিষ্কারক বা তাদের পক্ষ থেকে যথাযথ অনুমোদন আবেদনের সাথে সংযুক্ত করতে হবে।
২. আবিষ্কারের প্রকৃতি বর্ণনা (Description of the nature of innovation) : আবিষ্কার সম্পূর্ণ অবস্থায় প্যাটেন্টের জন্য আবেদন করা হলে আবিষ্কারের প্রকৃতি এবং যে পদ্ধতিতে তা সম্পন্ন করা হয়েছে ঐ পদ্ধতি বশদভাবে বর্ণনা করতে হবে। এছাড়া আবিষ্কারের প্রকৃতি বর্ণনা করে স্বতন্ত্র বিবৃতিও দিতে হবে- যাতে সম্পূর্ণ নতুন আবিষ্কার হিসেবে এটাকে নিরূপণ করা যায়। এক্ষেত্রে ডিজাইন বা ড্রয়িংও নিবন্ধক চাইতে পারেন। প্রয়োজন মনে করলে নিবন্ধক আবিষ্কৃত বিষয়বস্তুর নমুনা বা মডেল উপস্থাপনের নির্দেশ দিতে পারেন। অসম্পূর্ণ আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও প্যাটেন্টের জন্য আবেদন করা যায়। সেক্ষেত্রে আবিষ্কারের প্রকৃতি বর্ণনা করে স্বতন্ত্র বিবৃতি নিতে হবে এবং আবেদনের তারিখ থেকে নয় মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ আবিষ্কার জমা দিতে হবে।
৩. আবেদনপত্র ও আবিষ্কার পরীক্ষা (Examining the application and innovation) : সম্পূর্ণ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে আবেদন পত্র ও এর সাথে প্রাপ্ত আবিষ্কারের প্রকৃতি ও পদ্ধতি সম্পর্কিত বর্ণনা এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ডিজাইন ও ড্রয়িং, মডেল ও নমুনা বিষদভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য নিবন্ধক তা নিরীক্ষকের কাছে পাঠাবেন । নিরীক্ষক আবিষ্কারের প্রকৃতির সাথে পদ্ধতির মিল রয়েছে কি না, পদ্ধতিটি যথাযথভাবে বর্ণিত কি না, শিরোনামের সাথে যথাযথভাবে মিলে কি না, অঙ্কন ও মডেল যথার্থ কি না, অন্য কোনো আবিষ্কারের সাথে এর কোনো মিল রয়েছে কি না, এটি মৌলিক প্রকৃতির না অন্য কিছু ইত্যাদি বিষয় বিশদভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন । প্রয়োজনে নিরীক্ষক সংশোধনী আনার সময় দিবেন ও সংশোধিত বিষয়াদি পুনঃনিরীক্ষা করবেন।
৪. আবেদনপত্র গ্রহণ (Accepting application) : পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আবেদন গ্রহণযোগ্য হলে নিবন্ধক উক্ত গ্রহণ বিষয়ে আবেদনকারীকে বিজ্ঞপ্তি দিবেন এবং এ বিষয়ে পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন প্রদান করবেন। যাতে এ আবিষ্কারের বিষয়ে যদি কারও কোনো অভিযোগ থাকে তবে সে তা উত্থাপন করতে পারে । এ ছাড়া জনগণকে দেখা ও পরীক্ষা করার জন্য আবেদনপত্র, এর বিষয়বস্তু, পদ্ধতিগত বর্ণনা, ডিজাইন, ড্রয়িং, মডেল ইত্যাদি যেখানে যতটা প্রযোজ্য পরিদর্শনের নিমিত্তে খোলা রাখার ব্যবস্থা করবেন।
৫. প্যাটেন্ট বা নিবন্ধন পত্র প্রদান (Issuing patent or registration letter) : কোনো দিক থেকে কোনো বিরোধিতা লক্ষ না করলে বা বিরোধিতার ক্ষেত্রে তা উপযুক্ত বিবেচিত না হলে নিবন্ধক তার অফিসের সীলমোহর করা প্যাটেন্ট সনদ এর গ্রহীতাকে প্রদান করবেন। এরূপ সনদ এর আবিষ্কারককে সমগ্র বাংলাদেশে তার আবিষ্কার তৈরি, বিক্রয়, ব্যবহার এবং অন্যকেও এরূপ করার লাইসেন্স প্রদানের একছত্র অধিকার প্রদান করবে। এরূপ প্যাটেন্ট শুধুমাত্র একটি আবিষ্কারের জন্যই প্রদত্ত হবে এবং প্যাটেন্টের তারিখ থেকে তা ১৬ বৎসর সময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে ।
আরিয়ান টিভিতে একটা নতুন বিজ্ঞাপন দেখছে। সে প্রথম দিকে বুঝে উঠতে পারেনি এটা কিসের বিজ্ঞাপন। পরে বুঝলো বিজ্ঞাপনটি একটা মোবাইল ফোন কোম্পানির। কারণ তিনটা পাখা সম্বলিত একাধিক ছবি ভেসে আসলো । আর এতেই তার বুঝতে বাকি থাকলো না এটা গ্রামীণ ফোনের বিজ্ঞাপন । শুভ্র খেলতে ভালোবাসে । তার গায়ের গেঞ্জি, পায়ের কেস, মাথার টুপি-সর্বত্রই হকি খেলার ব্যাটের ন্যায় চিহ্ন । এটা নাইকি নামক নামকরা খেলার সামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের লোগো বা প্রতীক। এই চিহ্নগুলোর সবই কোনো কোম্পানির পণ্যের মালিকানা নির্দেশ করে। যা ট্রেডমার্ক নামে গণ্য ।
ট্রেডমার্ক হলো পণ্য বা ব্যবসায়ের এমন কোনো স্বতন্ত্রসূচক বৈশিষ্ট্য, চিহ্ন বা প্রতীক যা সকলের নিকট ব্যবসায় বা পণ্যকে সহজে পরিচিত করে তোলে এবং এর মালিকের তা ব্যবহারের একচ্ছত্র অধিকার নির্দেশ করে। মার্ক বলতে সাধারণত কোনো নিশানা, ছাপ বা চিহ্নকে বুঝায় । বাংলাদেশে প্রচলিত ২০০৯ সালের ট্রেডমার্ক আইনে মার্ক বলতে কোনো ডিভাইস (Device), ব্রান্ড (Brand), শিরোনাম (Heading), লেবেল (Label), টিকেট, নাম, স্বাক্ষর, শব্দ, প্রতীক, সংখ্যা, সংখ্যাযুক্ত উপাদান, রং এর সমন্বয় বা এগুলোর যে কোনোরূপ সমন্বয়কে বুঝায়। Bata, Lux-এগুলো নাম। মোবাইল ফোন অপারেটর বাংলা লিংকের ট্রেডমার্কে কয়েকটি রংয়ের সমন্বয় ঘটেছে।
ট্রেডমার্কের মূল বিষয় হলো অন্য পণ্য বা প্রতিষ্ঠান থেকে এর স্বাতন্ত্র্যতা বা ভিন্নতা। এই ভিন্নতা যদি দৃশ্যমান না হয় বা অন্যের পণ্য সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি করে অথবা এর উৎপত্তিস্থল বা অন্য কোনো বিষয় জনগণকে বিভ্রান্ত করে তবে তা ট্রেডমার্ক হিসেবে গণ্য হতে পারে না। কেউ যদি 'ঘড়ি' নাম দিয়ে ঘড়ি উৎপাদন
ও বিক্রয় করে তবে ঐ 'ঘড়ি' নাম স্বাতন্ত্র্যসূচক নয়। কারণ অনেকেই ঘড়ি উৎপাদন করছে। আমরা যেভাবে তরি-তরকারি, ফলমূল ইত্যাদি দেখে কিনি ঘড়িতো সেভাবে দেখে কেনা যায় না । ঘড়ির কোন ব্রান্ড বা ট্রেডমার্ক কোন ধরনের মান মেনে চলে ক্রেতা তা জানার চেষ্টা করে। CASIO, ROLEX, TITAN এভাবে ব্রান্ড নামে সে কেনে। একইভাবে কোনো পণ্যের নামের প্রতীক যদি FRANCE দেয়া হয় তবে সেটা ফ্রান্সের তৈরি মনে করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে । তবে সাবানের বা ঘড়ির ব্রান্ড নাম যমুনা হলে সমস্যা নেই ।
ট্রেডমার্ক নিবন্ধন না করেও তা ব্যবহার করা যায়। ব্যবহারের পরেও এক পর্যায়ে তা নিবন্ধন করা চলে । তবে সমস্যা হলো অনিবন্ধিত ট্রেডমার্ক লঙ্ঘিত হলে আইনত তার প্রতিকার দাবি করা যায় না এবং কেউ একবার ঐ নাম নিবন্ধিত করলে তার প্রতিকার লাভ দুষ্কর হয়ে পড়ে। তাই ট্রেডমার্ক নিবন্ধন করাই উত্তম । এর নিবন্ধনও যথেষ্ট সহজ। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অফিস যেখানে অবস্থিত সেখানকার ট্রেডমার্ক নিবন্ধকের অফিসে প্রয়োজনীয় ফি সহ আবেদন করে এরূপ নিবন্ধন করা যায় । তবে এক্ষেত্রে ঐ নামে বা প্রতীকে পূর্বে কোনো নিবন্ধন নেয়া রয়েছে কি না তা আগেই নিবন্ধক অফিস থেকে জেনে নিতে হয়। ট্রেডমার্ক নিবন্ধনের মেয়াদসীমা আইন অনুযায়ী ৭ (সাত) বছর । তবে এরপর থেকে যথানিয়মে ফি দিয়ে তা নবায়ন করা যায়। এক্ষেত্রে নিবন্ধক একই সময়ে ফি নিয়ে ১০ (দশ) বছর পর্যন্ত ট্রেডমার্ক নবায়ন করতে পারেন। যা পরবর্তীতেও চালু থাকে। মধ্যযুগের শুরুতে সর্বপ্রথম রোমান রাজাগণ তাদের ব্যবহার্য তরবারির স্বকীয়তা রক্ষায় ট্রেডমার্কের ধারণার প্রয়োগ শুরু করেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। ফলে তাদেরকেই ট্রেডমার্কের প্রথম ব্যবহারকারী মনে করা হয়ে থাকে। অবশ্য ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এ ধারণার প্রয়োগ ঘটে শিল্প বিপ্লবকালে। ১৮৫৭ সালে সর্বপ্রথম ফ্রান্সে এ লক্ষ্যে আইন পাস হয়। যুক্তরাজ্যে আইন পাস হয় ১৮৬২ সালে। সর্বপ্রথম বৃটিশ আইনের অধীনে লোগো হিসেবে নিবন্ধন পায় Bass Brewery
যখনই আমরা কোনো একটা ট্রেডমার্কের নাম শুনি বা চোখে দেখি তখনই প্রতিষ্ঠান ও পণ্য সম্পর্কে যে একটা ধারণার জন্ম নেয় তা নিঃসন্দেহে অনেক বড় বিষয় । একটা ট্রেডমার্ক থেকে এর মালিক, বিক্রেতা ও গ্রাহক সবাই উপকৃত হয়ে থাকে । নিম্নে তা তুলে ধরা হলো:
১. মালিকের সুবিধা (Advantages of owners ) : একটা নিবন্ধিত ট্রেডমার্কের মালিকের বড় সুবিধা হলো এটি তার প্রতিষ্ঠানের অদৃশ্যমান একটা মূল্যবান সম্পদ। যেই প্রতিষ্ঠান কোনো নাম, প্রতীক বা চিহ্নকে জনপ্রিয় করেছে দীর্ঘকাল তার সুফল ভোগ করার ক্ষেত্রে তার একচ্ছত্র অধিকার থাকবে-এটাই স্বাভাবিক । ট্রেডমার্ক বা ব্রান্ড একটা প্রতিষ্ঠিত হলে তাকে ব্যবহার করে এর মালিক দ্রুত নতুন নতুন পণ্য বাজারে এনে এ নামের সুফল ভোগ করতে পারে । স্কয়ার কোম্পানি তাদের স্কয়ার নাম ব্যবহার করে যে পণ্যই বাজারে আনুক সাথে সাথে তার একটা ক্রেতাশ্রেণি লাভ করবে। এভাবে ব্রাক আড়ং নামে পোশাক, হস্তজাত সামগ্রী, দুধ ইত্যাদি বাজারজাত করছে। আড়ং ট্রেডমার্ক জনপ্রিয় হওয়ায় তারা এ মার্ক ব্যবহার করে নতুন ব্যবসায়ে হাত দিলে তাতেও দ্রুত সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হবে।
২. ক্রেতা ও ভোক্তাদের সুবিধা (Advantages of customers and consumers) : ট্রেডমার্ক বা ব্রান্ড নামে পণ্য ক্রয় করতে যেয়ে ক্রেতা বা ভোক্তারও অনেক সুবিধা পায় । এরূপ মার্কযুক্ত কোনো পণ্যের মান, মূল্য, স্বাদ, গুণ ইত্যাদি সম্পর্কে ক্রেতাদের পূর্ব ধারণা থাকায় তারা পূর্বসিদ্ধান্ত নিয়ে সহজেই এরূপ পণ্য সংগ্রহ করতে পারে । ব্রান্ড প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে পূর্ব ধারণা থাকলে ক্রয় সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। এ ছাড়া ট্রেডমার্কযুক্ত কোনো ব্রান্ড পণ্য কিনলে উক্ত পণ্য যদি নষ্ট, খারাপ বা ব্যবহার অযোগ্য হয় তবে ক্রেতা সেক্ষেত্রে আইনগত সুবিধাও। পেয়ে থাকে । বিভিন্ন ট্রেডমার্কের পণ্য বাজারে থাকায় একজন ক্রেতা স্বনামধন্য পণ্যের ব্রান্ড ব্যবহার করে বা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের পণ্য ব্যবহার করে নিজের পৃথক মর্যাদাও প্রতিষ্ঠা করতে পারে ।
৩. বিক্রেতাদের সুবিধা (Advantages of sellers): ট্রেডমার্কযুক্ত পণ্য বিক্রয়ে বিক্রেতারাও বিশেষ সুবিধা ভোগ করে । এরূপ পণ্য বিক্রয়ে ক্রেতাদের সাথে তাদেরকে অযথা বাক্য বিনিময় বা দরকষাকষি করতে হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্রেতা তার পছন্দের ব্রাণ্ডের পণ্য নাম, পণ্যের মূল্য ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত থাকায় সে দোকানে যেয়ে তার নির্দিষ্ট ব্রান্ড দেখেই তা থেকে পণ্য ক্রয় করে। মোবাইল ফোন সেট উৎপাদনকারী ব্রান্ড NOKIA, SAMSUNG, SYMPHONY কোনটা একজন গ্রাহক কিনবে সে তা পূর্ব থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়। তাই বিক্রেতাকে এ নিয়ে কোনো কথা বলারই তেমন প্রয়োজন পড়ে না । ব্রান্ড পণ্য বাজারে সুখ্যাতি লাভ করলে পরিবেশক, ডিলারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শো-রুম খুলে সহজেই তা বিক্রয় করতে পারে ।
মি. জামান তার দীর্ঘদিনের পাঠদান অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিবিএ সম্মান শিক্ষার্থীদের জন্য। একটা পাঠ্যবই রচনা করে নিজ খরচে তা প্রকাশ করলেন। বইটি বাজারে আসার ক'দিনের মধ্যেই তার বইয়ের। অনেক অংশ হুবুহু নকল করে আগে থেকে বাজারে চালু থাকা বইয়ের একজন লেখক তার বইয়ের নতুন সংস্করণ প্রকাশ করলো । মি. জামানের লেখা হুবহু নকল করা হয়েছে-এটার প্রমাণ দেখাতে না পারায় তার সারা জীবনের সাধনা এখন অন্যের সৃষ্টিকর্ম হিসেবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করলো। মি. রফিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ফটোগ্রাফীর ওপর কোর্স করে দেশে এসে আবহমান বাংলার বিভিন্ন বিষয়কে তার ছবিতে তুলে এনেছেন। তিনি তার সৃষ্টিকর্মের গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলো কপিরাইট করছেন । একটা ব্যাংক তাদের ক্যালেন্ডার তৈরিতে তার কতকগুলো ছবি প্রকাশ করায় মি. রফিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনগত প্রতিকার দাবি করেন । ব্যাংক তাঁকে নায্যে ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বাধ্য হয়। উভয় ক্ষেত্রেই লেখক শিল্পীর প্রতিকার পাওয়া ও না পাওয়ার পার্থক্য হলো কপিরাইট নিবন্ধন করা ।
লেখক বা শিল্পী কর্তৃক তার সৃষ্টকর্মের ওপর একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থায়ী আইনগত অধিকারকে কপিরাইট বলে । এটি একটি আইনগত ধারণা। যার উদ্দেশ্য হলো নকল করা থেকে প্রকৃত লেখক, শিল্পী বা সৃষ্টকর্মের স্বত্বাধিকারীর স্বার্থ সুরক্ষা করা; যা না করা হলে এর স্বত্বাধিকারী বা মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় । কপিরাইটের ধারণা প্রথমত ছাপা বা মুদ্রণের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও বর্তমানে যে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টিকর্মের ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ হয়ে থাকে। বই, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, নাটক, চলচ্চিত্র, নৃত্য, সংগীত কৌশল, অডিও রেকডিং, সাউন্ড রেকডিং, শিল্প সংক্রান্ত নকশা, চিত্রলেখ বিষয়ক নকশা, ফটোগ্রাফস্, স্থাপত্য শিল্পকর্ম, সফটওয়্যার ইত্যাদি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সুরক্ষা কপিরাইটের অন্তর্ভুক্ত।
বই লেখকদের আইনগত অধিকার সংরক্ষণের জন্য বৃটেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লস পার্লামেন্টে সর্বপ্রথম ১৬৬২ সালে The Press Act পাস করেন। এতে নিবন্ধিত বইয়ের তালিকা সংরক্ষণের বিধান ছিল । পরে ১৭১০ সালে লেখকসহ বিভিন্ন শিল্পকর্মের মালিক বা শিল্পীদের উক্ত কর্মের ওপর ব্যক্তিগত অধিকার সংরক্ষণের জন্য The British Statute of Anne 1710 পাস করা হয়। এতে লেখকদের পাশাপাশি বই প্রকাশকদের একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অধিকার সংরক্ষণের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অর্থাৎ লেখক বা শিল্পকর্মের মালিক তার অধিকার অন্যের নিকট হস্তান্তর করতে বা বিক্রয় করতে পারবে- এই বিধানও এতে সন্নিবেশিত ছিল । ১৭১০ সালে পাস করা এই ডাইনকেই বর্তমানকালের কপিরাইট আইনের ভিত্তি বিবেচনা করা হয়ে থাকে । এখন বাংলাদেশে ২০০০ সালের কপিরাইট আইন (২০০৫ সালের সংশোধনীসমেত) ও কপিরাইট বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী এ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় । বর্তমান বিশ্বায়নের এ যুগে কপিরাইট অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে সংরক্ষণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়ে থাকে । বাংলাদেশ Universal Copyright Convention 1952 তে স্বাক্ষরকারী দেশ। ফলে এর বিধানাবলি মেনে চলতে বাংলাদেশ বাধ্য ।
বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টিকর্মের ওপর স্বত্ত্বগ্রহীতার মৌলিক অধিকার বা স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কপিরাইট আইনের উৎপত্তি । মানুষ যেন সৃষ্টিধর্মী কাজে উদ্বুদ্ধ হয় এবং তার সৃষ্টিকর্ম থেকে সে লাভবান হতে পারে তা নিশ্চিত করাই এরূপ আইনের উদ্দেশ্য। এ আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১. বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সম্পর্কিত (Relatedness with intellectual property): কপিরাইট হলো সৃষ্টিকর্মের ওপর মালিকের আইনগত অধিকার । মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি থেকে সৃষ্ট এই কর্ম বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি হিসেবে পরিচিত । একজন লেখকের লেখা, কবির কবিতা, গায়কের গান ও নতর্কীর নৃত্যের সিডি, ফটোগ্রাফারের ছবি, পরিচালকের বানানো সিনেমা, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত সফটওয়্যার-এর সবই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি । যা কপি বা নকল করে উৎপাদন সম্ভব । এগুলো কপিরাইটের সাথে সম্পর্কিত ।
২. স্বত্বাধিকারীর স্বার্থ সংরক্ষণ (Maintenance of interest of owners): লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক বা এ ধরনের ব্যক্তিবর্গ তাদের মেধা, শ্রম ও অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে যে সৃজনশীল কর্মের জন্ম দেন উক্ত কর্মের ওপর ব্যক্তির স্বত্বগত স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করাই কপিরাইট আইনের মূল্য উদ্দেশ্য। একজনের প্রচেষ্টার ফসল যেনো অন্যে যেয়ে যেতে না পারে, যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই সৃষ্টিকর্ম থেকে যেন তিনিই লাভবান হন- এই আইন তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। স্বত্বাধিকারী যেন লাভবান হয়ে আরও নতুন নতুন কর্ম সৃষ্টিতে উৎসাহিত হয় এ আইন তাও নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টা চালায় ।
৩. নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রয়োগ (Application for particular time period): কপিরাইট আইনে স্বত্বাধিকারীর অধিকার একটা সময় পর্যন্ত সংরক্ষণের নির্দেশ থাকে; যেমন- প্রকাশিত সাহিত্য (বই, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি), নাটক, সঙ্গীত ও শিল্পকর্ম (ফট্রোগ্রাফ ব্যতিত) প্রণেতার মৃত্যুর পরবর্তী ষাট বছর পর্যন্ত কপিরাইট বিদ্যমান থাকে । ফটোগ্রাফ, চলচ্চিত্র ফিল্ম, শব্দ রেকর্ডিং ও ফটোগ্রাফের ক্ষেত্রে তা প্রকাশের বছর থেকে পরবর্তী ষাট বছর পর্যন্ত এই অধিকার প্রযোজ্য। সরকারি, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা কর্তৃক সৃষ্টকর্মের কপিরাইটের ক্ষেত্রেও এই মেয়াদ প্রকাশের বছরের পর ৬০ পত্রিকা বছর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে । প্রকাশিত কর্মের সংস্করণের প্রকাশকের ক্ষেত্রে এই মেয়াদ প্রথম প্রকাশের পর সর্বোচ্চ ২৫ বছর।
৪. কপিরাইট নিবন্ধনের বিষয়টি ঐচ্ছিক (Copyright registration is not compulsory ) : আইনে কপিরাইট নিবন্ধনের বাধ্য-বাধ্যকতা আরোপ করা হয়নি। তবে কপিরাইট নিবন্ধন করা হলে তা আইনানুগ প্রকাশ্য দলিলের মর্যাদা লাভ করে । অন্যথায় তা সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করতে হয়; যা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল । কে.সি. আগরওয়াল বনাম আনন্দ কুমার মোকদ্দমাসহ বিভিন্ন মোকদ্দমার রায়ে এটা প্রমাণিত যে, কপিরাইট নিবন্ধন না করার কারণে এই আইনে বর্ণিত অধিকার থেকে কপিরাইটের স্বত্বাধিকারীকে বঞ্চিত করা যায় না।
৫. অধিকার ভঙ্গের জন্য শাস্তির নির্দেশ (Indicating the penalty for breach of right) : কপিরাইট ভঙ্গ করা হলে ভঙ্গকারীকে শাস্তি পেতে হয়। মি. ইমাম একটা বই লিখেছেন। এখন এই বইটা হুবুহু বা আংশিক নকল করে যদি কেউ ছাপে বা মি. ইমামের নামেই নকল বই বাজারে প্রকাশ করে তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচিত হবে। এজন্য আইনে কারাদণ্ড ও জারিমানা বা উভয়বিধ শাস্তির বিধান রয়েছে।
৬. কপিরাইটের স্বত্বনিয়োগ গ্রহণযোগ্য (Assignment of copyright is acceptable ) : সৃজনশীল কর্মের প্রণেতা বা প্রথম স্বত্বাধিকারী তার অধিকার চুক্তিমূলে অন্যের নিকট হস্তান্তর করতে পারেন। একজন লেখক একটা বই লিখেছেন- তিনি এটা প্রকাশের জন্য প্রকাশকের সাথে কপিরাইট চুক্তি করে তাকে তা ছাপার ও পুনঃছাপার অধিকার প্রদান করতে পারেন। একজন বক্তা তার বক্তৃতার সিডি, একজন গায়ক তার গানের সিডি প্রকাশ, প্রচার ও বিক্রয়ের অধিকার অন্যকে দিতে পারেন। এরূপ স্বত্বনিয়োগীও কপিরাইট আইন অনুযায়ী নিবন্ধন করার অধিকার এবং সেক্ষেত্রে কপিরাইট অধিকার ভোগ করে থাকেন।
প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করে প্রণেতা বা আবেদনকারীর নামসহ সৃষ্টিকর্মের নাম ও বিবরণাদি কপিরাইট রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করার কাজকেই কপিরাইট নিবন্ধন বলে । কপিরাইট নিবন্ধকের অফিসে আবেদন করে আইনের ধারা অনুযায়ী এরূপ নিবন্ধন কর্ম সম্পাদন করতে হয় । নিম্নে এরূপ নিবন্ধন বিষয়ে ২০০০ সালের কপিরাইট জাইন ও ২০০৬ সালের কপিরাইট বিধিমালায় উল্লেখ প্রয়োজনীয় বিধানাবলি উল্লেখ করা হলো:
১. নিবন্ধনের আবেদন কে করতে পারেন (Who can apply for registration) : কোনো কর্মের প্রণেতা, প্রকাশক বা কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী বা এতে স্বার্থ রয়েছে এমন ব্যক্তি সৃজনশীল কর্মটি নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত ফি প্রদান পূর্বক নির্ধারিত ফরম পূরণ করে আবেদন করতে পারবেন ।
২. আবেদন দাখিলের পদ্ধতি (Method of submission of application) : আবেদনকারীকে অত্র বিধিমালার ২য় তফসিলে বর্ণিত ফরম পূরণপূর্বক প্রয়োজনীয় ফি সহ তিন প্রস্থে দাখিল করতে হবে । উল্লেখ্য কপিরাইট নিবন্ধকের অফিস থেকেও এরূপ ফরম সংগ্রহ করা যায়। প্রথম স্বত্ত্বাধিকারীর ক্ষেত্রে এ ফি-এর পরিমাণ ১,০০০ (এক হাজার) টাকা । তবে প্রকাশক বা অন্যদের জন্য লাইসেন্স বা স্বত্বাধিকার নিবন্ধনের বেলায় ফি-এর ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে।
৩. আবেদনপত্রের বিষয়বস্তু (Content of application) : কপিরাইট আইন বিধিমালার ১ম তফসিলের ২নং ফরমে উল্লেখ আবেদনপত্রের বিষয়বস্তু নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
৪. স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহকে আবেদনপত্রের কপি প্রেরণ (Sending the copy of application to the rested groups ) : আবেদনকারীকে এরূপ আবেদনের কপি স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষ যদি থেকে থাকে তবে তাদের নিকট পাঠাতে হবে । যাতে উক্ত পক্ষ বিষয়টি জানতে পারে এবং এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে তা নিবন্ধক বরাবর উপস্থাপন করতে পারে। একজন গীতিকার গান রচনা করেছেন। সুরকার ও গায়ক অন্য ব্যক্তি হতে পারেন। এক্ষেত্রে গীতিকার কপিরাইটের আবেদন করলে তা অন্য দু'পক্ষকে জানাতে হবে ।
উল্লেখ্য সাহিত্যকর্ম, নাট্যকর্ম, কম্পিউটার সফটওয়্যার, সঙ্গীতকর্ম ও শিল্পকর্মের বেলায় কর্মটি মৌলিক কর্মের অনুবাদ অথবা মৌলিক কর্মের অভিযোজন তার সুস্পষ্ট উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে। অনুবাদ ও অভিযোজন (Addition)-এর ক্ষেত্রে মৌলিক কর্মটির শিরোনাম এবং তার ভাষা, মৌলিক কর্মের লেখক বা প্রণেতার নাম, ঠিকানা ও জাতীয়তা, মৌলিক কর্মটির প্রকাশকের নাম, ঠিকানা ও জাতীয়তা এবং অনুবাদ বা অভিযোজনের ক্ষমতা প্রাপ্তির বিষয়ে অনুমোদনের প্রয়োজনীয় বিবরণসহ ক্ষমতা প্রদানকারীর নাম, ঠিকানা ও জাতীয়তা উল্লেখ করতে হয়।
৫. আবেদনপত্র মূল্যায়ন ও নিবন্ধন সনদ প্রদান (Evaluating application and issuing registration certificate) : কপিরাইট নিবন্ধনের আবেদন প্রাপ্তির পর নিবন্ধক তার বিবেচনায় উপযুক্ত এমন প্রয়োজনীয় তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা বা খোঁজ-খবর করবেন। অতঃপর আবেদনপত্র গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলে কপিরাইট রেজিস্ট্রারে কর্মের নাম, শিরোনাম, গ্রন্থকার, প্রণেতা, প্রকাশক এবং কপিরাইটের স্বত্বাধিকারীগণের নাম, ঠিকানা, জাতীয়তাসহ প্রয়োজনীয় সকল বিষয় লিপিবদ্ধ করবেন এবং আবেদনকারীকে নিবন্ধন সনদ প্রদান করবেন ।
কপিরাইট আইন অনুযায়ী মৌলিক কর্মের রচিয়তা কর্মটির অনুলিপি তৈরি, প্রকাশ, পুনঃপ্রকাশ, প্রচার, অনুবাদ বা অভিযোজন (Addition) করার একচেটিয়া কর্তৃত্বের অধিকারী। যথাযথ অনুমোদন বা লাইসেন্স ছাড়া বা লাইসেন্সে প্রাপ্ত ক্ষমতার বাইরে যেয়ে যদি কেউ উক্ত কর্ম বা এর অংশবিশেষ উৎপাদন, পুনঃউৎপাদন, অনুবাদ বা অভিযোজন কর্ম সম্পাদন করে তবে তা কপিরাইটের লঙ্ঘন বলে ধরা হয়। এরূপ লঙ্ঘন বা ভঙ্গের পরিণতি প্রতিকার সম্পর্কে আইনে নিম্নরূপ বিধান প্রদত্ত হয়েছে :
তবে চলচ্চিত্রের কপিরাইট বা এতদসংশ্লিষ্ট আইনে বর্ণিত অন্য কোনো অধিকার ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘন করতে কাউকে সহায়তা করলে সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর এবং কমপক্ষে এক বছর মেয়াদে কারাদণ্ড এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামের লঙ্ঘিত কপি অনুলিপি করে প্রকাশ, বিক্রয় বা বিতরণ করলে সেক্ষেত্রে অনুর্ধ চার বছরের কারাদণ্ড এবং অন্যুন ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং অনুর্ধ চার লক্ষ টাকা ও অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে দণ্ডনীয় হবে ।
টেলিভিশনের একটা বিজ্ঞাপন । বিষয়বস্তু হলো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছে । টেলিভিশনের পর্দায় এটা দেখে স্ত্রী হা-হুতাশ করছেন। সকল শ্রমিক নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পেরেছে এটাও প্রচারিত হচ্ছে। স্বামী স্ত্রীকে প্রবোধ দিচ্ছেন তাদের ফ্যাক্টরিটি একটা বিমা কোম্পানিতে বিমাকৃত। তাই ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে। এই যে সম্পত্তির ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা, মানুষ মারা গেলে নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এর সবই বিমার বদৌলতে সম্ভব হচ্ছে।
মানুষের জীবন ও সম্পদকে ঘিরে যে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বিদ্যমান তার বিপক্ষে আর্থিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই হলো বিমা। বিমা হলো বিমাকারী ও বিমাগ্রহীতার মধ্যে সম্পাদিত এক ধরনের চুক্তি যেখানে বিমাকারী প্রিমিয়ামের বিনিময়ে বিমাগ্রহীতার জীবন ও সম্পত্তির ঝুঁকি নিজের কাঁধে গ্রহণ করে । সমাজে দু'ধরনের বিমা প্রতিষ্ঠান মূলত কাজ করে । এর একটি হলো জীবন বিমা ও অন্যটি হলো সাধারণ বিমা। জীবন বিমায় মানুষের মৃত্যুজনিত ঝুঁকি মূলত বিমা করা হয়। এটি নিশ্চয়তার চুক্তি। অর্থাৎ বিমাকৃত ব্যক্তির মৃত্যু হলে বা ব্যক্তি অক্ষম হলে কত টাকা ক্ষতি হবে যেহেতু তা নিরূপণ করা যায় না তাই বিমা কোম্পানি চুক্তি মোতাবেক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি বা নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। ব্যক্তি মারা গেলে বা অক্ষম হলে বিমা কোম্পানি প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদানে বাধ্য থাকে। অন্যদিকে সাধারণ বিমা হলো সম্পত্তি বিমা। এটি ক্ষতিপূরণের চুক্তি । অর্থাৎ বিমাকৃত সম্পত্তির আংশিক বা সামগ্রিক যে কোনো ধরনের ক্ষতি হলে বিমা কোম্পানি তা পরিশোধ করে থাকে । নৌ-পথে চলাচলকৃত জাহাজ, জাহাজে বাহিত পণ্য ও মাশুলের জন্য নৌ বিমা, গুদামের মালামাল, কারখানা ইত্যাদির অগ্নিজনিত ক্ষতির জন্য অগ্নিবিমা, সড়কপথে চলাচলকৃত বিভিন্ন যানের জন্য যানবাহন বিমা ইত্যাদি এর বিষয়বস্তু ।
বিমা ব্যবসায়কে ঝুঁকি বণ্টনের ব্যবস্থা নামেও আখ্যায়িত করা হয়। একই ধরনের ঝুঁকির বা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন ব্যক্তিবর্গ তাদের জীবন ও সম্পত্তি বিমা করার জন্য বিমা কোম্পানি বরাবর হাজির হয়। যদি দেখা যায়, সাধারণত বছরে ১,০০০টা জাহাজ বিমা করা হয়। তবে বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে বিমা কোম্পানি হিসাব করে যে, সর্বোচ্চ কয়টা জাহাজের ক্ষতি হতে পারে বা কী পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ করতে হতে পারে। সেই বিচারে সম্ভাব্য ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে খরচ ও লাভসমেত প্রিমিয়ায়ের একটা পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এই প্রিমিয়ামই হলো বিমা কোম্পানির আয়। যেখানে থেকে ক্ষতি হলে সে ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ মালিকদেরকে ক্ষতিপূরণ করে । বিমার বিষয়বস্তুতে বিমাগ্রহীতার আর্থিক স্বার্থ বা বিমাযোগ্য স্বার্থ না থাকলে বিমা করা যায় না। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মধ্যে সদ্বিশ্বাসের সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। ফলে একে অন্যকে প্রয়োজনীয় সকল তথ্য সরবরাহে বাধ্য থাকে । বিমা সমগ্র বিশ্বেই এখন অত্যন্ত অপরিহার্য সহায়ক ব্যবসায় কার্যক্রম হিসেবে গণ্য। বাংলাদেশে ২০১০ সালের বিমা আইন অনুযায়ী এরূপ ব্যবসায় পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে ।
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে উৎপাদন বন্টন ও এর সহায়ক যে কোনো বৈধ কাজকে ব্যবসায় বলে। ব্যবসায়ের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা। ঝুঁকি বলতে আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনাকে বুঝায় । এই ক্ষতির বোঝা মাথায় নিয়েই একজন ব্যবসায়ীকে ব্যবসায় করতে হয়। কিন্তু সেই ক্ষতি যদি তার সারা জীবনের সাধনাকে নিমিষেই নিঃশেষ করে দেয়, অজানা আশঙ্কা যদি তাকে সবসময়ই তাড়া করে ফেরে তবে ব্যবসায়ীর পক্ষে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবসায় করা সম্ভব হয় না । এই সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্যই বিমা ভূমিকা রেখে চলেছে। নিম্নে ব্যবসায়ে বিমার প্রয়োজনীয়তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
বিমা করার প্রক্রিয়া বলতে মূলত বিমা চুক্তি সম্পাদন প্রক্রিয়াকে বুঝায়। এক্ষেত্রে একদিকে থাকে। বিমাগ্রহীতা- যিনি আর্থিক স্বার্থ রয়েছে এমন জীবন বা সম্পত্তি বিমা করে তার ঝুঁকি বিমা কোম্পানির ওপর অর্পণ করতে চায় এবং অন্যদিকে থাকে বিমাকারী বা বিমা কোম্পানি- যারা প্রিমিয়ামের বিনিময়ে অন্যের জীবন ও সম্পত্তির ঝুঁকি গ্রহণ করে এবং দুর্ঘটনা ঘটলে বা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ বা প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদানে বাধ্য থাকে। এরূপ চুক্তি সম্পাদনে যে সকল পদক্ষেপ সাধারণত গ্রহণ করা হয় তা নিম্নরূপ :
১. প্রস্তাব প্রদান (Offering proposal) : বিমা করতে আগ্রহী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে জীবন বিমার বেলায় জীবন বিমা কোম্পানি থেকে এবং সম্পত্তি বিমার বেলায় সাধারণ বিমা অফিস থেকে বা তাদের এজেন্ট থেকে প্রস্তাব ফরম সংগ্রহ করে তা পূরণপূর্বক প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ জমা দিতে হয় । জীবন বিমার বেলায় বিমাকৃত ব্যক্তির পরিচয়, বয়স, পেশা, শারিরীক সুস্থতা, বিমাপত্রের ধরন, বিমাকৃত অঙ্কের পরিমাণ ইত্যাদি উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে। সম্পত্তি বিমার বেলায় সম্পত্তির ধরন, অবস্থান, মূল্য, সম্পত্তির মান, শক্তি ব্যবহারের ধরন, ব্যবহার পদ্ধতি ইত্যাদি নানান বিষয় উল্লেখ করতে হয়। সম্পত্তি বিমার বেলায় আবেদনকারীকে সম্পত্তির ওপর বিষাযোগ্য স্বার্থ রয়েছে তা প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় মালিকানার ও অন্যান্য দলিল জমা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে ।
২. প্রস্তাব বিবেচনা (Considering proposal): প্রস্তাব ও দলিলপত্র পাওয়ার পর বিমা কোম্পানি প্রস্তাব গ্রহণ করা যায় কি না এ বিষয়টি বিবেচনা করে । জীবন বিমার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ব্যক্তির বয়স, স্বাস্থ্য, পেশা, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ঝুঁকির মাত্রা বোঝার চেষ্টা করে থাকে। নৌ বিমার ক্ষেত্রে জাহাজের মান, যে পথে জাহাজ চলাচল করে তার ধরন, জাহাজ কোম্পানির পূর্বে ক্ষতি সংঘটনের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয় । অগ্নিবিমার ক্ষেত্রে বিমাগ্রহীতার চরিত্র, সম্পত্তির অবস্থান, প্রকৃতি, অগ্নিজনিত ঝুঁকির মাত্রা ইত্যাদি বিষয় বোঝার চেষ্টা করে। জীবন বিমার বেলায় প্রয়োজনে ডাক্তারি পরীক্ষা এবং সম্পত্তি বিমার বেলায় সার্ভেয়ার দিয়ে সম্পত্তির মান, মূল্য ইত্যাদি পরীক্ষা করানো হয়। এতে প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হলে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় অন্যথায় তা ফেরৎ দেয়া হয়ে থাকে।
৩. প্রিমিয়াম জমাদানের নির্দেশ ও বিমাপত্র ইস্যু (Order to deposit premium and issuing policy): বিমা কোম্পানি প্রস্তাব গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে এ বিষয়ে লিখিতভাবে আবেদনকারীকে অবগত করে এবং নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে প্রিমিয়াম জমাদানের নির্দেশ দেয়। বিমা অফিসে প্রিমিয়াম জমা দেয়া হলে তখন থেকেই বিমা চুক্তি কার্যকর হয়। কিন্তু তৎক্ষণাৎ বিমাপত্র ইস্যু করা অনেকসময়ই সম্ভব হয় না। এজন্য কিছু সময়ের দরকার হয় এবং এ সময়ের মধ্যে বিমা চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি পত্র ইস্যু করে । অনেক সময় জমা রসিদও এ ধরনের স্বীকৃতিপত্র বিবেচিত হতে পারে। অতঃপর স্ট্যাম্পযুক্ত বিমাপত্র বিমা কোম্পানি থেকে ইস্যু করা হয়। এতে বিমাকৃত বিষয়বস্তু, বিমাকৃত বিপদ বা ঝুঁকিসহ প্রয়োজনীয় সকল বিষয় লেখা থাকে ।
পরিবেশের সাথে প্রাণীজগত ও তার পারিপার্শ্বিকতার যে ওতপ্রোত সম্পর্ক বিরাজমান তা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটি নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত আইনসমূহকে পরিবেশ আইন বলে । মানুষের উপজীবিকার একটা গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো ব্যবসায় । এই ব্যবসায়ের ওপর যেমনি প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক বিভিন্ন পরিবেশের প্রভাব অনস্বীকার্য তেমনি ব্যবসায়ের দ্বারাও পরিবেশ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয় । গাছ কেটে ইটের ভাটায় জ্বালানির যোগান দিচ্ছে মানুষ। এতে বন ও গাছ-গাছালি কমে যাওয়ায় পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে ইটের ভাটা থেকে নির্গত ধুয়া বায়ু দূষণ করে পরিবেশের ক্ষতি করছে। পোড়া ইটের টুকরা মাটির সাথে মিশে মাটি দূষিত হচ্ছে। এভাবে দেখা যাবে মুনাফা অর্জনের জন্য একজন ব্যবসায়ী পরবর্তী ফলাফল বুঝে বা না বুঝেই পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনছে। রাস্তায় পরিবহণের গাড়ি চলছে এতে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণসহ পরিবেশে তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শিল্পবর্জ্য নির্দ্বিধায় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে পানিতে। এতে পানি দূষণ হচ্ছে। এভাবে ব্যবসায় কার্যক্রম এখন পরিবেশ বিনষ্টের মুখ্য কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য প্রয়োজন বিভিন্ন পরিবেশ আইনের এবং তার কঠোর অনুশীলনের।
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিবেশ দূষণের বিষয়টি সমগ্র বিশ্বেই এখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় । সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্য ও সেবার যোগান দিয়ে চলেছে ব্যবসায়। মানুষের ভোগের প্রবণতা বাড়ায় শিল্পোৎপাদন বেড়েছে ব্যাপক হারে। নানান ধরনের সেবা শিল্পের দ্রুত বিস্তৃতি ঘটছে। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিযোগিতা । কত কম খরচে পণ্য উৎপাদন করে বাজার দখল করা যায়-এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের নিরন্তর প্রচেষ্টা। কিন্তু তার এ কাজ পরিবেশের ওপর কী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এটা বোঝার কোনো সময় ও সুযোগ তার নেই । বাংলাদেশে বর্জ্য শোধন যন্ত্র (Effluent Treatment Plant /ETP) প্রতিষ্ঠা ছাড়া শিল্প অনুমোদন না দেয়ার বিধান থাকলেও তা কতটা মানা হচ্ছে তা দেখার যেন কেউ নেই । এভাবেই সবার চোখের সামনে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো নানানভাবে পরিবেশ দূষণ করে চলছে । নিয়ে ব্যবসায় কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের দূষণ সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো;
১. শব্দ দূষণ (Sound pollution) : পারিপার্শ্বিকতায় শব্দ ও কোলাহল বেড়ে যাওয়ার কারণে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে যে অস্বাভাবিকতার জন্ম নেয় তাকে শব্দ দূষণ বলে। শান্ত ও নিরিবলি পরিবেশ মানুষসহ সকল সৃষ্টিকূলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ । ব্যবসায়ের উন্নয়ন এবং বাজার ও শহর সৃষ্টি শব্দ দূষণের অন্যতম কারণ। উড়োজাহাজ উঠছে ও নামছে এতে শব্দ দূষণ ঘটছে। রেলগাড়ি, বাস-ট্রাকসহ সব ধরনের পরিবহন শব্দ দূষণের কারণ । গাড়ির হর্ণ ঢাকা শহরে অসহ্য । মেশিনের শব্দ, বুলডোজার ও ড্রিলের শব্দ, নির্মাণ কাজ ইত্যাদি নানান কাজে শব্দ দূষণ ঘটছে । গ্রামের বাজারে উচ্চ আওয়াজে দোকানে সিডি বাজছে, মাইকিং হচ্ছে- এগুলোও শ দূষণের কারণ হিসেবে গণ্য ।
২. পানি দূষণ (Water pollution) : পানির স্বাভাবিকতায় প্রাণীজগত ও সৃষ্টিকূলের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকরণের কাজকেই পানি দূষণ বলে । পানির অপর নাম জীবন। পানি তার স্বাভাবিকতা হারালে প্রাণীজগত ও সৃষ্টিকূলের জন্য তা কতটা বিপর্যয়কর হতে পারে ঢাকার আশে পাশের নদীগুলো দেখলেই আমরা তা বুঝতে পারি। সৃষ্টিতে পানির অপরিহার্যতার কারণেই সৃষ্টিকর্তা হয়তোবা তিনভাগ জল ও একভাগ স্থল সৃষ্টি করেছেন। মানুষের জীবন ধারণ ও কর্মকাণ্ডের প্রতিটা মুহূর্তেই পানির যে প্রয়োজন তা আমাদের সবার নিকট দৃশ্যমান। অথচ এই পানিতে হাড়ি-বাসন ধোয়া, কাপড়-চোপড় ধুয়ে ক্ষার পানিতে ছেড়ে দেয়াসহ অসংখ্য পানি দূষণের কাজ হচ্ছে। শিল্পবর্জ্য, পয়ঃময়লা যখন নির্দ্বিধায় পানিতে ছেড়ে দেয়া হয় তখন ঐ পানি মানুষের জন্য আর উপকারী থাকে না। নদীতে ও সমুদ্রে জলযান চলছে। তৈল, ময়লাসহ নানান আবর্জনা ফেলা হচ্ছে পানিতে। তৈল ট্যাংকার ফেটে ও খনি থেকে তৈল নির্গত হচ্ছে পানিতে। এতে পানি তার স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে। এভাবেই ব্যবসায় কর্মকাণ্ড পানি দুষম বিরূপ ভূমিকা রাখছে।
৩. বায়ু দূষণ (Air pollution) : স্বাভাবিক উপাদানের বাইরে বায়ুতে যখন নানান ধরনের ধুয়া, গ্যাস, ধুল বালি, সিসাসহ নানান খারাপ উপাদান যুক্ত হয় তখন তাকে বায়ু দূষণ বলে। মানুষ ও প্রাণীজগতের সুস্থ র স্বাভাবিক বেঁচে থাকার জন্য নির্মল বায়ু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । গাছপালাও তার প্রয়োজনীয় উপাদান নিচ্ছে বায়ু থেকে । কিন্তু ব্যবসায় আজ এই নির্মল বায়ু থেকেও মানুষকে বঞ্চিত করছে । ঢাকা শহরের কথাই যদি ধরা হয় তবে পরিবহণের গাড়িগুলো প্রতিদিন যে পরিমাণ ধুয়া ছড়াচ্ছে তাতে ঢাকার বাতাস দুষিত হচ্ছে। ইটের ভাটা আমাদের দেশের বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। শিল্প কারখানার ধুয়া, ধুলা-বালি, পরিবহণের ধুয়া থেকে নির্গত সিসা ইত্যাদি বায়ু দূষণ করছে। জুম চাষের জন্য বন পোড়ানো হচ্ছে, দাবানল সৃষ্টি হচ্ছে এতেও বায়ু দূষণ ঘটছে ।
৪. মাটি দূষণ (Soil pollution): উর্বর মাটি যখন নানান খারাপ উপাদানযুক্ত হয়ে তার স্বাভাবিকতা হারায় তখন তাকে মাটি দূষণ বলে। আবহমান কাল থেকে এই মাটি মানুষের খাদ্য যোগানে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গাছ-পালা, ফল-মূল সবই এই মাটি থেকে সৃষ্ট। কিন্তু এই মাটিও আজকে ব্যবসায় কর্মকাণ্ডের কারণে দূষণের অসহায় শিকার। কৃষি ফার্মগুলো অতিরিক্ত সার আর কীটনাশক ব্যবহার করে মাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিল্পব জমিতে ফেলে মাটির ক্ষতি করা হচ্ছে। ইটের ভাটার টুকরো ইট মাটির সাথে মিশে মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করছে। খনি থেকে সম্পদ আহরণের ফলে জমি যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি এ সকল খনিজ পদার্থ মাটির সাথে মিশে মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে। ভূগর্ভস্থ পানি অধিক মাত্রায় উঠিয়ে ফেলার কারণে মাটির শুষ্কতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিচ দিয়ে যখন বিদ্যুত, গ্যাসসহ নানান সংযোগ লাইন টানা হচ্ছে তাতেও মাটি তার স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে।
মি. রাইয়ান মানসম্মত পণ্য ও সেবা কেনার বিষয়ে খুবই আগ্রহী । বাজারে যেভাবে ভেজালের সয়লাব চলছে, খাবারে যেভাবে নানান অস্বাস্থ্যকর রাসায়নিক সামগ্রী মেশানো হচ্ছে, মুখে মিষ্টি কথা বলে সেবা প্রদানে যেভাবে ঠকানো হচ্ছে, চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন দিলেও কথা ও কাজে যখন হর-হামেশা অমিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে তখন মি. রাইয়ান কোথায় ভালো পণ্য ও সেবা পাবেন সে বিষয়ে সবসময়ই সতর্ক থাকেন। প্রতিষ্ঠানের মান যাচাই করতে চেষ্টা করেন। আর এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান ও পণ্যমানের যথার্থতার সনদ প্রদানের বিষয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে কাজ করে এটাও তার জানা । ISO এমনই একটা প্রতিষ্ঠান।
একটা প্রতিষ্ঠান কতটা মানসম্মত পণ্য ও সেবা সরবরাহ করে এবং তাদের ব্যবস্থাপনার মান কেমন এ বিষয়ে সনদ প্রদানকারী একটা আস্তর্জাতিক মান প্রতিষ্ঠানই হলো ISO (International Standard Organization, যার পরিবর্তিত নাম International Organization for Standardization)। ISO সর্বপ্রথম সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৭ সালে ISO ৯০০০ নামে একটা মান নির্দিষ্ট করে তা অর্জনের যোগ্যতা ও গুণাবলি নির্দিষ্ট করে সংশ্লিষ্ট দলিলাদি প্রস্তুত ও প্রকাশ করা হয়। এ সময় থেকেই যারা এই মান অর্জন ও বজায় রাখতে সক্ষম তাদের একটা সময়কাল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে এই মান সনদ দেয়ার কাজ শুরু হয়। ইউরোপ, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এই মান সনদ লাভে আগ্রহ প্রকাশ করায় দ্রুত তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানও ইতোমধ্যে এ সনদ লাভ করেছে। পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি ক্যাটাগরিতে মান নির্দিষ্ট করে ৯০০১, ৯০০২, ৯০০৩, ৯০০৪ নামে মান সনদসহ বিভিন্ন মানসনদ চালু করা হয়েছে। ইদানিং ২০১৪ নামে আরেকটি মান সনদ চালু হয়েছে। এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
১. ISO 9000 মান সনদ: ISO 9000 হলো একসেট মানদণ্ড, যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটি পণ্য বা সেবার আন্ত জাতিক মান নিশ্চিত করে। এটি মান কর্মসূচির একটি সনদ, যা এর বিশেষজ্ঞরা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম পরীক্ষার পর প্রদান করেন। এ সনদের জন্য প্রতিষ্ঠানকে কতকগুলো প্রয়োজনীয় শর্ত মেনে চলতে হয়। কোনো প্রতিষ্ঠান ISO 9000 হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে ক্রেতারা এর মান সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা অর্জন করে । ISO 9000 উৎপাদককে সব সময় ক্রেতার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য পণ্যমান নিশ্চিত করতে হয় । ISO 9000 প্রকৃতপক্ষে ৫টি সনদ দ্বারা গঠিত। এগুলো হলো- ISO 9000, ISO 9001, ISO 9002, ISO 9003, এবং ISO 9004 ।
২. ISO 14000: ISO 14000 একটি পরিবেশ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা সিস্টেম। ১৯৯৬ সালে International organization for standardization একসেট নতুন মানদণ্ড প্রবর্তন করে, যার নাম ISO 14000 । ISO 14000 পরিবেশ সম্পর্কিত দায়িত্বের শর্তাবলির উপর ভিত্তি করে একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যসম্পাদন (Performance) নির্ধারণ করে। প্রাথমিকভাবে, ISO 14000 একটি স্বেচ্ছামূলক দিকনির্দেশনা এবং সনদপত্র কর্মসূচি হিসেবে শুরু করা হয়। এ সনদপত্রের মানদণ্ড ৪টি প্রধান দিক চিহ্নিত করে। এগুলো হলো-
পণ্যমান নিয়ে সকল মানুষই এখন সচেতন । এই মান নিশ্চিত করার জন্য সবদেশেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে । বাংলাদেশে BSTI এমন একটা প্রতিষ্ঠান। বর্তমান বিশ্বায়নের এ যুগে আন্তর্জাতিক পণ্য ও সেবার মান নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকা খুবই স্বাভাবিক। সে অবস্থায় এরূপ মান বিষয়ে আন্তর্জাতিক মান সনদ দেয়ার মর্জে যোগ্যতাসম্পন্ন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । ISO এ ধরনেরই একটা বেসরকারি সংস্থা (NGO) । নিম্নে এর গুরুত্ব উল্লেখ করা হলো :
ভালো মানের পণ্য ও সেবা নিশ্চিত করতে ISO এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । শুধুমাত্র পণ্য ও সেবার উপাদানগুলো বিবেচনা করেই নয় এর বাইরেও পণ্য ও সেবার মান ধরে রাখতে যে সকল বিষয় ভূমিকা রাখে তা দেখার কারণে ISO মান সনদ আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত সমাদৃত ।
ISO সনদ প্রত্যাশী প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবার মান দেখার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনার মান, কর্মীদের মান, কার্যপদ্ধতি ও অভ্যন্তরীণ পরিবেশের বিভিন্ন দিকগুলো বিবেচনা করায় এটা একটা প্রতিষ্ঠানের round নৈপুণ্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে ।
মানুষ পণ্য কেনে প্রয়োজন পূরণের জন্য। কিন্তু কোন পণ্য প্রয়োজন পূরণে কতটা সমর্থ তা মানুষের পক্ষে সর্বত্র বুঝে নেয়া সম্ভব হয় না। চাল, ডাল, মরিচ, তরকারি ইত্যাদি দেখে কেনা যায়। কিন্তু যখন মরিচের গুড়া কেনা হয় তখন এ গুড়ার প্যাকেটে আরো কিছু মেশানো হয়েছে কি না এটা দেখার উপায় নেই । কেউ টেলকম পাউডার কিনবে। এখন এর মধ্যে কী আছে, কতটা ত্বকের জন্য উপযোগী এটাতো বোঝা যাবে না । এভাবে = নানান সামগ্রী আমরা যা কিনি তার মান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বা মানসম্মত পণ্য সামগ্রী যাতে ভোক্তাসাধারণ ভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। এজন্য সরকার যে সংস্থাকে এরূপ দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে তাই বি.এস.টি.আই নামে পরিচিত ।
বাংলাদেশের পণ্যের মান নির্ধারণ, পণ্যমান পরীক্ষা ও মান নিশ্চিত করার জন্য যেই সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্মরত রয়েছে তাকে বিএসটিআই বলে। ১৯৮৫ সালে সরকার এক অর্ডিন্যান্স বলে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড ইনস্টিটিউশন ও সেন্ট্রাল টেস্টিং ল্যারবেটরিজ নামক দু'টি প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করে বর্তমান বি.এস.টি.আই নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এর উদ্দেশ্য হলো শিল্প, খাদ্য ও রসায়নিক পণ্যের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের জন্য একটা জাতীয় মান তৈরি করা এবং ঐ মান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা। একই সাথে মেট্রিক পদ্ধতি চালু এবং ওজন ও পরিমাপের যথার্থতা দেখাশুনার দায়িত্বও এ প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত করা হয় । এছাড়াও সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে যে সকল পণ্যের জন্য বাধ্যতামূলক মান নিবন্ধনের নির্দেশ দেবে সেটার মান পরীক্ষা করে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করাও এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। বাংলাদেশে এ প্রতিষ্ঠানটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন একটা প্রতিষ্ঠান ।
ষোলো কোটি মানুষের এ দেশে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পণ্য ও সেবার মান নির্দিষ্টপূর্বক তার যথার্থতা নিশ্চিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান BSTI । আমাদের দেশে উৎপাদন ব্যবস্থা ততটা সংহত নয়। গ্রামে-গঞ্জে যে যেভাবে পারে পণ্য উৎপাদন করে তা বাজারজাত করে। ক্রেতাসাধারণও পণ্যমান সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায় এরূপ পণ্য বাজারে অবাধে বেচাকেনা হয়। তারপরও এর মধ্যেই BSTI তার সামর্থ্য মতো কাজ করে চলেছে। নিম্নে এর কার্যাবলি উল্লেখ করা হলো:
প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বনে গাছ বড় হয়, সেবা যত্নের তেমন প্রয়োজন হয় না। সাগরে মাছ পাওয়া যায়, খাদ্য-খানা দেয়া ও যত্ন আবশ্যক হয় না। কিন্তু যখন বনায়ন করা হয়, মাছ চাষ করা হয় তখন অনেক সেবা- যত্নের প্রয়োজন পড়ে । ফরেস্ট অফিসার লাগে, ফিশারি অফিসার লাগে এবং আরও কত কিছুর প্রয়োজন পড়ে- যার সহযোগিতা ব্যতিত এ কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা যায় না। তাই আজকের দিনে কার্যকর সহায়ক সেবা ছাড়া কোনো জিনিসই সঠিকভাবে গড়ে তোলা, লালন-পালন ও পরিচালনা করা সম্ভব নয়। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি আরও বেশি প্রযোজ্য। একটা দেশে ব্যবসায় কতটা স্বচ্ছন্দ্বের সাথে গড়ে উঠবে, পরিচালিত হবে-তার সাথে এই সহায়ক সেবা সম্পর্কযুক্ত। ব্যবসায় শিক্ষা শাখার শিক্ষার্থীদের আগামী দিনে ব্যবসায় গড়তে ও ব্যবসায় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে এই সহায়ক সেবাগুলো সম্পর্কে ধারণা লাভ এবং কী, কোথায়, কিভাবে ও কতটা পাওয়া যায় সেই সম্পর্কে জ্ঞান লাভ অপরিহার্য ।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে শিক্ষার্থীরা (শিখন ফল)
১. সহায়ক সেবার ধারণা ও প্রকারভেদ ব্যাখ্যা করতে পারবে
২. বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা থেকে প্রাপ্ত সহায়তা ব্যাখ্যা করতে পারবে
৩. বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে প্রাপ্ত সহায়তা ব্যাখ্যাকরতে পারবে
৪. এসএমই ফাউন্ডেশন (SME) থেকে প্রাপ্ত সহায়তাব্যাখ্যা করতে পারবে
৫. বেসরকারি সংস্থা থেকে প্রাপ্ত সহায়তা ব্যাখ্যা করতেপারবে
৬. শিল্প ও বণিক সমিতি এবং বিজিএমইএ থেকে প্রাপ্ত সহায়তা ব্যাখ্যা করতে পারবে
৭. রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো থেকে প্রাপ্ত সহায়তা ব্যাখ্যা করতে পারবে
৮. ব্যবসায় সহায়তা দানকারী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা ও কার্যক্রম বিশ্লেষণ করতে পারবে
সম্প্রতি এমবিএ পাস করে নাহিদ শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্লাস্টিক সামগ্রী প্রস্তুতের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি চট্টগ্রামে প্লাস্টিক সামগ্রী প্রস্তুতের কারখানা গড়ে তোলেন ।
স্বপন ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আর লেখাপড়া করতে পারেনি। কী করবে যখন ভাবছিল তখন তার এক বড় ভাই তাকে পরামর্শ দিল যুবক ও যুব মহিলাদের সরকার নানান বিষয়ে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন কাজ শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়। সে হাঁস-মুরগী পালনের ওপর প্রশিক্ষণ নিলো এবং বাড়ির পাশের ছোট জায়গায় খামার গড়ার কথা ভাবলো । কিন্তু টাকার প্রয়োজন। আত্মকর্মসংস্থান ব্যাংক ঋণ দিল। ফার্ম গড়ার পর মুরগীর নিয়মিত টীকা দেয়ার জন্য সে স্থানীয় একটা এনজিওএর সাথে যোগাযোগ করে তারও ব্যবস্থা করলো। এখন জনাব স্বপনের ফার্ম ভালই চলছে । এক্ষেত্রে যুব অধিদপ্তর, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও এনজিও প্রতিষ্ঠান সবাই তার ব্যবসায়ে সহায়ক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। যাদের সহযোগিতা বাতিরেকে স্বপনের পক্ষে এই ফার্ম গড়ে তোলা ও ভালোভাবে চালানো সম্ভব ছিল না।
একটা ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যে সেবার প্রয়োজন পড়ে তাকেই ব্যবসায়ের সহায়ক সেবা বলে। ব্যবসায়ের সাথে ঝুঁকি জড়িত। তদুপরি ব্যবসায় শিখতে হয়, বুঝতে হয়। এখানে নানান ধরনের নিয়ম ও বাধ্য-বাধ্যকতা থাকে। তাই কাউকে ব্যবসায়ে নামতে এবং এক্ষেত্রে সফলতা পেতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা বা সেবার প্রয়োজন পড়ে। এরূপ সেবা প্রাপ্তি যত সহজ হয় ততই নতুন নতুন উদ্যোক্তা এসে ব্যবসায়ে নামে। পুরনো ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যায়। এতে দেশের সামগ্রিক ব্যবসায় পরিবেশ উন্নত হয় ।
চীনে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের শিল্প গঠনে সহযোগিতা করার জন্য সরকারি বিভিন্ন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রতিটা এলাকায় বা অঞ্চলে কাজ করে। কেউ শিল্প গড়তে চাইলে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তার জন্য কোন ধরনের ব্যবসায়, কোন এলাকায় করা উচিত হবে এ বিষয়ে পরামর্শ দেয়। অতঃপর প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরি করে তা সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিলে তারা শিল্প এলাকায় প্রয়োজনীয় পরিমাণ জমি বরাদ্দ, লাইসেন্স প্রদান ইত্যাদি কাজ করে দেয়। অতঃপর গ্যাস, পানি, বিদ্যুতসহ ইউটিলিটি সার্ভিসের লোকজন এসে অনেকটা স্ব-উদ্যোগেই এগুলোর ব্যবস্থা করে। ব্যাংক ঋণ দেয়। দ্রুত সময়ে শিল্প তার কাজ শুরু করতে পারে। এ ব্যবস্থা চীনকে দ্রুত অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত করতে সহায়তা করেছে।
বর্তমান বিশ্বে শিল্প-বাণিজ্যের অগ্রগতিই জাতীয় উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । পৃথিবীর যেই দেশ এক্ষেত্রে এগিয়ে তারাই প্রকৃতপক্ষে চালকের আসনে আসীন। তাই প্রতিটা দেশ ব্যবসায় ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে । এজন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানান ধরনের ব্যবসায় সহায়ক সেবা প্রদত্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সেবা ও তা প্রদানের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নিম্নে ধারণা দেয়া হলোঃ
সেবার ধরন | বাংলাদেশে এর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ |
১. উদ্দীপনামূলক সেবা (Stimulatory Service): | যুব অধিদপ্তর, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহিলা অধিদপ্তর, মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা সংস্থা, এনজিও ইত্যাদি । |
২. সমর্থনমূলক সেবা (Supporting service): | বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড, কর্মসংস্থান ব্যাংক, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (NGO), বাণিজ্যিক, ব্যাংক, সরকারি লাইসেঞ্জিং কর্তৃপক্ষ, সরকারি । সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ ( রাস্তা পানি, বিদ্যুত, গ্যাস) ইত্যাদি । |
৩. সংরক্ষণমূলক সেবা (Sustaining service): | বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, BSTI, পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ বাণিজ্য কর্পোরেশন, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন, বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি, বাংলাদেশ তত বোর্ড, বাংলাদেশ রেশম বোর্ড, প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর ইত্যাদি । |
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কাল থেকে যেই সরকারি সংস্থা এই ভূখণ্ডে বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ায় সহায়তা করতে শিল্প নগরী প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন বৈষয়িক ও সমর্থনমূলক সহায়তা প্রদান করে চলেছে তাকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা বলে। বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নের দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত । বিসিকের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় শিল্প সহায়ক কেন্দ্র, শিল্প নগরী, নৈপুণ্য বিকাশ কেন্দ্র, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও নকশা কেন্দ্রের মাধ্যমে এর কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত জেলা শহরের কাছে বিসিেিকর ৭৪টি শিল্প নগরী রয়েছে। যাতে শিল্প প্লটের মোট সংখ্যা ৯,৭৮৫টি। উক্ত সময় পর্যন্ত ৫,৬৯৮টি শিল্প ইউনিটের বিপক্ষে পুটগুলো বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৪,২৭৮টি শিল্প ইউনিট উক্ত সময়ে উৎপাদনরত ছিল। কর্মরত শিল্প ইউনিটে এ সময়ে কর্মরত জনশক্তির সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখ। বিসিক উপকূলীয় এলাকায় লবণ চাষীদের উৎপাদন কাজেও সহায়তা করছে। সাভার ও কেরাণীগঞ্জে দু'টি চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তোলার কাজ এগুচ্ছে। মুন্সীগঞ্জে ওষুধ শিল্প পার্ক এবং সিরাজগঞ্জে বিসিক শিল্প পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানটির কার্যাবলি নিম্নরূপ :
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যেই ব্যাংক স্বল্প সুদে বা লাভে আমানত সংগ্রহ, ঋণদান ও অন্যান্য ব্যাংকিং সেবা সুবিধা প্রদান করে তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে। এই ব্যাংক স্বল্প মেয়াদি ঋণের ব্যবসায়ী। দেশের ব্যবসায় খাতে ঋণ সহায়তা দানে এই ব্যাংক অনন্য প্রতিষ্ঠান । বাংলাদেশে বিশেষায়িত ব্যাংক ও নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যবসায় খাতে ঋণ দিলেও তাদের কার্যক্রম সীমিত। যেখানে সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ সর্বত্র শাখা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব মানুষকে আর্থিক সেবা দিয়ে চলেছে। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এরূপ ব্যাংকের সহায়তাসমূহ নিম্নরূপ :
দেশের ছয়টি রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক এর শাখা সংখ্যা ২০১৫ এর ডিসেম্বরে ছিল ৩,৬৯০টি এবং উক্ত সময়ে ৩৯টি বেসরকারি দেশীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক এর মোট শাখা সংখ্যা ছিল ৪২২৭টি। উল্লেখ্য, এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ৫৬টি যার মধ্যে ২টি বিশেষায়িত ব্যাংক; বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মোট শাখা সংখ্যা ছিল ১,৪০৬টি এবং ৯টি বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা ছিল ৭৫টি। এতে দেখা যায় ব্যবসায়ে সহায়তা দানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখাসমূহের কার্যক্রম অনেক বিস্তৃত, সংহত এবং কার্যকর।
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে SME (Small) & Medium Enterprise) লোন চালু করেছে। যা সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের মাধ্যমে কার্যত বাস্তবায়িত হচ্ছে । বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখাসমূহ তাদের বিভিন্ন শাখা এবং প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত বা ঘোষিত এস.এম.ই শাখার মাধ্যমে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
উল্লেখ্য ২০১৪-২০১৫ সালে ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ মিলে ৭,০৯,০২৪টি এসএমই-এর অনুকূলে সর্বমোট ১,১০,২৮৭.৯৩ কোটি টাকা এসএমই ঋণ বিতরণ করেছে। অন্যদিকে ৯৩,৯৮৭টি, নারী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সর্বমোট ৩,৯৬৭.৯২ কোটি টাকার এসএমই ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। যার অংশবিশেষ বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন তহবিল থেকে পুনঃঅর্থায়ন করেছে।
দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠাসমূহকে বিশেষ আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর সহায়তায় সরকার বিশেষ যে ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে তাই এসএমই ফাউন্ডেশন নামে পরিচিতি । SMES বলতে Small and Medium Enterprises বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহকে বুঝায় । ২০০৬ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতায় ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের অধীনে অমুনাফাভোগী (Non-profit) প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে। যা ইতোমধ্যেই দেশের ছোট ও মাঝারি শিল্প, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানসমূহকে আর্থিক সহায়তা প্রদানে এক নজীর সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছে। শুধুমাত্র ঋণ প্রদানই নয় উদ্যোক্তা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দান, সমর্থনমূলক বিভিন্ন সহায়তা প্রদান ও নারী উদ্যোক্তাদেরকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠান অনন্য ভূমিকা রাখছে।
ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ৩১ থেকে ১২০ জন কর্মী কাজ করে অথবা মূলধনের পরিমাণ ভূমি ও কারখানা বিল্ডিং বাদে ৭৫ লাখ থেকে ১৫ কোটি টাকা তাকেই ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান বলে । অন্যদিকে যে প্রতিষ্ঠান বা শিল্পে ১২১ থেকে ৩০০ জন কর্মী কাজ করে অথবা মূলধনের পরিমাণ ভূমি ও কারখানা বিল্ডিং বাদে ১৫ কোটি টাকার অধিক থেকে ৩০ কোটি টাকা তাকে মাঝারি প্রতিষ্ঠান বলা হয়ে থাকে। সেবা ও অন্যান্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বেলায় যেখানে ১০ থেকে ৫০ জন কর্মী কাজ করে অথবা মূলধনের পরিমাণ ভূমি ও সংশ্লিষ্ট দালান বাদে ১০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা তাকে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান এবং যেই প্রতিষ্ঠানে ৫১ থেকে ১২০ জন কর্মী কাজ করে অথবা মূলধনের পরিমাণ ভূমি ও দালান বাদে ২ কোটির অধিক থেকে ১৫ কোটি টাকা তাকে মাঝারি প্রতিষ্ঠান বলে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক এক জরীপে দেখা গেছে বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৯০%ই ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের অন্তর্ভুক্ত । দেশের সমগ্র শিল্পে নিয়োজিত জনশক্তির ৯০% ই ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের আওতাধীন। দেশের সমগ্র জনশক্তির ২৫% এ খাতের সাথে জড়িত। SME ফাউন্ডেশন করার পর এ খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় পুনঃঅর্থায়ন করায় দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এ খাতে ঋণ দিতে যথেষ্ট আগ্রহ দেখাচ্ছে। এতে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত আরও বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবে ।
SME ফাউন্ডেশনের নির্দেশনায় ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক এসএমই খাতে বিতরিত ঋণের পরিমাণ ছিল ১,১০,২৮৭.৯৩ কোটি টাকা। এ সময়ে সর্বমোট ৭,০৯,০২৪টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে ঋণ মঞ্জুর করা হয়। উল্লেখ্য SME ঋণ বিতরণে ১৫% ঋণ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে। একই সময়কালে ৯৩,৯৮৭টি এসএমই নারী উদ্যোক্তার বিপরীতে ৩,৯৬৭.৯২ কোটি টাকা ঋণ প্রদত্ত হয়। এসএমই ঋণের সর্বনিম্ন পরিমাণ হলো ৫০ হাজার টাকা। প্রদত্ত ঋণ পুনঃঅর্থায়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য নিম্নে প্রদত্ত হলো:
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে যে তহবিল থেকে পুনঃঅর্থায়ন করা হয় | অর্থায়নকৃত এন্টারপ্রাইজের সংখ্যা (খাতভিত্তিক) | বিভিন্ন মেয়াদি মোট ঋণ (কোটি টাকা) | |||
শিল্প | বাণিজ্য | সেবা | মোট | ||
ক. বাংলাদেশ ব্যাংক তহবিল | ৯,৫০২ | ১৩,৮০৩ | ৩,৭৫২ | ২৭,০৫৭ | ২,৬৩৯.৫৯ |
খ. আই. ডি.এ. তহবিল (বিশ্ব ব্যাংকের) | ১,৩৬৮ | ১,৩০৬ | ৪৮৬ | ৩,১৬০ | ৩১২.৬১ |
গ. এডিবি তহবিল ১ ও ২ (এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের) | ৪,৫৬৫ | ৯,৫৩১ | ২,৮১৩ | ১৬,৯০৯ | ১,০৮১.৮৯ |
ঘ. জাইকা তহবিল | ৩৭৯ | ০৯ | ১২৫ | ৫১৩ | ৩৮৯.৬২ |
মোট | ১৫,৮১৪ | ২৪,৬৪৯ | ৭,০৭৬ | ৪৭,৫৩৯ | ৪,৪২৩.৭১ |
ব্যবসায় প্রকল্পের ধরন অনুযায়ী এসএমই লোনের পরিমাণ সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা । ঋণের মেয়াদ প্রকল্প অবস্থার ওপর নির্ভর করে। তবে তা চলতি মূলধনের ক্ষেত্রে ১ বছর এবং মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি খাতে ৩ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত মঞ্জুর করা হয়ে থাকে । এরূপ ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের যে সকল যোগ্যতা বিবেচনা করা হয় তা হলো-
সমাজের কমবিত্তসম্পন্ন, অসহায় ও পশ্চাদপদ শ্রেণির মানুষকে আর্থিক, বৈষয়িক, শিক্ষাগত, স্বাস্থ্যগত আইনগত ইত্যাদি নানান বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ সারাবিশ্বে এনজিও নামে পরিচিত । উল্লিখিত শ্রেণির মানুষকে সংঘবদ্ধ করে তাদের উন্নয়নের ধারায় নিয়ে আসা এবং তাদেরকে উদ্যোগী, প্রত্যয়ী ও দক্ষ করে গড়ে তোলাও এরূপ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য। দেশ ও বিদেশ থেকে দান, অনুদান ও ঋণ সংগ্রহ করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশী সংস্থা বা সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের অঙ্গীকারে এরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহ অর্থসংস্থান করে। প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তাদের ঋণদান, পরামর্শ প্রদান, প্রশিক্ষণদানসহ নানান সহায়তা দিয়ে এ সকল প্রতিষ্ঠান উদ্দীপনামূলক ও সমর্থনমূলক সেবা সহায়তা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে এনজিও ব্যুরোর অধীনে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিল ২,২০৯টি। ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) প্রতিষ্ঠা করেছে। যার মাধ্যমে জুন ২০১৩ পর্যন্ত ৭১৯ প্রতিষ্ঠানকে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার সনদ প্রদান করা হয়েছে। এদের মধ্যে ব্রাক, আশা, প্রশিকা, স্বনির্ভর বাংলাদেশ, কারিতাস, টিএমএসএস, শক্তি, ব্যুরো বাংলাদেশ, এসএসএস ইত্যাদি নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কোম্পানি আইনের অধীনে অলাভজনক সংস্থা (Non- profit Organization) হিসেবে নিবন্ধিত হয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দেশের প্রধান কয়েকটি এনজিও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ
ব্রাক / BRAC / Bangladesh Rural Advancement Committee
BRAC বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এনজিও প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে জনাব ফজলে হোসেন আবেদের নেতৃত্বে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু । দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ঋণদান কর্মসূচি ছাড়াও এ সংস্থা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে থাকে । বাংলাদেশের সকল জেলায় এ প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি বিস্তৃত। ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত সংস্থাটির মোট ক্রমপুঞ্জিভূত ঋণ বিতরণ ও আদায়ের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১,৬৬,০৯৯.২৬ কোটি ও ১,০৪,৮৮২.২৩ কোটি টাকা। বিতরিত ঋণ সুবিধাভোগীর সংখ্যা ছিল ৫৩,৩৭,৯৫১ জন। যার মধ্যে মহিলা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৬,৭১,০৪৪ জন। প্রতিষ্ঠানটি প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নয়নে যে সকল ক্ষেত্রে ঋণ দেয় তার মধ্যে কাপড় বুনন, হাঁস-মুরগী পালন, আসবাবপত্র তৈরি, তৈল উৎপাদন, গুড়, দড়ি, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী তৈরি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানে ইচ্ছুক যুবক ও যুব মহিলাদের বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে । প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এ প্রতিষ্ঠান পরামর্শক সুবিধা প্রদান করে। আধুনিক ডিজাইন ও প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে গ্রামীণ শিল্পজাত পণ্যের মান উন্নয়নে এ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প; যেমন- হস্তজাতশিল্প সামগ্রী, সিল্ক, জামদানি, নকশী কাঁথা ইত্যাদির উন্নয়নেও ব্রাক কাজ করছে। ব্রাকের নিজস্ব ডেইরি ফার্মে উৎপাদিত আড়ং দুধ বাজারজাত করা হয়। বড় শহরগুলোতে ব্রাকের নিজস্ব বিপণন কেন্দ্র 'আড়ং' সবার নিকট সু পরিচিত।
আশা / ASA
বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ১৯৭৮ সালে আশা প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং ১৯৯২ সালে বিশেষায়িত ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে। আশার উদ্ভাবনমূলক স্বল্প ব্যয় সাপেক্ষ ও টেকসই ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি মডেল হিসেবে বাংলাদেশে পরিচিতি লাভ করেছে। উল্লেখ্য, গ্রামীণ ব্যাংক অনুমোদিত ননব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান; এনজিও নয়। তাদের ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি অত্যন্ত প্রসারিত। তবে বাংলাদেশে যত এনজিও কাজ করছে আশা ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির বিষয়ে অত্যন্ত সফল প্রতিষ্ঠান। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এর ক্রমপুঞ্জিভূত ঋণ বিতরণ দাঁড়িয়েছে ১,০২,৯০৫.০০ কোটি টাকা এবং আদায় ৮৯,৬১১ কোটি টাকা। গ্রামীণ জনপদে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সংগঠিত করে তাদের ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সহায়ক সেবা দিয়ে চলেছে ।
প্রশিকা / Proshika
প্রশিকা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এনজিও। ১৯৭৫ সালে ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জের কয়েকটি গ্রামে প্রশিকার উন্নয়ন কার্যক্রম সূচিত হয় এবং ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে বৃহত্তর পরিসরে কাজ শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের বিকাশে শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র শিল্প, তাত শিল্প, হস্ত শিল্প, গবাদি পশুপালন, মৌমাছি চাষ, চারা উৎপাদনসহ অনেক নতুন নতুন উপজীবিকা সৃষ্টিতে প্রশিকা ভূমিকা রেখেছে। এজন্য প্রশিক্ষণ প্রদান, ঋণদান, তত্ত্বাবধান ইত্যাদি কাজ প্রতিষ্ঠানটি করে থাকে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী প্রশিকা ৫৯টি জেলায় ২৪,১৩৯টি গ্রাম ও ২,৩৮০টি বস্তিতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। এ সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ১৭,৯৪,৭৫৯টি প্রকল্পের মাধ্যমে ক্রমপুঞ্জিভূত ৫,৪০৫.৫৭ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। এ সময় পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিভূত আদায়ের পরিমাণ ছিল ৫,৯৩৬.৩৩ কোটি টাকা ।
স্বনির্ভর বাংলাদেশ / Shanirvar Bangladesh
১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের একটা বিশেষ সেল (Cell) হিসেবে সমাজ উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করলেও ১৯৮৫ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারি সংস্থা হিসেবে নিবন্ধিত হয়ে তৃণমূল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করে সদস্যদের আস্থাবর্ধক বিভিন্ন কাজে লাগানোর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। এ পর্যন্ত ৫০টি জেলার ১৫৯টি উপজেলায় এর কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে । প্রতিষ্ঠানটি আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে শুরু থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৫,১৪,৪০০ জন বিত্তহীন ঋণগ্রহীতাকে ২০৮৩.১২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে এবং খাল আদায় করেছে ১,৮১৩.৬২ কোটি টাকা ।
ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ / Thengamara Mohila Sabuj Sangha TMSS
বগুড়া জেলাকে কেন্দ্র করে ১৯৮০ সালে TMSS বেসরকারি সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করলেও বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বিস্তৃত । প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই দারিদ্র্য দূরীকরণ, আর্থ- সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি মূলত দরিদ্র ও বিত্তহীন। মহিলাদের মধ্যে কাজ করে। তাদেরকে ঋণ সহায়তা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি দোকান পরিচালনা, হাস-মুরগি প্রতিপালন ও খামার পরিচালনা, মাছ চাষ, নার্সারি প্রতিষ্ঠা ও কুটির শিল্পের বিভিন্ন কাজে সহায়তা দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানে সহায়তা করে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৬৩টি জেলার ৩৭,৪০,৭৪৮ জন মহিলাকে এ সংস্থার আওতায় সংঘবদ্ধ করে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিভূত ৯,৪৫৩.৫১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এবং ক্রমপুঞ্জিভূত ৮,৩৫৯.৪৫ কোটি টাকা ঋণ আদায় করেছে।
মাইডাস / Micro Industries Development Assistance Services / MIDAS
ক্ষুদ্র শিল্পে নিয়োজিত প্রান্তিক শিল্প মালিকদের আর্থিক, কারিগরি ও প্রশিক্ষণ সুবিধা দিয়ে দেশের অর্থনেতিক উন্নয়নে তাদের ভূমিকাকে শক্তিশালী করার জন্য ১৯৮১ সালে NGO ব্যুরোতে নিবন্ধন নিয়ে ১৯৮২ সালে থেকে MIDAS তার কাজ শুরু করে। ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তা ও মালিকদের ঋণদান, এর সাথে সম্পৃক্তদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, তথ্য ও পরামর্শ প্রদান, নতুন নতুন ব্যবসায় ক্ষেত্র ও উপায়-পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা, নতুন ব্যবসায় ও পদ্ধতিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিকট জনপ্রিয়করণ, ক্ষুদ্র শিল্পোৎপাদকদের পণ্য ও সেবা বাজারজাতকরণে সহায়তা দান ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি এক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই যথেষ্ট সুনাম অর্জন করতে সমর্থ হয় । পরবর্তীতে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করার জন্য মাইডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেড (MFL) নামে একটা নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠন করে। প্রতিষ্ঠানটি তার ছয়টি কার্যক্রমের মধ্যে MIDI কর্মসূচির অধীনে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানসমূহকে ৫০,০০০ থেকে ১০,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়ে থাকে। এছাড়া SED কর্মসূচির আওতায় ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে ঋণ প্রদান করে ।
কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের, এলাকার বা দেশের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীগণ নিজেদের স্বার্থরক্ষা ও ব্যবসায়িক উন্নয়নের জন্য একত্রিত হয়ে যৌথ প্রচেষ্টায় ও পরিচালনায় যে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে তাকে শিল্প ও বণিক সমিতি বলে । বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে শিল্প ও বণিক সমিতি রয়েছে । একইভাবে বিভিন্ন ধরনের শিল্পমালিক; যেমন- গার্মেন্টস সামগ্রী প্রস্তুতকারক, বজ্রমালিক, প্লাস্টিক সামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রভৃতি বিশেষ ধরনের শিল্প মালিকগণ তাদের জন্য শিল্প ও বণিক সমিতি গড়ে তুলেছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশে জেলা পর্যায়ের শিল্প ও বণিক সমিতি । সারাদেশের শিল্প ও বণিক সমিতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (FBCCI) শিল্প ও বণিক সমিতি যেভাবে শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নয়নে সহায়তা করে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১৯৭৭ সালে মাত্র ১৯ জন তৈরি পোষাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক মিলিত হয়ে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ সুরক্ষার জন্য যে সমিতি গড়ে তোলে তাই আজকের দিনের বৃহদায়তন ও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএ । ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর তারিখে এই সমিতির নিয়মিত সদস্য ছিল ৩১৯৬ জন। ২০১১ এর জুন শেষে গার্মেন্টস শিল্পের সংখ্যা ছিল ৫,১৫০টি। ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে এই খাত দেশের মোট রপ্তানি আরে ৪০.৮% অর্জন করে যার আর্থিক মূল্য ছিল ১,১০৪ কোটি ডলার । BGMEA এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো-
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের পাশাপাশি নীটওয়্যার শিল্পও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নীটওয়্যার শিল্পের জন্য বাংলাদেশ নীটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (BKMEA) BGMEA এর পাশপাশি কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে নীটওয়্যার খাতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১,২৪২.৭ কোটি ডলার যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ছিল ৪১.৫%।
রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করে দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদকে শক্তিশালী করার জন্য বাংলাদেশে সরকারি মালিকানায় যে আধা-স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তাই রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (EPB) নামে পরিচিতি। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে Trade Promotion and Commercial Intelligence নামে যে বিভাগ ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো নাম ধারণ করে। ১৯৭৭ সালে একে আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনর্গঠিত করা হয় । ব্যুরো দেশের রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে শুরু থেকেই নানান কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে । এর প্রধান কার্যসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো;
সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের শক্তিমত্তার পরিচয় দেয়া এবং নিজেদের সামষ্টিক কল্যাণকে অর্থবহ করে তোলার প্রয়াস ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে প্রাচীন কাল থেকেই লক্ষণীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যাটো ও ওয়ারশ্- দু'টি সামরিক জোটে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ভাগ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিন দশক না যেতেই এই লড়াইয়ে ভাটা পড়ে । সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইকে পাশে রেখে বাণিজ্যিক শ্রেষ্ঠত্বের ও স্বার্থের লড়াই প্রবল হয়ে দেখা দেয় । গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন ব্যবসায় জোট। ব্যবসায়কে উৎসাহিত করার জন্য গড়ে ওঠে চুক্তিনির্ভর বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। নিম্নে এরূপ কিছু আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ।
সার্কভুক্ত দেশসমূহ নিজের মধ্যে বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে যে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তাকেই দক্ষিণ এশীয় অগ্রাধিকারভিত্তিক বাণিজ্য চুক্তি সংক্ষেপে SAPTA বলে। শুরুতে সার্ক SAARC ভুক্ত দেশসমূহ ছিল বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তান। ২০০৭ সালে আফগানিস্তান এই সংস্থায় যোগ দেয়ায় এখন এর সদস্য সংখ্যা ৮। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় ১ম সার্ক সম্মেলনের পর থেকে দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে । ১৯৯৫ সালের মে মাসে। ভারতের নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত সার্কের অষ্টম সম্মেলনে SAPTA চুক্তি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং ১৯৯৫ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়।
সহযোগিতাকে আরও অর্থবহ করার লক্ষ্যে ২০০৪ সালে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য এলাকা South Asian Free Trade Area (SAFTA) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সেনসিটিভ লিস্ট, রুলস অব অরিজিন, কারিগরি সহায়তার ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং শুল্ক হ্রাসের ফলে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের রাজস্ব ক্ষতিপূরণের চূড়ান্তকরণসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনার পর সকল দেশের অনুসমর্থনের মাধ্যমে তা ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি হতে কার্যকর হয়েছে।
SAFTA চুক্তির দুটি প্রধান বিষয়ের একটি হলো সেনসিটিভ লিস্টের পণ্যের সংখ্যা কমানো এবং সেনসিটিভ লিস্টের বাইরের পণ্যের ক্ষেত্রে ট্যারিফের হার ০%-৫% এর মধ্যে নামিয়ে আনা। ভারত ৯ নভেম্বর ২০১১ থেকে তাদের সেনসিটিভ তালিকার পণ্যের সংখ্যা ৪৮০ থেকে কমিয়ে ২৫ করেছে। পাকিস্তান সেনসিটিভ তালিকা বহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রে ৫% শুল্কহার নির্ধারণ করেছে । প্রতিটা দেশ তাদের সেনসিটিভ তালিকায় ঘোষিত পণ্যের সংখ্যা ২০% হ্রাস করেছে। ভারত দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক বা MOU (Memorandum of Understanding) এর অধীনে বাংলাদেশকে পোশাক পণ্যে শুল্ক মুক্ত এবং কোটামুক্ত সুবিধা দিয়েছে। যা নিঃসন্দেহে SAFTA-এর একটা অগ্রগতি। উল্লেখ্য ২০০৭ সালের ১৪তম সার্ক সামিটে আফগানিস্তান সাফটা চুক্তিতে নতুন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে সাফটার আওতায় বাংলাদেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৮৪.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ।
আঞ্চলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ও অবাধ বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৬৭ সালের ৮ আগস্ট দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের সম্মিলিত প্রয়াসে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় রাষ্ট্রসমূহের সংস্থা সংক্ষেপে আসিয়ান ( Association of South East Asian Nations / ASEAN) গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি রাষ্ট্র; যথা- ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রীগণ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আসিয়ান গঠনের ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। এটি ব্যাংকক ঘোষণা নামে পরিচিত। পরবর্তীতে ব্যাংকক ঘোষণার ভিত্তিতে ১৯৭৬ সালের • ২৪শে ফেব্রুয়ারি আসিয়ান গঠন সংক্রান্ত চূড়ান্ত দলিল তৈরি করে পাঁচটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ ইন্দোনেশিয়ার বালিতে উক্ত দলিলে স্বাক্ষর করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে ষষ্ঠ সদস্য হিসেবে ব্রুনাই, ১৯৯৫ সালে সপ্তম সদস্য হিসেবে ভিয়েতনাম, ১৯৯৭ সালে অষ্টম ও নবম সদস্য হিসেবে মায়ানমার ও লাওস এবং পরে দশম সদস্য হিসেবে কম্বোডিয়া এতে যোগদান করে। মার্চ ২০১১তে পূর্ব তিমুর নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দেয়ায় এখন এর সদস্য সংখ্যা ১১।
সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠানটি সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সমন্বয়ে অবাধ বাণিজ্য এলাকা স্থাপনের প্রয়াস চালায় এবং ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহ ASEAN Free Trad Area (AFTA) গঠন করে। এটি এখন বিশ্বের ৮নং বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল । ২০১৫ সালের মধ্যে উক্ত সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে ASEAN Economic Community / ABC গঠনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তারা আশা করছে যে, এতে তাদের আন্তঃবাণিজ্য ব্যাপকভাবে বাড়বে। এক দেশ থেকে বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ও কারিগরি সুবিধা অন্যদেশে হস্তান্তরিত হবে। শুল্ক বাধা উঠে যাওয়ার কারণে এখানের সব দেশই উপকৃত হতে পারবে। ASEAN এর একটা বড় দিক হলো সংস্থাটি অন্য দেশ ও বিভিন্ন সংস্থার সাথে চুক্তি সম্পাদন করে- যা সদস্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। ASEAN ও চীনের চুক্তি, জাপানের সাথে চুক্তি, EU-এর সাথে চুক্তি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এতে সংস্থাটির সামর্থ্যেরই প্রমাণ মেলে ।
১৯৯৭ সালের ৬ জুন ব্যাংককে একটা উপআঞ্চলিক জোট হিসেবে সংস্থাটি আত্মপ্রকাশ করে। প্রথমে ৪টি দেশ এতে যোগ দেয় এবং দেশগুলোর নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী এর নাম দেয়া হয় BIST EC (Bangladesh, India, Srilanka and Thailand Economic Cooperation)। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর ব্যাংককে অনুষ্ঠিত সংস্থার দেশগুলোর মন্ত্রীদের একটা বিশেষ সভায় মায়ানমারকে পঞ্চম দেশ হিসেবে সংস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এর নামকরণ করা হয় BIMSTEC । পরবর্তী সময়ে ২০০৪ সালে নেপাল ও ভুটানকে এই সংস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এর নামের নতুন পূর্ণাঙ্গ রূপ নির্ধারিত হয় Bay of Bengal Initiative for Multi Sectoral, Technical and Economic Cooperation ।
বিমসটেক দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার ১০টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করে প্রতিটা ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দানের ভার একেকটা দেশের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। সকল দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দানকারী দেশ কী ভূমিকা রেখেছে তা পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে । ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯ নভেম্বর ১৯৯৮
এর মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সহযোগিতার ৬টি খাত চিহ্নিত করে দায়িত্ব ভাগ করা হয়:
২০০৫ সালের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাকার মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সহযোগিতার আরও নতুন ৭টি খাত চিহ্নিত করে তার নেতৃত্বদানের ভার পূর্বের ন্যায় বিভিন্ন দেশের ওপর অর্পণ করা হয়। সহযোগিতার ক্ষেত্রসমূহ হলো-
এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) ২০০৫ সাল থেকে বিমসটেকের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে কাজ করছে। ইতোমধ্যেই ADB দেশগুলোর মধ্যে পরিবহণ, অবকাঠামো ও কৌশলগত সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে BTILS (BIMSTEC Transport Infrastructure & Logistic Study) প্রজেক্টের আওতায় সমীক্ষার কাজ শেষ করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নিকট পাঠিয়েছে। যা কার্যকর হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উপকৃত হবে । এ ছাড়াও বিমসটেকভুক্ত দেশসমূহ নিজেদের মধ্যে একটা মুক্ত বাণিজ্য এলাকা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
দীর্ঘ আলোচনা, চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও উন্নয়নের ধারার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাণিজ্যকে সকলের জন্য কল্যাণকর করতে যেই প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছে তার নাম বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা WTO I দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার উত্তরণ এবং বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থাকে সুসংহত করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি কিউবার রাজধানী হাভানায় ২৩টি দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মেলনে General Agreement on Tariff's & Trade / GATT প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারই নবতর সংস্করণ WTO । ১৯৯৪ সালে মরক্কোর রাজধানী মারাকাশে GATT এর যে সম্মেলন হয় তাতে ১২৮টি দেশ GATT চুক্তি অনুমোদন করে এবং সেখানেই WTO এর মতো সংগঠন গড়ে তোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় । যার আলোকে ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে WTO কাজ শুরু করে । এর প্রধান অফিস বা সচিবালয় সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায় ।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কার্যাবলি নিম্নরূপ :
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা অর্থনৈতিক পরাশক্তিসমূহের সক্রিয় অংশগ্রহণে শুরু থেকেই একটা শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, ইউএনডিপি, আইটিসি, আংকটাডসহ বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ব বাণিজ্য উদারীকরণ এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে। স্বল্পোন্নত দেশসমূহ (Least Developed Countries / LDC) WTO এর ফ্রেমের আওতায় থেকেই ধনিক দেশগুলোর সাথে দরকষাকষির মাধ্যমে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের জন্য সম্মিলিত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে । যার ফলশ্রুতিতে দেশগুলোর মধ্যে যেমনি সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটছে, একে অপরের সমস্যাগুলো বুঝতে পারছে তেমনি সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়ে তা দূরীকরণে সম্মিলিত প্রয়াস নিতে পারছে ।
বাংলাদেশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত ডব্লিউটিও সেল WTO সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে । এ সেল স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সমন্বিত করে WTO এর সম্মেলনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় তা দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের
পণ্যের শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা পাওয়ার জন্য এই সেল নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যার ফলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই এই সুবিধা লাভ করেছে । অন্যান্য দেশেও অনেকাংশে এ সুবিধা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন WTO এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন ও কার্যক্রমের সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পর্কযুক্ত ।
ইউরোপীয়ান কমিউনিটি (EC) ১৯৯২ সালে তাদের মধ্যকার অর্থনেতিক বন্ধনকে মজবুত করে নিজেদেরকে একটা অর্থনেতিক পরাশক্তি হিসেবে গড়ার অভিপ্রায়ে ইউরোপীয়ান ইকোনোমিক কমিউনিটি (EEC) গঠন করে । অনেকে এই নতুন বন্ধন কর্মসূচিকে নতুন ইউরোপ ও সন্দেহের বিষয় হিসেবে গণ্য করেন। বিশেষত বাইরের জগতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকেই নতুন জোটের অভ্যুদয়কে নিজেদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখতে শুরু করে । এরূপ জোট গঠনের ফলে দ্রুত যে সকল সুবিধা অর্জিত হয় তা হলো-
১৯৯২ সালে EC ভুক্ত ১২টি দেশ সমন্বয়ে EEC গড়ে ওঠে। দেশগুলো ছিল ১. বেলজিয়াম ২. ডেনমার্ক ৩, ফ্রান্স ৪. জার্মানী ৫. গ্রীস ৬. আয়ারল্যান্ড ৭. ইতালি ৮. লুক্সেমাবর্গ ৯. নেদারল্যান্ড ১০. পর্তুগাল ১১. স্পেন ও ১২. যুক্তরাজ্য । ১৯৯৫ সালে EEC সম্প্রসারিত হয় এবং তখন আরও ৩টি দেশকে সদস্যপদ দেয়া হয় । নতুন সদস্য দেশগুলো হলোঃ ১. অস্ট্রিয়া ২. ফিনল্যান্ড ও ৩. সুইডেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে আরও ১০টা দেশকে EU (পরবর্তীতে গৃহীত নাম)এর পূর্ণ সদস্য হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। দেশগুলো হলো ১. সাইপ্রাস ২. গ্রীস ৩. এস্তোনিয়া ৪. হাঙ্গেরি ৫. লাটভিয়া ৬. লিথুনিয়া ৭. মাল্টা ৮. পোল্যান্ড ৯. স্লোভাকিয়া ও ১০. স্লোভেনিয়া । পরে আরও তিনটি দেশ; রুমানিয়া, চেক রিপাবলিক ও ক্রোয়োশিয়া যোগ দেয়। অর্থাৎ EU এর বর্তমান সদস্য দেশের সংখ্যা ২৮ । অবশ্য ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্য EU থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা কার্যকর হলে এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়াবে ২৭ ।
মহৎ যে কোনো সৃষ্টির পিছনে তাকালে দেখা যাবে সেখানে ব্যক্তি বা ব্যক্তি বিশেষের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে । উদ্যোগের সাথে উদ্যম ও সৃজনশীলতা জড়িত। কোনো সমাজে যদি মানুষ উদ্যোগী না হয়, উদ্যম হারায় তবে সেখানে সৃজনশীলতা উৎসাহিত হয় না । ফলে ঐ সমাজ পশ্চাৎপদ সমাজে পরিণত হয়।
তাই ভালো উদ্যোগ যেন সর্বত্র এগিয়ে যেতে পারে, মানুষ যেন উদ্যোগী হতে উৎসাহী হয় সে পরিবেশ সৃষ্টি করা রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। ব্যবসায় যে কোনো দেশে মানুষের রোজগারের প্রধান খাত, আয় কর্মসংস্থানের মুখ্য উপায় এবং উন্নয়নের অন্যতম অবলম্বন । তাই ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে উঠতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যক । আগামী দিনে যারা উদ্যোক্তা হয়ে গড়ে উঠবে সেই শিক্ষার্থীদের অবশ্যই ব্যবসায় উদ্যোগ বিষয়টি ভালো করে জানতে হবে । তাদের হৃদয়পটে যেন ভালো উদ্যোক্তা হওয়ার বাসনা জন্মে, উদ্যোক্তাদের যেন তারা . সম্মান করতে শেখে এজন্য প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে তাদের ধারণা দেয়া উচিত ।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে শিক্ষার্থীরা (শিখন ফল)
১. উদ্যোগের ধারণা ও ক্রমবিকাশ ব্যাখ্যা করতে পারবে
২. ব্যবসায় উদ্যোগের বৈশিষ্ট্য ও কার্যাবলি ব্যাখ্যা করতে পারবে
৩. সফল উদ্যোক্তার গুণাবলি বর্ণনা করতে পারবে
৪. আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তার গুণাবলি শনাক্ত করতে পারবে
৫. ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে উঠার অনুকূল পরিবেশ বিশ্লেষণ করতে পারবে
৬. আত্মকর্মসংস্থান ও উদ্যোগের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারবে
৭. আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যবসায় উদ্যোগের অবদান বিশ্লেষণ করতে পারবে
৮. বাংলাদেশে ব্যবসায় উদ্যোগ উন্নয়নে সমস্যা এবং তা দূরীকরণের উপায় ব্যাখ্যা করতে পারবে
৯. বাংলাদেশের সফল উদ্যোক্তাদের জীবনী পাঠের মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণে অনুপ্রাণিত হবে
১০. বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা বর্ণনা করতে পারবে
১১. বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে কিছু সুপারিশ করতে পারবে
জনাব রাতুল তার চাকরির পাশাপাশি নিজ বাড়িতে পুকুরে মাছ চাষ করার সিদ্ধান্ত নেন । কিন্তু বেশি সময় দেয়া সম্ভব নয় বলে তিনি এ ব্যবসায়টি তার ছোট ভাই সদ্য ডিগ্রী পাস করা পিতুলের কাছে হস্তান্তর করেন। জনাব রাতুল তার চাকুরিস্থলের পাশে নতুন করে একটি স্টেশনারি দোকান দেন। এতে তিনি সফল হন ।
বন্যায় এলাকার একটা বাঁধ ভেঙ্গে মানুষের চলাচলে কষ্ট হচ্ছে। সরকার কবে মেরামত করবে তা বলা যাচ্ছেনা । সামনে বৃষ্টি শুরু হলে মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। মি. আলম এলাকার হৃদয়বান মানুষ । তিনি এ সমস্যা নিয়ে গণ্যমান্য অনেকের সাথে কথা বললেন। ছাত্র, যুবক ও সাধারণ মানষের সাথে কথা বলে বাঁধটা নিজেরা সবাই মিলে মেরামত করা যায় কি না সে বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করলেন। এরই এক পর্যায়ে একদিন স্কুল মাঠে একটা সভা হলো। গণ্যমান্য অনেকেই কথা বললেন। ছাত্র ও যুবকদের পক্ষ থেকেও কেউ কেউ উৎসাহব্যঞ্জক বক্তব্য রাখলো । সিদ্ধান্ত হলো যারা পারবে টাকা দেবে এবং ছাত্র ও যুবকরা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে বাঁধ মেরামত করবে । একদিন সকালে নারী-পুরুষ শিশুসহ সবার উপস্থিতিতে কাজ শুরু হলো । সবার মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ। শুধু বাঁধ মেরামত হলো না গ্রামের মধ্যে রাস্তায় যেখানে যা সমস্যা ছিল তাও সংস্কার হয়ে গেলো । এক্ষেত্রে মি. আলমের কর্মপ্রচেষ্টা উদ্যোগের একটা উদাহরণ।
কোনো নতুন চিন্তা মাথায় রেখে যখন কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ তা বাস্তবায়নের প্রয়াস নেন তাকে উদ্যোগ বলে । উদ্যোগের সাথে নতুন চিন্তা, নতুন কিছু করার বিষয় জড়িত । যা প্রয়োজন অথচ নেই, যা নতুন করে শুরু করলে তা ব্যক্তি বা পরিবারের জন্য, দেশ ও দশের জন্য, ব্যবসায়ের জন্য বা এমন কোনো ক্ষেত্রের জন্য মঙ্গলকর হবে- এমন কিছু করার চেষ্টা-প্রচেষ্টা উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত । উদ্যোগের সাথে ইতিবাচক কিছু করার সম্পর্ক বিদ্যমান । চৌধুরী বাড়ির লোকেরা গ্রামে স্কুল করেছে তাই তালুকদার বাড়ির লোকেরা প্রয়োজন ছাড়াই গ্রামে আরেকটি স্কুল করার প্রয়াস নিয়েছে- এটা উদ্যোগ নয় বরং উদ্যোগকে বাধা দেয়ার অপচেষ্টা মাত্র। তুমি যে কলেজে পড়ছো, খোঁজ নিয়ে দেখো এটার পিছনে কারও না কারও বা অনেকের উদ্যোগ কাজ করেছে । আজ যে বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান দেখছো, মসজিদ, মন্দির, হাসপাতাল, ক্লাব ইত্যাদি দেখছো- তার প্রতিষ্ঠার পিছনেও কারও চিন্তা-ভাবনা, শ্রম ও মেধা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে নিঃসন্দেহে। তাই উদ্যোক্তার ধারণা ব্যাপক বিস্তৃত। তবে Entrepreneurship ইংরেজি শব্দটি ব্যবসায় উদ্যোগ বা শিল্পোদ্যোগ বুঝাতেই এখন কার্যত ব্যবহৃত হয়।
উদ্যোগের সাথে চিন্তার সফল বাস্তবায়নও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। উদ্যোগ যখন ব্যর্থ হয় তখন সাধারণভাবে ঐ উদ্যোগ আর মূল্যায়িত হয় না। তবে অনেক সময় উদ্যোগ সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও পরবর্তীতে নতুন উপায় বা পদ্ধতির অনুসরণে উদ্যোগ সফল বলে পরিগণিত হয়। সেক্ষেত্রে নতুন ও পুরানো সকল প্রচেষ্টায় উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে । মি. আলী গ্রামে একটা কলেজ করার উদ্যোগ নিয়ে জমি দান করলেন, টাকা-পয়সা জোগাড় করে বিল্ডিং তৈরি করলেন। কিন্তু শিক্ষার্থী না পাওয়ায় তা বন্ধ হয়ে গেলো। ঐ গ্রামের বাসিন্দা সদ্য অবসরপ্রাপ্ত একটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মি. ভৌমিক চাইলেন মি. আলীর তৈরি স্থাপনায় স্কুল শুরু করবেন । মি. ভৌমিক এলাকার কিছু উদ্যমী যুবক ও তার পুরনো ছাত্রছাত্রীদের সাথে নিয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে লেগে পড়লেন । বাড়ি বাড়ি যেয়ে ছাত্রছাত্রী যোগাড় করলেন। এক বছর পরই স্কুলের শিক্ষার্থী বেড়ে গেলো । পাঁচ বছরের মাথায় স্কুলটি উপজেলা পর্যায়ে সুনাম কুড়িয়েছে। আর পাঁচ বছর যেতে না যেতেই স্কুলে একাদশ ও বাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু করা যাবে। এক্ষেত্রে মি. আলী ও মি. ভৌমিকের উদ্যোগকে একত্রেই বিবেচনা করতে হবে।
মানুষ বুদ্ধিদীপ্ত জীব । সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ নানান বৈরি পরিবেশ মোকাবেলা করে পথ চলেছে। নিজস্ব বাস্তবতায় সর্বোচ্চ সুবিধাকে কাজে লাগানোর জন্য মানুষ গ্রহণ করেছে বিভিন্ন প্রয়াস-প্রচেষ্টার। সফলতা- বিফলতার ধারায় সফলতা অর্জন করেই এগিয়ে গেছে মানুষ। নিত্য-নতুন সৃষ্টি আর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে জীবনকে করেছে সুষমামণ্ডিত । তাই উদ্যোগ মানব জীবনের শুরু থেকেই বর্তমান ছিল- এটা বলার অপেক্ষা রাখে না । তবে ব্যবসায় উদ্যোগের শুরু হয়েছে বেশ পরে। ব্যবসায় উদ্যোগ ধারণার ক্রমবিকাশ নিম্নে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
১. প্রাচীন যুগ (Ancient period) : মানুষ সংঘবদ্ধ হওয়ার পর নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তির ও একত্রে প্রয়োজন পূরণের জন্য চাষবাস, পশুপালন, পশুশিকার, মাছশিকার-এভাবে নানান উপজীবিকা গ্রহণ করে । নিজেদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন অন্যের সাথে বিনিময়ের ব্যবস্থা করে প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা চালায় মানুষ। ধীরে ধীরে কামার, কুমার, তাঁতী-এভাবে নানান সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এ সকল কাজ যে মানুষের নতুন চিন্তা ও উদ্যোগের একেকটা ফসল তা বলার অপেক্ষা রাখে না । সমাজ আরও সংহত হলে ধাতব মুদ্রার প্রচলন ঘটে । এতে মুদ্রা দিয়ে কেনা- বেচা শুরু হওয়ায় মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য দৃশ্যমান হয় । একক মালিকানার ভিত্তিতে নানান ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে । নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হওয়ায় উৎপাদন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটে । ব্যবসায় বড় হওয়ায় যৌথ সামর্থ্যের সম্মিলনে অংশীদারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই নতুন নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ প্রাচীন যুগেই বিস্তৃতি লাভ করে । তবে ব্যবসায় উদ্যোগ একটা আলাদা বিষয় হতে পারে তা মানুষের চিন্তায় তখনও স্থিতিলাভ করেনি।
২. মধ্য যুগ (Middle age): যিশু খ্রিস্টের মৃত্যুর পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক ধারাতেই বিকাশ লাভ করে। বণিক শ্রেণি পালতোলা নৌকায় বা উটের পিঠে পসরা সাজিয়ে একস্থান থেকে অন্যত্র মালামাল বেচা-কেনা করলেও ব্যবসায় উদ্যোগ ধারণা আলোচনার বিষয়বস্তু হয়নি। একাদশ ও দ্বাদশ শতকে ইতালিতে ব্যবসা-বাণিজ্য নতুনভাবে বিকশিত হলে উৎপাদনের পদ্ধতিগত উন্নয়নের পাশাপাশি বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসায় বিকাশ লাভ করে। ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। হিসাব সংরক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটে। সপ্তদশ শতকে এসে ইউরোপের আরও কিছু দেশ ব্যবসায়ে উন্নতি লাভ করলে বৈদেশিক ব্যবসায়ে ত প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। ফলে ব্যবসায় বা শিল্প-বাণিজ্য অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এর সুবাদে ব্যবসায় উদ্যোগ ধারণা মানুষের মনে স্থান নিলেও তা আলোচনার বিষয়বস্তু হয়নি ।
৩. আধুনিক যুগ (Modern stage): আধুনিক যুগ বলতে অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লব শুরুর পর থেকে সমসাময়িক কালকে বুঝায় । যান্ত্রিক শক্তির উন্মেষ এ সময়ে শিল্প বিপ্লবে মুখ্য ভুমিকা রাখে । এই যান্ত্রিক শক্তির উদ্ভব ছিল সেই সময়ের এক অপরিহার্য দাবি। কারণ কায়িক শ্রম এবং পশুশক্তি নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যবসায় উন্নয়নের তৎকালীন গতিধারার সাথে সংগতি বিধানে সক্ষম ছিল না। বাজারে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির তুলনায় উৎপাদন বৃদ্ধি না পাওয়ায় এই চাহিদা পুরণে অনেকেই নতুন নতুন ব্যবসায় গড়ে তা পূরণের চেষ্টা চালায় । ফলে ব্যবসায় উদ্যোগ বা নতুন ব্যবসায় গড়ার ভাবনা সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এ প্রেক্ষিতেই 'ব্যবসায় উদ্যোগ' বা 'শিল্পোদ্যোগ' ধারণা আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় । এই পর্যায়ে উক্ত বিষয়ে ধারণার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
উদ্যোগ ধারণার ক্রমবিকাশের আলোচনা শেষে সংক্ষেপে বলা যায়, সমাজ উন্নয়নের সাথে উদ্যোগ ধারণা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। তবে ব্যবসায় উন্নয়নের ধারা যত দ্রুততর হয়েছে উদ্যোগ বা শিল্পোদ্যোগ ধারণার উন্নয়নও ততই সামনে এসেছে। এখন উদ্যোগ ধারণা নতুন কিছু সৃষ্টির সাথে জড়িত যেখানে উদ্যোক্তা অনিশ্চয়তা মেনে নিয়ে নতুন পণ্য, ধারণা ও বাজার সামনে রেখে সফলতা লাভে অগ্রসর হন।
কৃষক পরিবারের সন্তান শহীদুল। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে পরিবারের অভাব-অনটন। জমি যা আছে বংশ তাতে ফসল হলে কষ্ট হওয়ার কথা নয় কিন্তু বন্যা, খরা, ফসলের দাম নেই নানান সমস্যা লেগেই থাকে। তার জ ক্লাসমেটের বাবাকে সে ছয় বছর আগে থেকেই দেখছে। জমি-জায়গা তেমন নেই। গ্রামের বাজারে ছোট দোকান। দিব্যি সংসার চলছে। এসএসসি পাস করে সে ব্যবসায় করবে ভাবলো। সবাই দোকানদারি করে। তার ভিন্ন কিছু করার চিন্তা। এলাকায় বিদ্যুৎ এসেছে। কাঠ বাদ দিয়ে মানুষ স্টীলের দরজা-জানালা, আলমারি ইত্যাদির দিকে ঝুঁকছে। সে শহরে যেয়ে ছয় মাস ওয়েল্ডিং এর কাজ শিখলো । কিছু টাকা জোগাড় করে গ্রামের বাজারে ছোট্ট একটা ঘর নিয়ে 'শহিদুল ওয়েল্ডিং' নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললো । পরিশ্রম আর ঐকান্তিকতায় সে এখন উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত । শহরে একটা কারখানা করার কথা ভাবছে সে ।
যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ব্যবসায় বিষয়ে নতুন চিন্তা মাথায় নিয়ে তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হন তাকে ব্যবসায় উদ্যোক্তা বলে। ব্যবসায় উদ্যোক্তা বা শিল্পোদ্যোক্তার ধারণা অনেকটা ব্যাপক। সুরুজ মিয়া বাজারে চালের দোকান দিয়েছে । সে উদ্যোক্তা কি না এটা চিন্তার বিষয় । কারণ বাজারে অনেকেই চলে বিক্রয় করছে। সেও চালের দোকান দিল, এতে নতুনত্ব নেই । এখন যদি এমন হয়, সে নওগাঁর চালের মোকাম থেকে ট্রাকে চাল এনে বাজারের দোকানদারদের কাছে বিক্রয় শুরু করলো; যা এর আগে ঐ বাজারে কেউ করেনি । তাহলে এখানে সৃজনশীল চিন্তা, অধিক ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা ইত্যাদি কাজ করেছে। এখন তাকে ব্যবসায় উদ্যোক্তা বলতে সমস্যা নেই । মিলন শেখের বাজারে চাল ও আটার মিল রয়েছে। সে ভাবলো যদি চিড়া তৈরির কল বসানো যায় তবে তা ভালো চলতে পারে। এই নতুন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া যুক্ত করায় সেও উদ্যোক্তা। মিতু প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকায় এমব্রয়ডারি কারখানা গড়ে তুললো, হাফিজ মৌ-চাষ করে মধু সংগ্রহ ও তার ব্যবসায় শুরু করলো এক্ষেত্রে মিতু ও হাফিজ ব্যবসায় উদ্যোক্তার উদাহরণ। মপিটার উদ্যোক্তা সাধারণ ব্যবসায়ী নন, পেশাদার ব্যবস্থাপকও নন বরং তার চেয়ে বেশি কিছু। তাঁরা সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করে ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যেতে আনন্দবোধ করেন। অন্যের অধীনে চাকরি না করে অধিক মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারলেই খুশী হন। ছোট দিয়ে শুরু করেন বটে কিন্তু তার চিন্তা ছোট পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তিনি নতুন নতুন ব্যবসায় বা শিল্প গড়ে তুলতে পারলেই তৃপ্ত হন। তাঁর চিন্তায় মননে, স্বপ্ন ও শয়নে সাফল্য অর্জনের চিন্তা তাড়া করে ফেরে। এমন উদ্যোক্তা শ্রেণি যে কোনো দেশের জন্যই নিঃসন্দেহে বড় সম্পদ ।
ভারতের টাটা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা জামশেদ টাটা, KFC এর প্রতিষ্ঠাতা Harland Sanders, Walmart এর প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ওয়াল্টন বিশ্বসেরা উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে জহুরুল ইসলাম, আকিজ মিয়া, স্যামসন এইচ চৌধুরীর মতো উদ্যোক্তাগণ আমাদের গর্বের ধন। তাঁদের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে তারাও একদিন ছোট উদ্যোক্তা হিসেবেই ব্যবসায় শুরু করেছিলেন ।
উদ্যোগ একটা সাধারণ পরিভাষা। নতুন কোনো বিষয়ে যিনিই কোনো প্রয়াস নিয়ে সামনে এগিয়ে যান তাকেই উদ্যোক্তা হিসেবে দেখা হয়। একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা, স্কুলে কলেজ শিফট চালু, এলাকায় স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন, গ্রামের বাজারে মোবাইল ব্যাংকিং এর চেইন পয়েন্ট চালু, মহল্লায় বিউটি পার্লারের দোকান খোলা-এর সবই উদ্যোগের উদাহরণ। দু'পক্ষের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ, রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ এগুলোও উদ্যোগেরই আওতাভুক্ত। অন্যদিকে উদ্যোগের যেই অংশ ব্যবসায়ের সাথে জড়িত তাকে ব্যবসায় উদ্যোগ বলে । নতুন ব্যবসায় গঠন বা নতুন পণ্য, সেবা, পদ্ধতি বা বাজার সামনে রেখে একজন ব্যবসায়ীর উদ্যোগকে ব্যবসায় উদ্যোগ বলা হয়ে থাকে। উদ্যোগের বিষয়বস্তু অনেক ব্যাপক । অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক যে কোনো বিষয়েই উদ্যোগ গৃহীত হতে পারে। কিন্তু ব্যবসায় উদ্যোগের বিষয়বস্তু নতুন ব্যবসায় শুরুর সাথে সম্পর্কিত। এটি সম্পূর্ণ নতুন ব্যবসায় হতে পারে, নতুন পণ্য বা সেবা ব্যবসায়ে সংযুক্ত করার প্রয়াস হতে পারে, নতুন প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি চালু করা হতে পারে, নতুন বাজারে প্রবেশ প্রচেষ্টা হতে পারে- এর সবকিছুর সাথেই যেহেতু নতুন চিন্তা যুক্ত তাই এগুলো ব্যবসায় উদ্যোগের অন্তর্ভুক্ত । উদ্যোগের উদ্দেশ্য মূলত জনকল্যাণ কিন্তু ব্যবসায় উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জন । অধিকাংশ উদ্যোগের ক্ষেত্রে সাধারণত আর্থিক ঝুঁকির সম্ভাবনা তেমন থাকে না কিন্তু ব্যবসায় উদ্যোগের ক্ষেত্রে আর্থিক ঝুঁকির সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে ।
নতুন কোনো ধারণা বা চিন্তা নিয়ে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যখন কোনো ব্যবসায় শুরুর প্রয়াস চালায় তাকে ব্যবসায় উদ্যোগ বলে। ব্যবসায় অন্যান্য উপজীবিকা থেকে ভিন্নতর। এর উদ্দেশ্যও অন্যান্য কাজ থেকে আলাদা। তাই ব্যবসায় উদ্যোগ অন্যান্য উদ্যোগ থেকে প্রকৃতিগতভাবেই ভিন্ন প্রকৃতির । নিম্নে এর প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো :
১. মুনাফা অর্জন সংশ্লিষ্ট (Relatedness with profit) : উদ্যোগ যে কোনো কল্যাণকর ও ইতিবাচক দিকের সাথে সম্পর্কযুক্ত হলেও ব্যবসায় উদ্যোগ বিশেষভাবে মুনাফা অর্জন সংশ্লিষ্ট। এরূপ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন ও সাফল্য লাভের প্রয়াস চালায়।
২. ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার আধিক্য (Excessiveness of risk and uncertainty) : গতানুগতিক ব্যবসায়ে ঝুঁকি স্বভাবতই কম থাকে । কারণ এক্ষেত্রে পূর্বেই ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা কমবেশি মূল্যায়ন করা যায় । কিন্তু নতুন চিন্তা ও ধারণা নিয়ে যখন কেউ ব্যবসায়ে নামে তখন তার সম্ভাবনা ও সমস্যাগুলোকে আগাম সেভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। সে কারণে দেখা যায় ব্যবসায় উদ্যোগ অনেক সময়ই বিফল হয়।
৩. নতুন ধারণার সাথে সম্পর্কযুক্ত (Relatedness with new idea) : নতুন ধরনের ব্যবসায়, নতুন পণ্য বা সেবা, নতুন প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি, নতুন বাজার ইত্যাদি বিষয়কে সামনে রেখে ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় । এই নতুনত্বের পিছনে উদ্যোক্তার সৃজনশীলতা কাজ করে। ব্যবসায় উদ্যোগ সে বিচারেই গতানুগতিক ব্যবসায় গঠনের চেয়ে ভিন্নতর ।
৪. কৃতিত্ব অর্জনে বিশেষ সম্মান লাভ (Gaining special honour for achievment) : মানুষ বিভিন্ন ভাবেই জীবনে সাফল্য বা উন্নতি লাভ করতে পারে। কিন্তু সর্বত্রই কৃতিত্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশেষ সম্মান লাভ ঘটে না । একটা এলাকায় নতুন এক ধরনের ব্যবসায় গড়ে তুলে কেউ যদি সাফল্য লাভ করে বা কোনো ব্যবসায়ীর নতুন উদ্যোগ সফল হয় তখন তার যোগ্যতার স্বীকৃতি মেলে ও তার বিশেষ সম্মান লাভ ঘটে । প্রয়াত রণদা প্রসাদ সাহা, মরহুম জহুরুল ইসলাম সেই কৃতিত্বের বলেই আমাদের মাঝে টিকে থাকবেন অনেকদিন ।
৫. সাফল্যের ইতিবাচক ফল যথেষ্ট (Sufficiency of positive result for success) : ব্যবসায় উদ্যোগ সফল হলে তা উদ্যোক্তার মধ্যে ব্যাপক অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের জন্ম দেয় । তদুপরি তার উদ্যোগ সর্বত্র প্রশংসিত হওয়ায় তা তাকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে । তার সাফল্য ধাপে ধাপে তাকে বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গঠনের দিকে নিয়ে যায়। তাকে দেখে অনেকেই নতুন উদ্যোগ নিতে অনুপ্রাণিত হয় । অর্থাৎ ব্যবসায় উদ্যোগের সফলতা ব্যক্তির সাথে দেশ ও দশের জন্যও ব্যাপক কল্যাণ বয়ে আনে ।
৬. উদ্যোগ গতানুগতিক ব্যবসায় কর্মকাণ্ড নয় (Entrepreneurship is not traditional business activities): ব্যবসায় উদ্যোগ গতানুগতিক ব্যবসায় গঠন থেকে ভিন্ন কিছু । বাবার ব্যবসায়ে পুত্র বসা শুরু করলো, অনেক চালের ব্যবসায়ীর মাঝে একজন চালের ব্যবসায় শুরু করলো- এগুলো ব্যবসায় উদ্যোগের মধ্যে পড়ে না। যখন কেউ নতুন পণ্য, সেবা, পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে বাজারে নামে তখন তাকে অনেক বেশি চিন্তা ও পরিশ্রম করতে হয় এবং ঝুঁকি নিতে হয়। সাফল্যার্জনে তার আগ্রহ ও চেষ্টা থাকে ভিন্নতর ।
ব্যবসায় উদ্যোগ হলো নতুন ধারণা ও চিন্তা নিয়ে ব্যবসায় গড়ে তোলার উদ্যোগ বা কর্মপ্রচেষ্টা। এর মূলে থাকে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে একটা সফল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গঠন ও পরিচালনা করা। যাতে উদ্যোক্তার আয়- রোজগারের পাশাপাশি তা তার ক্যারিয়ার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সমর্থ হয়। এরূপ চেষ্টা-প্রচেষ্টার মধ্যে যে সকল কাজ সম্পাদনের প্রয়োজন পড়ে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. উদ্যোগ চিন্তার উন্নয়ন (Development of entrepreneurship thinking) : ব্যবসায় উদ্যোগ সৃজনশীল চিন্তার সাথে সম্পর্কযুক্ত। অন্য ব্যবসায়ী কোন ব্যবসায়ে ভালো করছে, সে দিকটা দেখার চাইতে নিজে কোন ব্যবসায় গড়ে তুললে ভালো করতে পারবে একজন উদ্যোক্তা সে দিকটা দেখতেই আগ্রহী থাকে । নতুন কী করলে ব্যবসায়ে দ্রুত সাফল্য লাভ সম্ভব হবে- সে বিষয় তার কাছে প্রাধান্য পায়। এভাবেই সে নানান চিন্তাকে বিচার-বিবেচনা করে উদ্যোগ চিন্তার উন্নয়ন ঘটায়।
২. সম্ভাব্যতা যাচাই ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ (Testing feasibility and taking decision) : উদ্যোগ চিন্তা কতটা কার্যকর হবে এটা দেখার জন্য একজন উদ্যোক্তাকে নানান সুবিধা-অসুবিধা চিন্তা করতে হয় । চিন্তাকে একটা প্রকল্প বিবেচনা করে এতে সম্ভাব্য বিনিয়োগ, খরচ, আয় ও মুনাফা কী হতে পারে তা বিশ্লেষণ করা হয়। লাভজনকতা বিচারে নতুন প্রকল্প চিন্তা গ্রহণযোগ্য হলে তা বাস্তবায়নে উদ্যোক্তা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ।
৩. অর্থসংস্থান (Financing) : যে কোনো নতুন ব্যবসায় উদ্যোগে অর্থসংস্থানের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । একজন উদ্যোক্তা তার নতুন চিন্তার বিষয়ে খুবই উৎসাহী ও আশাবাদী থাকেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার অর্থসংস্থানের সামর্থ্য সীমাবদ্ধ থাকে। এজন্য ব্যবসায় উদ্যোগে কখন কী পরিমাণ অর্থ লাগবে, কোন কোন উৎস থেকে উক্ত অর্থ সংগ্রহ করা যাবে তা সতর্কতার সাথে বিবেচনা করে অর্থ সংগ্রহ, বিনিয়োগ, নগদ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কাজ করতে হয়।
৪. ঝুঁকি গ্রহণ (Taking risk) : ব্যবসায় উদ্যোগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ঝুঁকি গ্রহণ । ব্যবসায় উদ্যোগে যেহেতু নতুন পণ্য, সেবা, পদ্ধতি, বাজার ইত্যাদিকে সামনে নিয়ে আসা হয় ফলে তার কার্যকারিতা কতটা ফলদায়ক হবে এ নিয়ে স্বভাবতই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেশি থাকে। এজন্যই একজন উদ্যোক্তাকে অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে হয় । এই ঝুঁকিকে পিছনে রেখে সাফল্য অর্জনে তাই একজন উদ্যোক্তা অনেক বেশি প্রত্যয়ী ও কর্মতৎপর থাকেন।
৫. উপকরণাদি সংহতকরণ (Organizing resources) : ব্যবসায় উদ্যোগকে সফল করতে অর্থ ছাড়াও বিভিন্ন উপকরণ: যেমন- শ্রম, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ইত্যাদি জোগাড় এবং সেগুলো সঠিকভাবে সমন্বিত করার প্রয়োজন পড়ে । এক্ষেত্রে জনশক্তি সংগ্রহে উদ্যোক্তাকে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। এক্ষেত্রে একবার ভুল করলে উদ্যোগ এগিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানে উত্তম নিয়ম-পদ্ধতি গড়ে তোলা না গেলে পরবর্তীতে প্রতি পদে পদে সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়।
৬. বাজার সৃষ্টি (Creating market) : বাজার সৃষ্টি বলতে মূলত নির্দিষ্ট এলাকায় চাহিদা সৃষ্টির কাজকে বুঝায়। নতুন পণ্য বা সেবা বাজারজাত করতে চাইলে উক্ত পণ্য বা সেবাকে ক্রেতা সাধারণের নিকট জনপ্রিয়। করে তুলতে হয় । নতুন ব্যবসায় শুরু করলে সম্ভাব্য গ্রাহকদের ঐ ব্যবসায়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলার প্রয়োজন পড়ে। সম্ভাব্য গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা গড়ে তোলার জন্য উত্তম পণ্য ও সেবার পাশাপাশি উত্তম আচরণ, গ্রাহকদের সুবিধামতো মূল্য ও শর্ত নির্ধারণ, প্রচার ও যোগাযোগ রক্ষা ইত্যাদি নানান কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে । এভাবে একবার বাজার সৃষ্টি করা গেলে উদ্যোগ এগিয়ে নেয়া সহজতর হয় ।
৭. সাফল্য-ব্যর্থতা মূল্যায়ন (Evaluation of success & failure) : ব্যবসায় উদ্যোগে সাফল্য লাভ করতে হলে কাজ শুরুর পর প্রকল্পের প্রতিটা পর্যায়ে এর সাফল্য ও ব্যর্থতা মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে । সাফল্যে অভিভূত না হয়ে সাফল্যকে ধরে রেখে কিভাবে সামনের দিকে আরও এগিয়ে যাওয়া যায় একজন উদ্যোক্তাকে তা নিয়ে ভাবতে হয় । কোন কোন দিক থেকে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন পড়ে। অন্যদিকে যদি ব্যর্থতা লক্ষ করা যায় তবে সমস্যা মূল্যায়ন করে তা সমাধানে দ্রুত কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
৮. উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন (Execution of development program) : ব্যবসায় উদ্যোগে সফলতা ধরে রাখতে উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে যথেষ্ট সতর্ক ও আন্তরিক হওয়ায় প্রয়োজন পড়ে । মনে রাখতে হয় “সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের হাজার ফোঁড়' অর্থাৎ নতুন পণ্য, সেবা, পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে গ্রাহকদের মধ্যে যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে এটাকে যতদ্রুত সম্ভব মানুষের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন । এক্ষেত্রে কোনোরূপ আলস্য প্রতিযোগী সৃষ্টির পথ খুলে দিতে পারে । তাই উন্নয়ন কর্মসূচিকে একটা পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে নেয়া ছাড়া ভিন্ন কিছু ভাবার কোনো সুযোগ থাকে না ।
ঝুঁকিপূর্ণ ও অনুমাননির্ভর পথযাত্রায় যে উদ্যোক্তা তার নতুন ব্যবসায় চিন্তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়ে সাফল্য অর্জনে সক্ষম হন তাকেই সফল উদ্যোক্তা বলে। সফল উদ্যোক্তা নিঃসন্দেহে একজন সৃজনশীল উদ্ভাবক, উত্তম সংগঠক, যোগ্য পরিচালক ও সফল নেতা । তিনি সাধারণ ব্যবসায়ী বা ব্যবস্থাপক থেকে ভিন্নতর । বিভিন্ন গুণ বা বৈশিষ্ট্যের সমাহারে তিনি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। নিম্নে একজন সফল উদ্যোক্তার বিভিন্ন গুণ বা বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:
১. সৃজনশীল মানসিকতা বা সৃজনশক্তি (Creative mentality): নতুন কিছু চিন্তা করার এবং তা দিয়ে একটা ধারণাকে দাঁড় করাতে পারার মতো ব্যক্তির মানসিক সামর্থ্যকে সৃজনশীল মানসিকতা বা সৃজনশক্তি বলে। একজন উদ্যোক্তা অন্যেরটা সম্পূর্ণ অণুকরণ করেন না । হতে পারে তিনি অন্যের কাজ দেখে তাতে নতুন কিছু সংযোজন করতে পারেন । নতুন কোনো ব্যবসায় দাঁড় করাতে পারেন । নতুন পদ্ধতি, প্রক্রিয়া ইত্যাদি সংযোজন করতে পারেন। নতুন বাজার সৃষ্টি করতে পারেন-যার সবকিছুর জন্য সৃজনশীল মনসিকতা বা সৃজনশক্তি অপরিহার্য বিবেচিত হয় । অর্থাৎ একজন ভালো উদ্যোক্তা নতুন কিছু সৃষ্টি করার মতো সৃষ্টিশীল ও গঠনমূলক মনের অধিকারী হয়ে থাকেন ।
২. কৃতিত্বার্জন চাহিদা (Need of achievement): একজন ব্যক্তির মধ্যে কৃতকার্যে সাফল্য লাভের প্রবল আকাঙ্ক্ষাকে কৃতিত্বার্জন বা সাফল্যার্জন চাহিদা বলে। কোনো ব্যক্তি যদি তার কাজ থেকে সাফল্য প্রত্যাশা না করেন, দৌড় দিয়ে যদি প্রথম হওয়ার স্বপ্ন না দেখেন তবে ঐ কাজে তার সর্বোচ্চ নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও আত্মত্যাগ থাকে না । তাই একজন সফল উদ্যোক্তা সাফল্য অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও আশাবাদী মন নিয়ে পথ চলেন । তিনি তার উদ্যোগ প্রচেষ্টাকে নিজের জীবনে সাফল্য লাভের উপায় বা ক্যারিয়ার হিসেবে গণ্য করেন এবং সকল প্রচেষ্টায় তার এ স্পৃহার প্রতিফলন ঘটে ।
৩. দূরদৃষ্টি (Fore-sight): জ্ঞানচক্ষু বা বিশেষ জ্ঞান (প্রজ্ঞা) দ্বারা ভবিষ্যৎকে উপলব্ধি বা বুঝতে পারার সামর্থ্যকে দূরদৃষ্টি বলে । একজন ব্যক্তি তার নতুন চিন্তার সাফল্য সম্ভাবনা যদি বুঝতে না পারেন, সমস্যা কী হতে পারে যদি ভাবতে না পারেন তবে তার পক্ষে কখনই ভালো উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব নয়। কবীর হোসেন অন্যের সাফল্য দেখে কোনো ব্যবসায়ে নেমে পড়লো। কিন্তু ঐ ব্যবসায়ের ভবিষ্যত সম্ভাবনা কী, কী ধরনের বাধাগুলো আগামী দিনে ঐ ব্যবসায়কে মোকাবেলা করতে হবে- এগুলো যদি বোঝার মতো ভাবার মতো সামর্থ্য তার না থাকে তবে তার পক্ষে ব্যবসায় করা সম্ভব নয়; ব্যবসায় উদ্যোক্তা হওয়াতো দূরের কথা ।
৪. সাহস ও বুদ্ধিমত্তা (Bravity and intallectual): নির্ভিকভাবে পথ চলতে পারার গুণকেই সাহস বলে । অন্যদিকে, মানুষের বোধশক্তি ও বিচারশক্তিকে বুদ্ধিমত্তা বলা হয়ে থাকে। বোধশক্তিসম্পন্ন একজন মানুষ যদি করণীয় ঠিক করে সাহসীকতার সাথে তা অর্জনে পথ চলতে পারে তবে তার পক্ষে সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়। অন্যদিকে যদি দুই পা চলে আর এক পা পিছায়, সবসময় অজানা ভয় যদি কাউকে তাড়া করে ফেরে তবে তার পক্ষে ভালো উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব হয় না । ঝুঁকিপূর্ণ, অনুমাননির্ভর ও অচেনা পথে কার্যত জীবনকে বাজি রেখে একজন উদ্যোক্তা তার উদ্যোগ চিন্তাকে বাস্তবায়ন করেন। এ জন্য একজন উদ্যোক্তাকে যথেষ্ট সাহসী হতে হয় । তার এ সাহস অবশ্যই বুদ্ধিমত্তা দ্বারা সুষমামন্ডিত হয়ে থাকে ।
৫. ধৈর্য ও কষ্টসহিষ্ণু (Patience and hardworking): যে গুণের প্রভাবে একজন মানুষ বিরূপ পরিস্থিতিতে প্রতিকূলতা সহ্য করে নিজ লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে পারে তাকে ধৈর্য্য বলে। অন্যদিকে দুঃখ ক্লেশ, বেদনা ইত্যাদি সইতে পারার গুণকে কষ্টসহিষ্ণুতা বলা হয়ে থাকে। একজন উদ্যোক্তা নতুন ব্যবসায়, পণ্য, পদ্ধতি, বাজার ইত্যাদি নিয়ে যখন কাজ করে তখন প্রত্যাশিত অবস্থার বাইরে বিরূপ অবস্থা তাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে । হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সে অবস্থাতেও যদি ভেঙ্গে না পড়ে, অবিচল থেকে, ধৈর্য ধরে এবং দুঃখ ও বেদনাকে সহ্য করেও একজন উদ্যেক্তা করণীয় নির্ধারণপূর্বক এগিয়ে যেতে পারে তবে তার পক্ষে সাফল্যলাভ সম্ভব হয় । তাই ধৈর্য এবং সেই সাথে কষ্টসহিষ্ণুতা উদ্যোক্তার বড় গুণ । তাই সহজেই ধৈর্য হারান বা ভেঙ্গে পড়েন এমন মানুষ কখনই ভাল উদ্যোক্তা হতে পারে না ।
৬. ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা (Risk taking mentality): আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনাকে ঝুঁকি বলে । এই ক্ষতি মেনে নেয়ার মতো মনকেই উদ্যোক্তার ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা বলে। যে কোনো নতুন উদ্যোক্তার ঝুঁকির বা ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি থাকে । তাই সাফল্য আসবেই এবং কখনই ক্ষতি স্বীকার করতে হবে না এমন চিন্তা উদ্যোক্তাকে বাস্তবতার গুণ বর্জিত করে তোলে । তাই একজন উদ্যোক্তার ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা একটি বড় গুণ । চাকরিজীবী ও গতানুগতিক ব্যবসায়ীদের সাধারণত এ ধরনের মানসিকতা থাকে না। একজন উদ্যোক্তা তার সময়, শ্রম ও পুঁজিকে সমন্বিত করে এবং বিভিন্ন দায়ের বোঝা মাথায় নিয়ে উদ্যোগকে এগিয়ে নেন । এরূপ মানসিকতাই তাকে এক্ষেত্রে সাহস জোগায় ।
৭. সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য (Ability to take decision): বিভিন্ন বিকল্প করণীয় থেকে বাস্তবতার আলোকে উত্তম করণীয় নির্বাচন করতে পারার গুণকেই সিদ্ধান্তে গ্রহণের সামর্থ্য বলে। যথাসময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য একজন সফল উদ্যোক্তার বড় গুণ । কোনো উদ্যোগ গ্রহণ থেকে শুরু করে বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে হাজারো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। সম্ভাব্য সমস্যা, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদির যথাযথ মূল্যায়ন করেই এ সকল সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিলম্ব বা দুর্বলতা পুরো উদ্যোগকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
৮. নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা (Dutyfulness and Sincerity): কর্তব্য-কর্মে দৃঢ় অনুরাগ, আস্থা, বিশ্বাস, মনোযোগ ইত্যাদিকে নিষ্ঠা বলে । অন্যদিকে অকৃত্রিমতা, কপটতামুক্ততা, লোক দেখানো ভাব পরিহার করে কাজ করাকে আন্তরিকতা বলা হয়ে থাকে। একজন সফল উদ্যোক্তাকে অবশ্যই তার কাজে নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক হতে হয় । নিষ্ঠা তাকে নিজস্ব কাজে আস্থাবান, মনোযোগী ও দায়িত্বশীল করে তোলে। এটি তার আচরণে যে প্রভাব ফেলে তা অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণে যেমনি সমর্থ হয় তেমনি ক্যারিয়ার গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । অন্যদিকে নষ যখন দেখে কোনো ব্যক্তি তার কাজে প্রকৃতই নিষ্ঠাবান এবং কোনো ধরনের কপটতা বা কৃত্রিমতা তার মধ্যে নেই। তখন অন্যরা তাকে সহযোগিতা করতে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে থাকে ।
৯. যোগাযোগ দক্ষতা (Communication ability) : অন্যের বা অন্যদের নিকট সঠিক সময়ে সঠিক উপায় বা পদ্ধতিতে নিজের বক্তব্য বা প্রয়োজন কার্যকরভাবে তুলে ধরে উদ্দেশ্য অর্জনের সামর্থ্যকে যোগাযোগ দক্ষতা বলে । সফলতা অর্জনে একজন উদ্যোক্তাকে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন পক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে । এ কারণেই যোগাযোগ দক্ষতা একজন সফল উদ্যোক্তার অপরিহার্য গুণ বা বৈশিষ্ট্য। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের এ যুগে বিভিন্নমুখী যোগাযোগ দক্ষতা ছাড়া কারও পক্ষেই অন্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
১০. সামাজিক দায়িত্ববোধ (Social responsiveness) : সমাজের প্রতি করণীয় রয়েছে উদ্যোক্তার এই বোধ বা চিন্তাকে উদ্যোক্তার সামাজিক দায়িত্ববোধ বলে । একজন উদ্যোক্তাকে সফলতা লাভে সমাজের বিভিন্ন পক্ষের সাথে কাজ করতে হয়। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের প্রতি দায়িত্ব পালনের স্বাভাবিক অনুভূতি যদি তার মধ্যে না থাকে তবে তার পক্ষে সংশ্লিষ্টদের সহানুভূতি অর্জন সম্ভব হয় না। আর এরূপ সহানুভূতি ও সহযোগিতা ছাড়া একজন উদ্যোক্তা সফল হতে পারে না ।
১১. মূল্যবোধ ও নৈতিকতা (Values and ethics): কোনটা ভালো এবং কোনটা মন্দ এ সংক্রান্ত উদ্যোক্তার বোধকে মূল্যবোধ এবং ভালোকে গ্রহণ ও মন্দ এড়িয়ে চলাকে নৈতিকতা বলে । একজন উদ্যোক্তাকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার গুণসম্পন্ন হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। অন্যায় ও অসৎ চিন্তা ও আচরণ দিয়ে কারও পক্ষেই বেশিদূর এগুনো সম্ভব নয়-এ ভাবনা উদ্যোক্তার মধ্যে থাকার প্রয়োজন পড়ে ।
১২. সাংগঠনিক জ্ঞান ও দক্ষতা (Organizational knowledge and ability): মানবীয় ও বস্তুগত উপকরণাদিকে কার্যকরভাবে সংহত করে সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং যোগ্যতার সাথে তা পরিচালনা করার সামর্থ্যকেই সাংগঠনিক জ্ঞান ও দক্ষতা বলে। নতুন উদ্যোগ সফল করার জন্য একজন উদ্যোক্তাকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মানবীয় ও বস্তুগত উপকরণাদি সংগ্রহ ও সমন্বিত করতে হয়। এক্ষেত্রে বাস্তবায়ন পর্যায়ের কোনো ভুল নানান বিপত্তির সৃষ্টি করে । এজন্য একজন সফল উদ্যোক্তাকে অবশ্যই উপযুক্ত সাংগঠনিক জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী হতে হয় ।
একজন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যে সকল গুণ থাকা প্রয়োজন ব্যক্তির মধ্যে তা আছে কি না, থাকলে কোন মাত্রায় রয়েছে, ঘাটতি থাকলে তা কতটা পূরণ সম্ভব- এ সকল বিষয়ে ব্যক্তির নিজস্ব বিচার-বিশ্লেষণকে উদ্যোক্তার আত্মবিশ্লেষণ বলে।
ব্যবসায় ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। একজন নতুন মানুষ নতুন চিন্তা নিয়ে যখন ব্যবসায়ে নামে তখন তার ঝুঁকির মাত্রা স্বভাবতই বেশি হয় । তাই একজন উদ্যোক্তাকে আবেগপ্রবণ না হয়ে অত্যন্ত সচেতনভাবে তার নিজের অবস্থা মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। তাকে বুঝতে হয় এর সাফল্যের সকল কৃতিত্ব ও মুনাফার দাবি যেমনি তার তেমনি ব্যর্থতার সকল দায়ভারও তাকেই বহন করতে হবে। তাই উদ্যোক্তাসুলভ গুণ তার মধ্যে কোন মাত্রায় কতটা আছে, বা আছে কী নেই এবং ঘাটতি থাকলে তা কতটা পূরণ সম্ভব যথাযথ আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে তা চিহ্নিত করার প্রয়োজন পড়ে। এরূপ বিশ্লেষণের বিভিন্ন ধাপ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
ধাপ-১: কৃতিত্বার্জন চাহিদা নির্ণয় : একজন ব্যক্তির মধ্যে কৃতকর্মে সাফল্যলাভের আকঙ্ক্ষাকেই কৃতিত্বার্জন চাহিদা বলে । একজন ব্যক্তি কর্মক্ষেত্রে কতটা সাফল্যলাভের কথা ভাবেন না শুধুমাত্র সকলের সাথে নিজেকে জুড়ে রাখতে চান-এর বিচারে ব্যক্তির কৃতিত্বার্জন চাহিদার মাত্রা বিবেচনা করা যায়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বিশিষ্ট শিল্পমনোবিজ্ঞানী ডেভিড ম্যাকলিল্যান্ড এর মতে, 'কৃতিত্বার্জনের চাহিদা হলো ভালো কিছু করার আকাঙ্ক্ষা, স্বীয় কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে কৃতিত্বের আভ্যন্তরীণ অনুভূতি অর্জন।' একজন নতুন উদ্যোক্তা তার মধ্যে কৃতিত্বার্জনের চাহিদা কী পরিমাণে আছে তা বিশ্লেষণের জন্য নিজেই নিজের নিম্নোক্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো বিবেচনা করতে পারে :
উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তরগুলোতে যদি 'না' অপেক্ষা 'হ্যাঁ' বেশি হয়, তাহলে বুঝতে হবে ব্যক্তির মধ্যে উচ্চমাত্রার কৃতিত্বার্জনের চাহিদা বিদ্যমান। তাই উক্ত উদ্যোক্তার জন্য একজন ভাল উদ্যোক্তা হওয়া অসম্ভব নয় ।
ধাপ-২: প্রশ্নের উত্তরের আলোকে প্রতিবেদন তৈরি : প্রথম ধাপের প্রশ্নের উত্তরগুলোর আলোকে একটা তালিকা বা প্রতিবেদন প্রস্তুত করলে দেখা যাবে যে, তা থেকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মিলিয়ে একটা ধারণার সৃষ্টি হবে। প্রতিটা ইতিবাচক উত্তরকে ১ এবং নেতিবাচক উত্তরকে ০ ধরলে একটা মান বেরিয়ে আসবে। অতঃপর উদ্যোক্তার যে সকল গুণ; যেমন- প্রজ্ঞা, সাহস, ধৈর্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ইত্যাদি সাধারণভাবে থাকার প্রয়োজন বলে মনে করা হয় তার সাথে প্রতিবেদনের ধারণাকে মিলালে প্রতিটা ক্ষেত্রে ব্যক্তির শক্তি ও দুর্বলতা চিহ্নিত হবে । যা তাকে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করবে।
ধাপ-৩: প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তার সাথে মত বিনিময় এ পর্যায়ে স্থানীয় একজন সফল উদ্যোক্তার সাথে মতবিনিময় করা হলে পূর্বে তৈরিকৃত প্রতিবেদনে উল্লেখিত প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে আরো বাস্তবসম্মত ধারণা লাভ সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে মত বিনিময়ে ব্যক্তিকে নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে হয় :
ধাপ-৪: প্রশিক্ষকের সহায়তা গ্রহণ : এ পর্যায়ে একজন সম্ভাব্য উদ্যোক্তা আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে সফল উদ্যোক্তার ইতিবাচক যে সকল গুণ তার মধ্যে দেখতে পায় সেগুলোকে সার্বিকভাবে কাজে লাগানোর উপায় সম্পর্কে প্রশিক্ষক বা পরামর্শকের এ পর্যায়ে সহায়তা নিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষকের নিকট থেকেও গুণাবলির তালিকা সংগ্রহ করে ব্যক্তি তার চিন্তাকে আরও ফলদায়ক করতে পারে। দুর্বল দিকগুলো এক্ষেত্রে কাটিয়ে উঠে গুণগুলোকে আরও কিভাবে বিকশিত করা যায় সে সম্পর্কেও সে এ পর্যায়ে ধারণা নিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষকের নিকট থেকে নিম্নোক্ত বিষয় জানলে সুবিধা হয়:
প্রশিক্ষকের নিকট থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা লাভের পর একজন সম্ভাব্য উদ্যোক্তা তার গুণাবলি শনাক্তকরণের সাথে তার করণীয় বিষয়েও একটা সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করেন। যা তাকে উদ্যোগ গ্রহণে সাহসী করে তোলে ।
মানুষ পরিবেশের দাস। অনুকূল পরিবেশে মানুষের মেধা ও মননের বিকাশ ঘটে। সমাজ, অর্থনীতি, ব্যবসা- বাণিজ্যসহ সর্বত্রই তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে তার বৈপরিত্য লক্ষ করা যায় । মানুষ তার উৎসাহ-উদ্যম হারায়। নেতিবাচক চিন্তা ও হতাশা মানুষকে আচ্ছন্ন করে। ব্যবসায় উদ্যোগের সাথে যেহেতু ঝুঁকির প্রশ্ন জড়িত তাই ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণে একজন ব্যক্তি স্বভাবতই অনুকূল পরিবেশের প্রত্যাশা করে। এরূপ পরিবেশ বলতে নিম্নোক্ত উপাদানসমূহের উপস্থিতিকে বুঝানো হয়ে থাকে:
১. উন্নত অবকাঠামোগত সুবিধা (Advantages of developed infrastructure): ব্যবসায় উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে অবকাঠামোগত সুবিধা; যেমন- বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। এরূপ সুবিধাদি উন্নত হলে উদ্যোক্তারা নতুন উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত হয়। বাংলাদেশে অনুন্নত অবকাঠামোর কারণে ব্যবসায় উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে ।
২. সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা (Govt. patronization): ব্যবসায় উদ্যোগকে সফল করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও গুরুত্বপূর্ণ । উন্নত দেশের সরকারসমূহ এরূপ উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ব্যবসায় বান্ধব নীতি প্রণয়ন, জামানতবিহীন ঋণদান, স্বল্পসুদে বা বিনাসুদে ঋণপ্রদান, কর অবকাশ, সহজে লাইসেন্সসহ ইউটিলিটি সুবিধা প্রদান ইত্যাদির ব্যবস্থা করে থাকে । এতে নতুন উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হয় ।
৩. আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতা ( Socio-economic stability) : ব্যবসায় উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে দেশের আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতা একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পৃথিবীর যে সকল দেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিদ্যমান সেখানে সামাজিক অস্থিরতার মাত্রা কম থাকে। ফলে ব্যবসায়ীরা পরিকল্পিতভাবে স্বল্পমাত্রার ঝুঁকির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে । কিন্তু আমাদের মতো দেশে আর্থ-সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ব্যবসায় উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করে।
৪. অনুকূল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি (Favourable law & order situation) : আইন শৃঙ্খলার সাথেও ব্যবসায় উদ্যোগ বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত। যেখানে প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য লক্ষণীয়, বিচার ব্যবস্থা বিপর্যস্ত, আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর মানুষের আস্থা নেই, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবসময় পথ চলতে হয়- সেখানে ব্যবসায় উদ্যোগ কখনই উৎসাহিত হতে পারে না। তাই এরূপ উদ্যোগ গড়ে উঠতে অনুকূল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিকল্প নেই ।
৫. পর্যাপ্ত পুঁজির প্রাপ্যতা (Availability of sufficient capital) : ব্যবসায় উদ্যোগের ক্ষেত্রে পুঁজি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । নতুন উদ্যোক্তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুঁজির সংকটে ভোগে। তাই পর্যাপ্ত পুঁজির যোগান দিতে না পারায় একসময় ভালো উদ্যোগও সফল হতে পারে না। যে সমাজে মানুষের আয় ও সঞ্চয় বেশি, সেখানে সঞ্চয় থেকেই পুঁজির অংশবিশেষ আসতে পারে। এছাড়া ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে এ ধরনের উদ্যোক্তাদের সহজে ঋণ দেয়, সরকারও নানানভাবে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়- সেখানে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায় উদ্যোগ উৎসাহিত হয়।
৬. উপকরণাদির সহজ প্রাপ্যতা (Availability of means of production) : পুঁজির প্রাপ্যতার সাথে উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ; যেমন- ভূমি শ্রম, কাঁচামাল, ইত্যাদির প্রাপ্যতাও ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে উঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ । উর্বর জমি কৃষি শিল্প গড়তে উৎসাহ দেয়। সস্তা শ্রমিকের কারণে বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠছে। বাঁশ, বেত ইত্যাদি পর্যাপ্ত থাকায় সিলেট বা চট্টগ্রামে এরূপ হস্ত শিল্প গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ রয়েছে।
৭. বাজার সুবিধা (Market facilities) : ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে উঠার ক্ষেত্রে বাজার সুবিধা গুরুত্বপূর্ণ বাজার বলতে নির্দিষ্ট এলাকায় কোনো পণ্য বা সেবার চাহিদাকে বুঝানো হয়। বাংলাদেশ প্রায় ষোল কোটি লোকের দেশ হওয়ায় এখানে স্বাভাবিকভাবেই পণ্য ও সেবার একটা বড় বাজার রয়েছে। তাই এখানে ব্যবসায়। উদ্যোগ উৎসাহিত হওয়ার কথা। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের বিদেশে বড় বাজার থাকায় এখানে অনেক উদ্যোক্তা নানান প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও এ ব্যবসায় উদ্যোগকে সফল করতে সমর্থ হয়েছে।
৮. প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের সুযোগ (Opportunity of training & development) : নতুন উদ্যোক্তাদেরকে উৎসাহ দান ও তথ্য প্রদানের জন্য প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ কেন্দ্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় । এখানে থেকে সম্ভাব্য উদ্যোক্তারা নতুন নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে ও তার বাস্তবায়নের কৌশল সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায় উদ্যোগ উৎসাহিত হয়। উল্লেখ্য অনেক দেশ এক্ষেত্রে যথেষ্ট এগিয়ে। ফলে সে সকল দেশে নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণির বিকাশ লক্ষণীয় ।
বাবা ছোট চাকরি করেন । ভাই-বোনের মধ্যে বড় সামিয়া ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আর লেখাপড়া করবে না সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার ভাবনা বাবার পাশে না দাঁড়ালে ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। ক'দিন চাকরির জন্য বিভিন্ন স্থানে ঘুরলেও সুবিধা হয়নি। এক বড় বোনের পরামর্শে সে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর পরিচালিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে সেলাই ও এমব্রয়ডারির ওপর দু'টি কোর্স শেষ করলো । অতঃপর এলাকার স্বল্পশিক্ষিত কিছু মহিলাকে সে নিজেই কাজ শিখালো । শহরের কিছু উঠতি ফ্যাশন হাউজের মালিকের সাথে যোগাযোগ করলো । দেখলো ভালো কাজের প্রতি তাদের যথেষ্ট আগ্রহ। এর মধ্যে ঘুরে সে বেশ কিছু সেলাই ও এমব্রয়ডারি কেন্দ্র থেকে অভিজ্ঞতা নিলো । অতঃপর কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ে নেমে পড়লো । তার বিভিন্ন ধরনের নতুন এমব্রয়ডারির কাজ অল্প দিনেই তাকে ফ্যাশন হাউজগুলোর নিকট জনপ্রিয় করে তুলেছে । এক্ষেত্রে সামিয়ার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ব্যবসায় উদ্যোগ যা তার আত্মকর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করেছে ।
স্ব-উদ্যোগে নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাকেই আত্মকর্মসংস্থান বলে । সক্ষম প্রতিটা মানুষকেই তার জীবিকা অর্জনের জন্য কোনো না কোনো কাজ করতে হয় । কেউ চাকরি খুঁজে নেয়, কেউ ব্যবসায় করে, আবার কেউ কারও অধীনে শ্রম বা মেধা বিক্রয় না করে নিজেই নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। অন্যের অধীনে চাকরি বা কাজ করার অর্থ হলো কর্মের ঐ ক্ষেত্রটা সৃষ্টি করেছে অন্য ব্যক্তি। তাই উক্ত কর্মসংস্থানে তার কোনো ভূমিকা নেই । কিন্তু যখন কেউ স্ব-উদ্যোগে নিজেই নিজের কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে তখন তা আত্মকর্মসংস্থান বলে বিবেচিত হয় । একজন আর্কিটেক্ট নিজেই কাজ জোগাড় করে ড্রয়িং ও ডিজাইনের কাজ করছেন । একজন ডাক্তার চাকরি না করে নিজেই চেম্বার খুলে রোগী দেখছেন, একজন নিজেই একটা টেম্পু কিনে চালান- এক্ষেত্রে আর্কিটেক্ট যদি অন্যদের সাথে মিলে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম গড়ে তোলেন, ডাক্তার যদি হাসপাতাল গড়েন, টেম্পু চালক যদি কতকগুলো ট্যাম্পু কিনে তা ভাড়া দিয়ে আয় উপার্জন করেন-তবে প্রতিটা ক্ষেত্রে মুনাফার উদ্দেশ্য কাজ করায় ও ঝুঁকি থাকায় তা ব্যবসায় উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ আত্মকর্মসংস্থান একটা বৃহৎ ধারণা যেখানে ব্যবসায় উদ্যোগ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের প্রয়াস । তবে ব্যক্তির জীবিকা অর্জনের উপায় হিসেবে বিবেচনা করলে আত্মকর্মসংস্থান শুধুমাত্র নিজের উন্নয়ন সম্পৃক্ত। কিন্তু ব্যবসায় উদ্যোগ সমাজ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে কৃষির অবদান ছিল মাত্র ১৫.৩৩%। শিল্প ও সেবা খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ৩১.২৮ % ও ৫৩.৩৯%। এ তথ্যই প্রমাণ করে, ব্যবসায় ইতোমধ্যেই সকল সমাজে ও অর্থনীতিতে শক্ত ভিত গড়তে সমর্থ হয়েছে। এ পর্যায়ে যদি কোনো দেশ ব্যবসায় উদ্যোগকে উৎসাহিত না করে, নতুন নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণি যদি বের হয়ে আসতে না পারে অথবা ব্যবসায়ী সমাজ যদি নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে ব্যবসায় সম্প্রসারণ করতে ব্যর্থ হয়- তবে ঐ দেশের উন্নতির চিন্তা অবাস্তব । সেজন্য সকল দেশেই ব্যবসায় উদ্যোগকে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। একটা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যবসায় উদ্যোগের গুরুত্ব নিম্নে তুলে ধরা হলো:
ক) অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic importance) : মানুষ আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে এবং দেশের আয় ও ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায় এমন গুরুত্বের বিষয়কেই অর্থনৈতিক গুরুত্ব বলে। ব্যবসায় উদ্যোগের অর্থনৈতিক গুরুত্ব যে সকল ক্ষেত্রে লক্ষণীয় তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
খ) সামাজিক গুরুত্ব (Social importance) : সমাজের মানুষের প্রয়োজন পূরণে কাজে লাগে বা বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলায় সহায়তা দেয় এমন প্রয়োজনীয় বিষয়কেই সামাজিক গুরুত্ব হিসেবে দেখা হয় । ব্যবসায় উদ্যোগের সামাজিক গুরুত্ব নিম্নে তুলে ধরা হলো:
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্পোদ্যোক্তার গুরুত্ব অপরিসীম। তবে শিল্পোদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য একদিকে যেমন উদ্যোগী মানুষের প্রয়োজন অন্যদিকে প্রয়োজন শিল্পোদ্যোগ পরিবেশের। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ । উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রের ন্যায় শিল্পোদ্যোগেও অনেক সমস্যা দেখা যায় । নিম্নে বাংলাদেশে শিল্পোদ্যোক্তা বা ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তা উন্নয়নের সমস্যাসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. উদ্যোগ বিষয়ক শিক্ষার অভাব (Lack of entrepreneur related education): শিল্প বা ব্যবসায় উদ্যোগে সাধারণ জনগণকে আগ্রহী করে তোলার জন্য এদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো শিক্ষা কার্যক্রম নেই । কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগও সীমিত। সাধারণ শিক্ষায় ব্যবসায় উদ্যোগ, আত্মকর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয় নেই বললেই চলে । বাণিজ্য শিক্ষায় এ বিষয়টা ইদানিং অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তাতে ব্যবহারিক শিক্ষার সুযোগ নেই । ফলে ব্যবসায় উদ্যোগের ক্ষেত্রেও এটি বড় বাধা হয়ে রয়েছে ।
২. প্রশিক্ষণের অভাব ( Lack of training) : শিল্পোদ্যোগে মানুষকে উৎসাহী ও নতুন উদ্যোক্তাদের তাদের উদ্যোগে সফল করতে যে প্রশিক্ষণ সুবিধার প্রয়োজন বাংলাদেশে তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যুব অধিদপ্তরসহ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান এ লক্ষ্যে কিছু কাজ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। দু-একটা এনজিও কিছু কাজ করলেও তা যথেষ্ট নয় ।
৩. সরকারি সাহায্য-সহযোগিতার অভাব (Lack of Govt, assistances) : বাংলাদেশে শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা নেই বললেই চলে। খাতা-কলমে প্রোগ্রাম থাকলেও ব্যবসায় উদ্যোগ সফল করতে এবং নতুন উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আনতে সরকারের যে ধরনের উৎসাহমূলক, সমর্থনমূলক ও সংরক্ষণমূলক সেবা সহায়তার প্রয়োজন তার যথেষ্ট ঘাটতি বিদ্যমান।
৪. মূলধনের অভাব (Lack of capital) : ব্যবসায় বা শিল্পোদ্যোগের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো পর্যাপ্ত মূলধনের ব্যবস্থাকরণ । বাংলাদেশের মানুষের সঞ্চয়ের সামর্থ্য কম হওয়ায় একদিকে যেমনি উদ্যোক্তার নিজস্ব মূলধন কম থাকে, তেমনি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মূলধন সরবরাহে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহ দেখায় না । কর্মসংস্থান ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড এক্ষেত্রে কিছু কাজ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তাদের কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত ।
৫. আইনগত জটিলতা (Legal complexity) : আমাদের দেশে শিল্পোদ্যোগ প্রক্রিয়ায় প্রকল্প গ্রহণ থেকে শুরু করে তা বাস্তবায়ন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে একজন উদ্যোক্তা নানান আইনগত ও বৈষয়িক জটিলতার সম্মুখীন হয় । যেমন- ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য বিভিন্ন লাইসেন্স সংগ্রহে, ঋণ গ্রহণে, সরকারি সেবা সুবিধা পেতে জটিলতা ইত্যাদি । এ সকল জটিলতা দূর করতে না পারলে এদেশে শিল্পোদ্যোগ কার্যক্রম কখনও ত্বরান্বিত হবে না ।
৬. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব ( Lack of political stability) : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা শিল্পোদ্যোগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত প্রয়োজন । স্থিতিশীল রাজনীতিতে জনগণ স্বচ্ছন্দে ব্যবসায়- বাণিজ্য করতে পারে । ফলে একজন ব্যবসায়ী নতুন নতুন চিন্তা-চেতনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক অঙ্গন প্রায় সব সময়ই উত্তপ্ত থাকে যা শিল্পোদ্যোগের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৭. প্রচার-প্রচারণার অভাব (Lack of publicity) : ব্যবসায় উদ্যোগকে উৎসাহিত ও এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও আগ্রহ সৃষ্টির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা থাকা দরকার তারও যথেষ্ট অভাব এ দেশে লক্ষণীয়। গণমাধ্যমগুলোতে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, দুর্ঘটনা, হরতাল রাজনৈতিক বক্তব্য- বিবৃতি যেভাবে প্রাধান্য পায় ভালো খবর, ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতি ও সফল উদ্যোক্তাদের সাফল্য গাঁথা সেভাবে প্রচারিত হয় না । ফলে নতুনদের চিন্তার জগতে ব্যবসায় উদ্যোগ নাড়া দিতে পারছে না ।
বাংলাদেশ একটা সম্ভাবনার দেশ। এদেশের তরুণ ও যুব সমাজ মেধা ও মননের দিক থেকে উন্নত দেশগুলোর মানুষের চাইতে খুব পিছনে এটা বলার কোনোই সুযোগ নেই। ব্যবসায় উদ্যোগের সুফল বুঝতে পারলে এবং ব্যবসায় উদ্যোগ পরিবেশ উন্নত করা গেলে এ দেশের যুবশক্তি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাবলি দূর করার উপায় নিয়ে উল্লেখ করা হলো:
রায় বাহাদুর রণদা প্রসাদ সাহা বাংলাদেশের একটা সাধারণ সাহা পরিবারের সন্তান ছিলেন । ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার সাভারের উপকণ্ঠে কাছুর পল্লীতে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম । পৈতৃক নিবাস টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে । তাঁর পিতা দেবেন্দ্র পোদ্দার ছোট ব্যবসায়ী ছিলেন। অভাবের সংসারে রণদা প্রসাদ বাল্যকালে দুর্দান্ত প্রকৃতির হওয়ায় তাকে নিয়ে মাঝে-মধ্যেই পরিবারে অশান্তি হতো । শুনা যায়, এক অপরাধের কারণে তাঁর বাবা তাঁকে একবার খড়ম ছুড়ে মারেন । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই খড়ম গিয়ে তাঁর মায়ের কপালে লাগে। সেই আঘাতে তার মায়ের জ্বর এবং ধনুষ্টঙ্কার রোগ হয় এবং কয়েকদিনের মধ্যেই মা কুমুদিনী দেবী ইহলোক ত্যাগ করেন । মায়ের এই অপমৃত্যু এবং আত্মীয়-স্বজনদের তার প্রতি ক্ষোভ ও চরম নির্লিপ্ততা বালকের মনে এক তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে- যা তিনি সারা জীবনেও ভুলতে পারেননি ।
তখনকার দিনে সাহা পরিবারের ছেলেমেয়েদের বেশি লেখাপড়া শিক্ষা দেয়া হতো না । তাই নিম্ন-প্রাইমারির অধিক শিক্ষা তিনি পাননি। ১৯১৪ সনে ইউরোপে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে বাড়ি হতে পালানোর এক সুযোগে যুদ্ধে লোক নিয়োগের অফিসে তিনি তার নিজের নাম লেখালেন। পরে তাকে বেঙ্গল এ্যাম্বুলেন্স কোরে পুরুষ নার্স হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তিনি মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে আহত কয়েকজন সৈনিকের প্রাণরক্ষা করেন। এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ যুদ্ধ শেষ হলে রণদা প্রাসাদকে স্বয়ং রাজার সঙ্গে করমর্দনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এটাই তাঁর প্রথম ইংল্যান্ড সফর।
যুদ্ধে অংশগ্রহণের পুরস্কার হিসেবে প্রথম মহাযুদ্ধ ফেরত সকল ভারতীয়কেই ইংরেজরা তাদের যোগ্যতা অনুসারে কোন না কোন সরকারি চাকরিতে যোগদান করার সুযোগ দেয়। মি প্রসাদের লেখাপড়া নিম্ন প্রাইমারিতে শেষ হলেও যুদ্ধে তার কৃতিত্ব বিবেচনায় রেলের টিকেট কালেকটরের চাকরি দেয়া হয় । অবশ্য এই চাকরিটি তাঁর বেশিদিন থাকেনি। একটি মামলায় পড়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৩২ সালে তাঁকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছিল। চাকরি জীবনের অবসানের পর কলকাতায় তিনি ছোট একটি কয়লার ব্যবসায় শুরু করলেন। এটাই তাঁর ব্যবসায় জীবনের শুরু ।
রণদা প্রসাদের একটি আশ্চর্য গুণ ছিল এই যে, যে ব্যবসায় অন্য লোকেরা চালাতে না পেরে স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করে দিত, সুযোগ মতো তিনি তা কিনে নিজ দক্ষতা ও ঐকান্তিকতা দ্বারা স্বচ্ছল অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করতেন । হয়তোবা ব্যবসায়ী গোত্রের লোক বলেই সম্ভবত তিনি যেকোন ব্যবসায়ের প্রধান সাংগঠনিক সমস্যাগুলো বুঝতে ও দ্রুত সমাধান করতে পারতেন। তিনি এ কয়লার ব্যবসায় যখন করছিলেন, সেই সময় একদিন লক্ষ করলেন, তাঁর জনৈক খরিদ্দার লঞ্চের মালিক বেশ কিছুদিন ধরে আর কয়লার দাম পরিশোধ করতে পারছেন না। তিনি নিজেই উক্ত লঞ্চটি ক্রয় করলেন। লঞ্চ ব্যবসায় কিছুকাল চললে দেখা গেল পুরানো লঞ্চ সারাবার জন্য প্রায়ই ডকইয়ার্ডে প্রচুর পয়সা দিতে হয়। যদি ডকইয়ার্ড বানানো যায়, তবে নিজের ব্যয় কমবে এবং অন্যদের কাজ করে আয় করা যাবে- এ চিন্তাতেই পরে তিনি ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন । এভাবে কয়লা হতে লঞ্চ এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে লঞ্চ মেরামতের ডকইয়ার্ড তাঁর ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত হয় ।
বেশ ক'টি ব্যবসায় একত্রে যুক্ত হলেও এগুলো সুষ্ঠুভাবে চালানোর মত অর্থ তখন তাঁর কাছে ছিল না । তৎকালীন কয়েকজন বিত্তশালী বাঙালি অর্থের যোগানদারকে তিনি অংশীদার করেন এবং তাদের সহযোগে বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানি চালু করেন । এই কোম্পানির অন্যান্য অংশীদার ছিলেন মহেড়ার জমিদার নৃপেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী, ড. বিধান চন্দ্র রায়, ধনপতি ও রাজনীতিক নলিনী রঞ্জন সরকার এবং জাস্টিস জে.এন. মজুমদার ।
এক সময় ব্যবসায়ে চড়া ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসায় সম্প্রসারণের সুযোগ আসে। তিনি বিষয়টা অন্যান্য অংশীদারদের জানালেন । কিন্তু অন্যরা ঝুঁকি গ্রহণ পছন্দ করলেন না । ফলে অন্যান্য অংশীদারদের টাকা পরিশোধ করে দিয়ে তিনি নিজেই এর মালিক হন এবং সমগ্র দায় ও ঝুঁকি নিজের কাঁধে নিয়ে ব্যবসায়কে এগিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য এ সময়েও তাঁর মোট মূলধনের পরিমাণ সহস্রের অঙ্কেই সীমাবদ্ধ ছিল, লক্ষের কোঠায় যায়নি।
বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানির কাজ ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নদীপথে মাল আনা-নেয়া করা । এ কোম্পানি যখন মধ্যম আকারে বেশ লাভজনক ব্যবসায় এসে পৌঁছেছে, সেই সময় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হয়। ১৯৪২ সালের দিকে বাংলাদেশে খাদ্যের মূল্য চড়তে শুরু করে এবং যুদ্ধ ক্রমশ বাংলাদেশের উপকণ্ঠে আসতে থাকে। জাপানিরা তখন ব্রহ্মদেশ (বর্তমান মায়ানমার) দখল করেছে। এই ব্রহ্মদেশই ছিল তখন ইংরেজদের চাউলের প্রধান ভরসা । তাই ব্রহ্মদেশ যখন তাদের হাতছাড়া হলো, তখন সামরিক বাহিনীর জন্য এবং বেসামরিক প্রশাসনের খাতিরে ইংরেজ সরকার তৎকালীন বেঙ্গল (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা হতে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য ক্রয় করার একটি পরিকল্পনা করে। এই সময় সরকারের পক্ষে খাদ্যশস্য খরিদ করার জন্য তৎকালীন বেঙ্গলে চারজন ক্রয়কারী এজেন্ট নিয়োগ করা হয়। এই চারজন সংগ্রহকারীর মধ্যে রণদা সাহা একজন সংগ্রহকারী রূপে নিযুক্ত হন। এই সময় চাউলের মূল্য দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে এবং অনেক সময়ই আগাম ক্রয় করা চাউলের জন্য এজেন্টগণ বাজার দরে যে টাকা পেতেন তা অভাবনীয় মাত্রায় বেশি ছিল। ফলে ১৯৪৪ সালের মধ্যে রণদা সাহার অর্জিত মূলধনের পরিমাণ সে সময়ে কয়েক লক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়। যখন উদ্বৃত্ত টাকার তিনি মালিক হলেন তখন তার মনে এক ভাবাত্তরের জন্ম নেয়। বিনা চিকিৎসায় মাতার মৃত্যু এবং যুদ্ধকালে সৈনিকদের দুঃসহ অবস্থা স্মরণ করে জীবন সম্পর্কে এক অদ্ভুত চেতনা তিনি অনুভব করেন । তাই তিনি প্রথমে ঠিক করলেন স্বগ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করবেন এবং নিজ সন্তানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন । তাই দ্বিতীয় কন্যা জয়া (পরে মিসেস জয়াপতি) কে উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃটেনে প্রেরণ করেন। ১৯৪৪ সালে রণদা সাহা মির্জাপুরের ভুতুড়ে খাল বলে পরিচিত এলাকায় একটি পঞ্চাশ বেডের হাসপাতাল এবং একটি দাতব্য ডিসপেন্সারি স্থাপন করেন । এর নাম ছিল শোভা সুন্দরী ডিসপেন্সারি ।
এ সময়ে নারায়ণগঞ্জে অতি প্রাচীন পাট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান জর্জ এন্ডারসন কোম্পানি তাদের পাটের ব্যবসায় তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে রণদা সাহা একে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে জর্জ এন্ডারসনের পাটের ব্যবসায় ক্রয় করেন এবং বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানির সাথে যুক্ত করে নারায়ণগঞ্জে পাটের বেইলিং, ভাড়া দেয়ার জন্যে পাটের গুদাম এবং একটি ডকইয়ার্ড চালু করেন ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব মুহূর্তে তাঁর মোট খাটানো মূলধনের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় দুই কোটি টাকার মত। কিন্তু ব্যবসায় বা টাকার মালিকানা তাঁকে তৃপ্তি দিতে পারেনি। তাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি তাঁর সম্পূর্ণ ব্যবসায় হতে যে আয় হবে তা দ্বারা মায়ের নামে একটি দাতব্য ট্রাস্ট গঠন করেন । এটাই কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট নামে খ্যাত। বর্তমানে বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানি এই ট্রাস্টেরই একটি সম্পত্তি এবং ট্রাস্টেরই আয় হতে মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস, কুমুদিনী হাসপাতালের স্কুল অব নার্সিং, টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজ এবং এস.কে হাই স্কুল (ছেলেদের জন্য) পরিচালিত হয়ে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, মানিকগঞ্জের বিখ্যাত দেবেন্দ্র কলেজটিও তাঁর পিতার স্মৃতির রক্ষার্থে রণদা সাহাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কুমুদিনী হাসপাতালে বর্তমান প্রায় এক হাজার বেড রয়েছে এবং ভারতেশ্বরী হোমসে ছাত্রীদেরকে সম্পূর্ণ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা হয় । এখানে একত্রে এক হাজার ছাত্রী পড়াশুনা করে থাকে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিক্তশালী হিন্দুরা অনেকেই ভারতে চলে যান, কিন্তু রণদা প্রসাদ সাহা তাঁর মাতৃভূমি ত্যাগ করেননি। এমনকি ১৯৭১ সালে যখন দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তিনি নিজে এবং মির্জাপুরের অনেক হিন্দু বিজ্ঞজন বাংলাদেশে থেকে মাতৃভূমির সেবা ও সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন । যার ফল হয় খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ১৯৭১ সালে ৭ মে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ভবানী সাহাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং তাঁদের আর কোনো সন্ধানই পাওয়া যায়নি। জীবনযুদ্ধে সফল এই সৈনিক যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, মাতৃভূমিকে ভালোবেসেছিলেন, দেশের ও সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন দেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তাঁর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ও মৃত্যু জাতির জন্য খুবই বেদনাদায়ক ।
বর্ণালী প্রতিভা ও গুণের অধিকারী সফল সমাজ উন্নয়ন কর্মী, দক্ষ সংগঠক ও সফল উদ্যোক্তা ড. হুসনে আরা বেগম দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি মহিলা উন্নয়ন সংগঠন TMSS (ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ) এর নির্বাহী পরিচালক ।
১৯৫৩ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি বগুড়া জেলার সদর উপজেলার ঠেঙ্গামারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাস করার পর ওয়াশিংটন ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে পি এইচ ডি ডিগ্রী লাভ করেন। তার কোর্স বিষয়ের নাম ছিল বাংলাদেশের গ্রামীণ কাঠামোতে লিঙ্গ সাম্য ও সমতা (Gender equity & equality) উন্নয়নে TMSS (NGO) এর ভূমিকা। বগুড়ার নাসরাতপুর কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে তিনি শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন এবং কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৮৫ সালে পূর্ণাঙ্গ একজন সমাজকর্মী হিসেবে TMSS এর কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ১৯৮৫-১৯৯১ পর্যন্ত TMSS এর সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সাল থেকে TMSS এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
একটা গ্রাম থেকে কাজ শুরু করলেও TMSS তার সুযোগ্য পরিচালনায় বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় ২৮,৪০,৭৭৪টি পরিবারকে ইতোমধ্যে সহায়তা প্রদান করেছে। যার মধ্যে ১০,৬০,৮৫৪টি পরিবারকে উন্নয়ন সেবা এবং ১৭,৭৯,৯২০টি পরিবারকে ক্ষুদ্র ঋণ সেবা প্রদান করা হয়েছে। TMSS এর ২০ ধরনের ক্ষুদ্র ঋণ সেবা চালু রয়েছে । এছাড়া কৃষি, সামাজিক উন্নয়ন সেবা, মানবধিকার ও লিঙ্গ, মৎস্য ও গবাদি পশু, স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কার্যক্রম, শিক্ষা, কৃষি ও অকৃষি কার্যক্রম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি কর্মসূচি, পরিবেশ ও বনায়ন কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য । বৈশ্বিক ও দেশীয় বিভিন্ন সমস্যাকে সামনে রেখে TMSS এখন বিভিন্ন কর্মসূচি;
যেমন- দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গসমতা, মানব সম্পদ উন্নয়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমানো, স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে । ড. হুসনে আরা বেগম একজন দক্ষ সামাজিক সংগঠক হিসেবে TMSS এর সাথেই শুধু সংযুক্ত থাকেননি তিনি বগুড়ার আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে শুরু থেকেই কাজ করে এসেছেন। যেখানে যতটা সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই সমাজকর্মের সাথে সম্পৃক্ত থেকে উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন । শিক্ষা জীবনেই তিনি আল-আমীন সমিতি নামে একটা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপার্সন হিসেবে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন । এরপর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ৩০টির অধিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন। এর মধ্যে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য, PKSF (পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন) এর সদস্য, আনসার ভিডিপি ব্যাংকের পরিচালক সদস্য, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARK) এর গভর্নিং বডির সদস্য ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । তিনি বর্তমানে TMSS এর নির্বাহী পরিচালক ছাড়াও নারী উদ্যোক্তা ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রচণ্ড আত্মপ্রয়াসী ও কর্মনিষ্ঠ ড. হুসনে আরা বেগম সমাজ তথা নারী সমাজের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে যেয়ে বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন, প্রায় ২০টি দেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। যার মধ্যে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে গ্রামীণ মহিলা সংগঠন ও নেতৃত্ব পুরস্কার, ১৯৯৩ ও ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় জনসংখ্যা পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর বনায়ন পুরস্কার, ২০০৫ সালে মৎস ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রদত্ত জাতীয় মৎস্য পক্ষ স্বর্ণপদক পুরস্কার, জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা UNCDF কর্তৃক বৈশ্বিক ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার বাংলাদেশ ২০০৫ এর সম্মান অর্জন, ২০০৫ সালে PKSF কর্তৃক Best Partner Award, ২০০৭ সালে কেয়ারটেকার সরকার প্রধান থেকে Best Award for National Forestry 2007 এবং ২০০৯ সালে কেয়ারটেকার সরকার প্রধান থেকে বেগম রোকেয়া পুরস্কার ২০০৭ লাভ করেন ।
বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ। যেখানেই উদ্যোগ নিয়ে কোনো কাজে কেউ এগিয়ে গেছে দু'চারটে ব্যতিক্রম বাদ দিলে সেখানেই সফলতা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে এখন তার চিরায়ত গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। তাই ব্যাপক প্রচারিত না হলেও নিরবে রচিত হচ্ছে অনেক সাফল্য গাঁথা । এদের অনেকেই আত্মকর্মসংস্থানের জন্য কাজ শুরু করলেও এক পর্যায়ে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করছেন । এমনই দু'একজনের জীবন সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো :
কৃষকের ছেলে ভালো কৃষক হবে নতুন ফসল ফলাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চা শ্রমিক- যাদের জীবন সাধারণ কৃষক ও পেশাজীবী মানুষ থেকে ভিন্নতর তারা যদি সামান্য সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থেকে কৃষি ক্ষেত্রে নেমে সফল কৃষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও সম্মান লাভ করতে পারে তবে তা নিঃসন্দেহে গৌরবের। এমনই একজন সফল কৃষক কুমার দুধবংশী।
চা শ্রমিক সম্পর্কে যারা কিছুটা খোঁজ-খবর রাখেন তারা জানেন তাদের জীবন কত কষ্টের । দৈনিক মাত্র ৪৮ টাকা মজুরি পেয়ে তা দিয়ে ১১ জন সদস্যের পরিবার চালিয়েছেন কুমার দুধবংশী। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার খাই ছড়া চা বাগানে আর পাঁচজন সাধারণ শ্রমিকের মত তারও জীবন ছিল ছকে বাধা। সকালে চা বাগান, চা পাতা সংগ্রহ, বাগান পরিচর্যার কাজ। আর সন্ধ্যা বেলায় পরিবার পরিজন ও বন্ধু বান্ধবের সাথে সুখ দুঃখের গল্প, হৈ-চৈ, আর সুযোগ পেলেই নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকা। কুমার দুধবংশীর মাথায় এলো সবাইতো এটা করছে । তাই ভিন্ন কিছু করা যায় কি না। চা বাগানের ভিতরে অনেক জমি এমনি পড়ে থাকে । সেখানে চাষবাস করে বাড়তি আয়ের চিন্তা নিয়েই তিনি প্রথমে কৃষিতে নেমে পড়েন। সব্জী চাষ দিয়ে শুরু হয় নতুন জীবন। তার বাগানে সারা বছর নানান ধরনের সব্জীর চাষ । বর্ষাকালে ঝিঙ্গা, করলা, বরবটি ইত্যাদির চাষ করেছেন। অন্য সময়ে বাধাকপি, টমেটো, আলু, লাউ ইত্যাদি চাষ হচ্ছে। বিক্রয় নিয়ে সমস্যা নেই। চা বাগানগুলোর হাজার হাজার শ্রমিক। তারাই তার ক্রেতা। তার কৃষি ক্ষেতে এক একটা পুষ্ট ঝিঙ্গার ওজন ৪০0 গ্রাম থেকে ৫৪০ গ্রাম । করলার ওজনও ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম। একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে তিন বছর কৃষি কাজ করার পর 'বিগত দু'বছরে তিনি স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করেছেন। ২০১২ সালে রাজা টমেটোর চাষ করে তিনি এক লক্ষ টাকা আয় করেছেন। ঝিঙ্গা-করলা ইত্যাদি খাতেও লক্ষাধিক টাকা আয় হয়েছে । আলুর চাষ করে প্রায় ১০০ মণ আলু ফলিয়েছেন । এখন তার দেখাদেখি অনেকেই বাড়ির আশেপাশে ও পতিত জমিতে কৃষিকাজ করছে । তিনি এখন এলাকার একজন আদর্শ কৃষক ।
কঠোর পরিশ্রম, মেধা ও কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা থাকলে স্বল্প পুঁজি নিয়েও যে ভাগ্য বদল করা যায় তার বাস্তব প্রমাণ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জের পোল্ট্রি খামারি নিজাম । মাত্র ১২ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে তিনি পোল্ট্রি খামার করে বর্তমানে জেলার অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠিত পোল্ট্রি ব্যবসায়ী। তার পোল্ট্রি খাতে বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি টাকা ।
১৯৯৭ সালে স্থানীয় কলেজে বিএসএস (ডিগ্রি) শেষবর্ষের ছাত্র ছিলেন নিজাম। সংসারে ৪ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। মাথার ভেতর বড় ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন তার। শখের বসে বাড়ির পাশে একখণ্ড জমিতে গড়ে তোলেন পোল্ট্রি খামার। পুঁজি ১২ হাজার টাকা। পড়াশোনার পাশাপাশি খামারে ব্রয়লার মুরগির লালন-পালন চলে ভালোভাবে। নিজ এলাকার চন্দ্রগঞ্জ বাজারে একটি দোকান নিয়ে শুরু করেন ব্রয়লার মুরগির খুচরা বিক্রি। ১৯৯৮ সালে ঢাকার লায়ন এগ্রো অফিসে ৩ দিনব্যাপী পোল্ট্রি বিষয়ক কর্মশালায় অংশ নিয়ে মুরগি পালন সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন। এরপর তার আরো আগ্রহ বেড়ে যায়। ছেলের পরিশ্রম, আগ্রহ ও পোল্ট্রি খামারের ব্যবসার ভালো অবস্থা দেখে বাবা হোসেন আহমেদ পুঁজি দিলেন আরো ৭০ হাজার টাকা। সেই থেকে গতি পায় তার ব্যবসায় । খামার প্রসারে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেন তার ছোট ভাই শাহাবুদ্দিন ।
সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির পোল্ট্রি খাদ্য ও মেডিসিনের ডিলার নিয়ে তিনি গড়ে ! তোলেন সোনালি ফিডস অ্যান্ড চিকস। এ ছাড়া উপজেলার কুশাখালী ইউনিয়নের জাউডগা গ্রামে ১০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে মমতাজ এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। এখানে রয়েছে লেয়ার মুরগি ও মৎস্য খামার। এ খামারে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার ডিম উৎপাদন ও মৎস্য খামার থেকে বছরে ১০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করা - হয় । এ ছাড়া তার আরো কয়েকটি মুরগির খামারে দৈনিক ৮ থেকে ৯ হাজার ডিম উৎপাদন হয় । ডিম বিক্রি হয় - দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এ লেয়ার খামারগুলো গড়ে তোলা হয়েছে সদর উপজেলার নূরুলাপুর, জকসিন, বসুরহাট, চন্দ্রগঞ্জের লতিফপুর ও বেগমগঞ্জ উপজেলার আমিনবাজারে ।
এ ছাড়া সদর উপজেলার ৫৫টি ব্রয়লার মুরগি খামারে তার বিনিয়োগ রয়েছে। এসব খামারের মালিককে সম্পূর্ণ বাকিতে বাচ্চা, খাদ্য ও মেডিসিন দেওয়া হয়। পরে বাচ্চা পরিপূর্ণ হলে তা বিক্রি করে খামার মালিকরা নিজামের বকেয়া পরিশোধ করেন। ব্রয়লার মুরগি ও লেয়ারের ডিম লক্ষ্মীপুর ও পার্শ্ববর্তী জেলা নোয়াখালী ও ফেনীতে সরবরাহ হয়ে থাকে। নিজামের প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগ হওয়ায় প্রায় ৩৫টি পরিবারে আসে সচ্ছলতা । ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাসিক বেতন দেওয়া হচ্ছে আড়াই লাখ টাকা ।
সংগ্রামী মানুষের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। হতদরিদ্র রহিমা তাদেরই একজন। দিনমজুর বাবার বাড়ি ছিল পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার হাঁটুরিয়ার নাকালিয়ায় । রহিমা বাবার ঘরে থাকা অবস্থায় শেষ সম্বল ভিটাবাড়ি সর্বনাশা যমুনার করালগ্রাসে নিমজ্জিত হয় । অভাবী বাবা অপরিণত বয়সের রহিমাকে চাল-চুলাবিহীন রহিমের সঙ্গে বিয়ে দেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোলজুড়ে সন্তান আসে । দিশেহারা রহিম খাল-বিলে মাছ ধরে দিন যাপন করত। সেই সময়ও হাল ছাড়েননি রহিমা। স্বপ্ন দেখতেন একদিন একটি পুকুর লিজ নেবেন, সেখানে মাছ চাষ করে সন্তান লালন-পালন করবেন, সন্তানদের স্কুলে পড়াবেন, দু'বেলা পেট ভরে খাবেন । এ বিষয়গুলো গল্পের মতো মনে হলেও রহিমার কাছ থেকে শুনলে আরো বেশি মনে হয় ।
সরেজমিন জানা যায় পাবনার বেড়া উপজেলার চাকলা ইউনিয়নের রহিমা-রহিমের পরিবর্তনের কথা । রহিমা বলেন, ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আসিয়াব তাদের গ্রামে জরিপ চালায়। এ সময় হতদরিদ্র পরিবার হিসেবে তারা মনোনীত হয়। পরে ২৯ জন সদস্য নিয়ে জীবিকার সন্ধানে মহিলা উন্নয়ন সংগঠন নামে একটি দল গঠন করে আয়বর্ধনমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন রহিমা । প্রশিক্ষণ শেষে অনুদান হিসেবে ১৪ হাজার টাকা ব্যবসায়ের জন্য এবং মাসিক জীবিকা সহায়ক ভাতা হিসেবে ২০ মাস ৫০০ টাকা হারে এবং দুর্যোগকালীন সহায়তা হিসেবে ৪ মাস ১ হাজার টাকা হারে মোট ২৮ হাজার টাকা পাবেন। রহিমা ব্যবসায়ের জন্য ১৪ হাজার টাকা পাওয়ার পর সেই টাকার সঙ্গে নিজের ছাগল ও হাঁস-মুরগি বিক্রয়ের টাকা মিলিয়ে মোট ২০ হাজার টাকা দিয়ে তিন বিঘার একটি পুকুর ১ বছরের জন্য লিজ নেন । সেই পুকুরে মাছের ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করেন। রহিমার কাছ থেকে জানা যায়, তিনি গত ৯ মাসে ৫৫ হাজার টাকার পোনামাছ ও মাছ বিক্রয় করেছেন । তার পুকুরের চারপাশে নেপিয়ার ঘাস ও লাউ বিক্রি করে অতিরিক্ত ১২ হাজার টাকা আয় করেন । আরো ৩টি পুকুর ৩০ হাজার টাকা দিয়ে লিজ নেন । যেখানে ৪০ হাজার টাকার পোনামাছ বড় করার জন্য চাষ করা হচ্ছে । রহিমার হিসাব মতে, বছর শেষে ৪টি পুকুর থেকে কমপক্ষে ২ লাখ টাকার মাছ বিক্রয় করবেন । উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, এমন অসংখ্য রহিমা, যারা কি না আসিয়ারের হতদরিদ্রদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্পের সহযোগিতা পেয়ে নিজের জীবনে আমুল পরিবর্তন এনেছেন ।
সুমি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ছে । তার বইয়ে সে নারী উদ্যোক্তার কথা দেখলেও এমন উদ্যোক্তার সংখ্যা কম দেখে সে খুবই হতাশ। সে দেখে গার্মেন্টসগুলোতে বেশির ভাগই নারী শ্রমিক । রাস্তায় উন্নয়নের কাজেও সে মেয়েদের দেখে তার মন বড়ই খারাপ হয়। সে দেখছে তার পরিচিত এক বড় বোন এলাকার মেয়েদের সংগঠিত করে তাদের সেলাই, এমব্রয়ডারি ও হাতের কাজ শিখিয়ে তাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। তাদের উৎপাদিত সামগ্রী তিনি প্রথমে কষ্ট করে ঢাকায় নিয়ে বিক্রয় করতেন । এখন আর তার প্রয়োজন পড়ে না । ঢাকায় থেকে অর্ডার দিয়ে লোকেরা এসে মালামাল নিয়ে যায়। সে ভাবছে তার এ বোনটি প্রকৃতই একজন নারী উদ্যোক্তা। সেও লেখাপড়া শিখে নারী উদ্যোক্তা হয়ে দেশের নারী সমাজকে এগিয়ে নেবে এটা সে ঠিক করে ফেলেছে।
নারী উদ্যোক্তা বলতে এমন কোনো নারীকে বুঝায় যিনি তার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে কোনো ব্যবসায়কে সংগঠিত ও পরিচালনা করেন । অনেক সময়ই নারীরা পুরুষের সহযোগী হিসেবে ব্যবসায় কাজে সহযোগিতা করে থাকেন । সেক্ষেত্রে তাদেরকে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে দেখা হয় না। যিনি নিজের মালিকানায়, নিজের উদ্যোগে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ব্যবসায়কে সংগঠিত করে পরিচালনা করেন তাকে বাস্তবিক অর্থে নারী উদ্যোক্তা বলে । শিল্পনীতি ২০১০ এ প্রবর্তিত সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এমন কোনো মহিলাকে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে গণ্য করা হবে। যিনি কোনো ব্যক্তিগত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক অথবা যৌথ উদ্যোক্তা (অংশীদার) বা কোম্পানির ক্ষেত্রে এর ৫১% শেয়ার মূলধনের মালিক। অর্থাৎ নারী উদ্যোক্তা হলেন এমন কোনো মহিলা যিনি নিজস্ব মালিকানায় কোনো একমালিকানা ব্যবসায় গড়ে তুলেছেন বা অংশীদারি ব্যবসায় বা কোম্পানি সংগঠন গড়ে তুললেও তার ৫১% শেয়ারের মালিক । অর্থাৎ শুধুমাত্র অংশীদারির খাতায় নাম থাকলে বা কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হলেই তাকে নারী উদ্যোক্তা বলা যাবে না ।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ে নারী উদ্যোক্তার আগমন হার আশাব্যঞ্জক নয়। অথচ নারী-পুরুষ সমানভাবে কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে না এলে একটা জাতির উন্নতি আশা করা যায় না। গ্রামীণ ব্যাংকসহ এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো নারীর ক্ষমতায়নের চেষ্টায় নারীদের ঋণ দিচ্ছে। তাতে তারা নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য কুটির শিল্প, পোলট্রি, ডেইরি, ছোট ব্যবসায় গড়ে তুলতে উৎসাহিত হচ্ছে । কক্সবাজারে গেলেই দেখা যাবে উপজাতি নৃগোষ্ঠীর মেয়েরা সুন্দরভাবে দোকান চালাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। বিদেশে এ হার অনেক বেশি। ব্যাপকভিত্তিতে মাহিলাদের উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রশিক্ষণসহ মূলধন সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করছে। নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভবিষ্যতে নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসার হার উৎসাহব্যঞ্জক হারে বাড়বে এটা আশা করা যায় ।
একাগ্রতা, নিষ্ঠা আর কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে নিজেকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব- এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নারী উদ্যোক্তা রেহানা কাশেম। মাত্র ৬ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় শুরু করে এখন তার পুঁজি ৫০ লাখ টাকারও বেশি । নারী উদ্যোক্তাদের কাছে তিনি এক অনন্য আদর্শ ।
একজন সাধারণ গৃহবধু হিসেবে অবসর সময়ে কুশন কভার, টেবিল ম্যাট, ন্যাপকিন ইত্যাদি তৈরি করতেন । প্রতিবেশী এবং বন্ধু-বান্ধবদের কাছে তার এই কাজগুলো ছিল পছন্দের। তারাও অনুরোধ করতেন এসব ডিজাইনের পণ্যগুলো তাদের তৈরি করে দিতে। নিজের এই মেধা এবং সৃজনশীলতাকে পুঁজি করে ১৯৮২ সালে অপেশাদারভাবেই তিনি শুরু করেন হস্তশিল্প ব্যবসায়। কিন্তু হঠাৎ করেই স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ায় এবং বাজার থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে তিনি পুরোপুরি পেশাদারিভাবেই এই ব্যবসায় শুরু করেন। এ সময় তার প্রাথমিক পুঁজি ছিল মাত্র ৬ হাজার টাকা । মেয়েদের পোশাক ডিজাইনিংয়ে মনোযোগ দেন তিনি। ১৯৮৫ সালে এসে তার পুঁজি দাঁড়ায় প্রায় ৬ লাখ টাকা। এ বছর তিনি তার ব্যবসাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন সাতরং হ্যান্ডিক্রাফটস অ্যান্ড ফ্যাশন নামে । এ সময় প্রথম অর্ডারটি পান ফ্যাশন হাউস ভূষণের কাছ থেকে । তার কাজে মুগ্ধ হয়ে ভূষণের স্বত্বাধিকারী তাকে পাঞ্জাবি তৈরি করার কার্যাদেশ দেন। সেই থেকে শুরু । আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে । ১৯৯৫ সালে তিনি মাইডাস থেকে ২ লাখ টাকা জামানতবিহীন ঋণ পেলেন । মাইডাসের এই ঋণের মাধ্যমে তিনি তার সেলাই মেশিনের সংখ্যা বাড়িয়ে নিলেন ১৮ থেকে ৩৭-এ । অল্পদিনের মধ্যে তার একাগ্রতা এবং ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি মাইডাসের শীর্ষ ব্যক্তিদের নজরে এলো। তারা তাকে একজন ঋণগ্রহীতা হিসেবে বিবেচনা না করে তার ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক বাড়ানোর কাজে সহায়তা করলেন। মাইডাস মিনি মার্টের সদস্য হলেন তিনি। এভাবে তার পোশাক সমাজের আরেকটি বড় অংশের কাছে পরিচিতি পায় এবং প্রশংসা কুড়ায় । সময়ের ব্যবধানে মাইডাস তাকে পুনরায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা ঋণ দেয় ।
মাত্র ৬ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসায় শুরু করে রেহানা কাশেমের নিজস্ব পুঁজি এখন প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। বর্তমানে ঢাকার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তার প্রতিষ্ঠানের শোরুম রয়েছে। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন প্রায় ৩শ কর্মী। তার প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার এখন দেড় কোটি টাকা। ব্যবসায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রেহানা কাশেম একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০০ সালে জবস, ইউএসএইড, ২০০১ সালে ডেইলি স্টার অ্যাওয়ার্ড এবং ২০০৩ সালে অনন্যা বিজনেস অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন তিনি ।
একটু চিন্তা ও চেষ্টা থাকলেই যে কিছু করা সম্ভব তার প্রমাণ বরিশালের রাধা রাণী ঘোষ। মাত্র এসএসসি পাস পরিশ্রমী ও সাহসী নারী এখন নগরীর অমৃত লাল দে সড়কের নতুন বাজার এলাকায় মেসার্স রাধা বস্ত্রালয় নামক একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী । রাধা রাণীর স্বামী ছোট একটি রেস্তোরা চালাতেন। সংসারে টানাটানি ঘুচাতে রাধা রাণী প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। ঘটনাক্রমে ভাইয়ের সাথে ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবাজার থেকে কয়েকটি শাড়ী কিনলেন নিজের ও প্রতিবেশীদের জন্য। শাড়ীগুলো খুব পছন্দ হলো তাদের। আর সেখান থেকেই ঘুরে গেল রাধা রানীর জীবনের মোড়। ঢাকা থেকে শাড়ী কিনে ঘরে বসেই বিক্রি করতে শুরু করলেন। টিউশনি ছেড়ে শাড়ি ও বাচ্চাদের পোষাকের একটি দোকান দিলেন। ব্যবসায়ের সম্প্রসারণের জন্য বেসিক ব্যাংক, বরিশাল শাখা থেকে ২ লাখ টাকা এসএমই ঋণ নেন। পরবর্তিতে আরো ৩ লাখ টাকা নিয়ে ব্যবসায়ের প্রসার ঘটিয়েছেন।
সৃষ্টিকর্তার অমোঘ বিধানে যে কোনো সমাজেই নারী-পুরুষের হার মোটামুটি সমান। তাই দেশের ৫০% জনসংখ্যাকে দেশের উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করা ব্যতিরেকে কোনো দেশের পক্ষেই কার্যত অগ্রগতি লাভ সম্ভব নয়। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশের সরকার বেশ আগে থেকেই নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. প্রশিক্ষণ সুবিধা (Training facilities) : নারী সমাজকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী ও উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সহযোগিতা করার জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে । জুলাই ২০১০ থেকে জুন ২০১৩ মেয়াদে বাস্তবায়নাধীন জেলা পর্যায়ের মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (WTC) সমূহের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ৬৪টি জেলার বিদ্যমান মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম উন্নয়ন ও বৃত্তিমূলক আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। এছাড়া নগরভিত্তিক প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৪৬টি জেলায় ইতোমধ্যেই ২৭,৬০০ মহিলারে প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষ্যে কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে । এছাড়া জাতীয় মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন একাডেমি বিভিন্ন ট্রেডে মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে । এছাড়া যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের আওতায় যুব ও যুব মহিলাদের বিভিন্ন । ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান অব্যাহত রয়েছে।
২. অর্থ প্রদান সহায়তা (Fanancing facilities) : যে সেকল নারীরা নিজেদেরকে স্বাবলম্বী ও উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ইচ্ছুক, প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের সেজন্য প্রস্তুত করছে তাদের সরকারের পক্ষ থেকে ঋণ ও আর্থিক সুবিধা দেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প কাজ করছে। জাতীয় মহিলা সংস্থার আওতাধীন স্বকর্ম সহায়ক ঋণ কার্যক্রমের অধীনে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে প্রত্যেক নারীকে ৫,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করা হয়ে থাকে । মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির আওতায় ৬৪টি জেলার ৪৭৩টি উপজেলায় প্রত্যেক নারীকে ৫,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করা হয়ে থাকে । নগরভিত্তিক প্রাস্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নারীদের ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া ] হয় । বাংলাদেশ ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে কৃষি ও এসএমই (Small and Middle Enterprise) ঋণ বিতরণে তাদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এই স্কীমের আওতায় নারী উদ্যোক্তাদের ১০% সুদে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত গ্যারান্টির বিপরীতে পঁচিশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে । ২০১৪-১৫ সালে এই স্কীমের আওতায় নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৩,৯৬৭.৯২ কোটি টাকা এসএমই ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে ।
একবিংশ শতকের শুরুতেই মানুষের জীবনে যে ব্যাপক পরিবর্তন ও অভিনবত্বের জন্ম নিয়েছে এবং যার প্রভাবে সারা বিশ্ব আজ বৈশ্বিক গ্রাম (Global village) এ পরিণত হয়েছে তার মূলে রয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। আজ থেকে বিশ বছর আগেও এতটা পরিবর্তন হবে মানুষ ভাবতে পারেনি। কিন্তু তা-ই ঘটেছে। ভবিষ্যতে এ পরিবর্তন যে আরও দ্রুতশীল হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ প্রযুক্তির উচ্ছাসে ভাসছে এখন সমগ্র বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি। E-Business, E-Commerce, E-Marketing, E-Retailing এ ভাবে নতুন নতুন পরিভাষায় সিক্ত হচ্ছে ব্যবসায় জগত। হাতের ছোট মোবাইল সেটটিই হয়তোবা ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে সকল যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র । তাই এরূপ প্রযুক্তি সম্পর্কে আমাদের আগামী প্রজন্মকে অবশ্যই ধারণা দিতে হবে। আগামী দশকগুলোর জন্য তাদেরকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। সেজন্যই ব্যবসায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়টি ব্যবসায় পরিচিতি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আশা করা যায় এতে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতে পারবে।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে শিক্ষার্থীরা (শিখন ফল)
১. ব্যবসায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ধারণা ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারবে
২. ব্যবসায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাখ্যা করতে পারবে
৩. অনলাইন ব্যবসায় ধারণা, গুরুত্ব ও পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে পারবে
8. ই-কমার্স এর ধারণা ও পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে পারবে
৫. ই-বিজনেস এর ধারণা ও পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে পারবে
৬. ই-মার্কেটিং এর ধারণা, গুরুত্ব ও পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে পারবে
৭. ই-রিটেইলিং এর ধারণা, পদ্ধতি ও সুবিধা ব্যাখ্যা করতে পারবে
৮. ই-ব্যাংকিং এর ধারণা, পদ্ধতি ও সুবিধা ব্যাখ্যা করতে পারবে
৯. ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড এর ধারণা ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারবে
১০. মোবাইল ব্যাংকিং এর ধারণা ও এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবে
মি. আতিয়ার একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োজিত রয়েছেন। তিনি তার ব্যাংকে নতুন ব্যাংকিং সেবা পরিবেশনে যত্নশীল। এখন তার গ্রাহকগণ ব্যাংকের যে কোনো শাখায় টাকা জমাদান ও উত্তোলন করতে পারেন ।
মি. সামদানি গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে পাঁচটা বড় বড় গার্মেন্টস কারখানা গড়ে তুলেছেন। তিনি বনানী অফিসে বসেন। প্রতিদিন সকালে অফিসে যেয়েই প্রতিটা ফ্যাক্টরির দিনের কর্ম পরিকল্পনা কম্পিউটারের মাধ্যমে দেখে নেন। সব শ্রমিক-কর্মী অফিসে এসেছে কি না, নির্ধারিত সময়ের পরে কতজন এসেছে- তার তথ্যও কারখানার ওয়েবসাইটে যেয়ে চোখ বুলিয়ে নেন । কাজ কেমন চলছে সেটাও তার অফিসে বসেই ভিডিও ফ্রীনে দেখেন। কোনো নির্দেশনা দেয়ার থাকলে কারখানা ম্যানেজারকে ই-মেইল করেন। মোবাইলে কথা বলেন। এরপর শিপমেন্ট-এর অবস্থা নিয়ে C&F এজেন্টের সাথেও আলাপ করেন। তাদের পাঠানো Message গুলো কম্পিউটারে পড়েন । বন্দরে তার মালের শিপমেন্ট কোন পর্যায়ে তাও বন্দর কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে যেয়ে জেনে নিশ্চিত হন। বিদেশী ক্রেতা বায়িং হাউজগুলোর সাথে ই-মেইল, ভয়েস মেইল ইত্যাদির মাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদান হয় । মাঝে-মধ্যেই সব কারখানার ম্যানেজারদের সাথে অডিও কনফারেন্স, ভিডিও কনফারেন্স করেন। বাসায় ফিরতে গাড়িতে বসেই প্রতিটা কারখানার উৎপাদন কী হলো, পরবর্তী দিনের ওয়ার্ক প্লান ও শিপমেন্টে কী যাচ্ছে তা ল্যাপটপে বাটন টিপেই জানতে পারেন। এত কাজ করা মি. সামদানির পক্ষে সম্ভব হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবাদেই ।
উপাত্ত সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ইত্যাদির পাশাপাশি ইন্টারনেট প্রযুক্তির সাহায্যে তথ্যের দ্রুত আদান-প্রদান ও যোগাযোগ স্থাপনের প্রযুক্তিকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বলে । এর দু'টি অংশ- একটি তথ্য প্রযুক্তি ও অন্যটি যোগাযোগ প্রযুক্তি। তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও বিতরণ সংশ্লিষ্ট আধুনিক কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থাকে তথ্য প্রযুক্তি বলে। কম্পিউটার নির্ভর ডাটাবেজ তৈরি, সফটওয়ার কেন্দ্রিক তথ্যের ইনপুট ও আউটপুট ব্যবস্থা, তথ্যের প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে নানামুখী উপস্থাপন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনে দ্রুত তথ্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করতে তথ্য প্রযুক্তি অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে। তথ্য প্রযুক্তির এই অভিনব যাত্রা এখানেই থেমে থাকেনি । এই প্রযুক্তির সাথে যোগাযোগ প্রযুক্তি বা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের সম্পর্ক ঘটায় দ্রুত তথ্যের আদান-প্রদানে ও পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে। ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট ইত্যাদি।
প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় এখন তথ্য প্রাপ্তি ও যোগাযোগের এতটাই উন্নতি ঘটেছে যে, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের মানুষকে টেলিফোনে ডায়াল করে নিমিষেই কথা বলা যাচ্ছে । তথ্য পাঠানো যাচ্ছে, তথ্য জানানো যাচ্ছে । ই- মেইল ও ভয়েস মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করা যাচ্ছে । চাইলে পৃথিবীর যে কোনো টেলিভিশন চ্যানেল দেখা যাচ্ছে । অডিও কনফারেন্সিং, ভিডিও কনফারেন্সিং করা যাচ্ছে। ওয়েব সাইটে যেয়ে যে কোনো তথ্য মূহুর্তে সংগ্ৰহ করা সম্ভব হচ্ছে । ইন্টারনেটে রেল, বিমান, যানবাহন, হোটেল ইত্যাদির বুকিং দেয়া যাচ্ছে । কম্পিউটারে বসে বিশ্বের বড় বড় লাইব্রেরির যে কোনো বই খুলে পড়া সম্ভব হচ্ছে। সমগ্র বিশ্ব একটা বৈশ্বিক গ্রাম (Global village) এ পরিণত হয়েছে। তাই সারাবিশ্বই এখন কার্যত একটা কম্পিউটারে বা ল্যাপটপে অথবা হাতে ধরে রাখা মোবাইলের মধ্যেই সীমিত হতে চলেছে বললেও অত্যুক্তি হবে না।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT) হলো তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থার সম্প্রসারিত রূপ। যেখানে উপাত্ত (Data) সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, পরিবর্তন-পরিবর্ধন ইত্যাদির পাশাপাশি ইন্টারনেট নির্ভর যোগাযোগ প্রযুক্তির ১৩ সাহায্যে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে কোনো মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের সাথে দ্রুত তথ্যের আদান-প্রদান ও যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। তাই ICT এর সাথে একদিকে যেমনি // সম্পর্কিত যন্ত্রপাতি; যেমন- কম্পিউটার, সফট্ওয়্যার, হার্ডওয়্যার ও এতদসংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ও উপকরণাদি সম্পৃক্ত তেমনি যোগাযোগের প্রয়োজনে মডেম, টেলিফোন, সেলুলার ফোন, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, রেডিও ভয়েস, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদিও সম্পর্কযুক্ত। যে কারণে তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ও উপকরণাদির সমন্বিত রূপকেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ব্যবসায়ের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রভাব পড়েনি। অনলাইন ব্যবসায়, ই-বিজনেস, ই-কমার্স, ই-মার্কেটিং, ই-রিটেইলিং, ই- ব্যাংকিং, ই-টিকেটিং ইত্যাদি পরিভাষা এখন ব্যবসায় মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এছাড়া ICT সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় এখন খাত হিসেবে অন্যতম বড় ব্যবসায় । তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্ততিতে বর্তমানকালে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে GSM প্রযুক্তি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ১৯৮২ সালে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি Group Special Mobile (GSP) যার বর্তমান নামকরণ করা হয়েছে Global System for Mobile Communication ব্যবসায় ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কো- ব্যবহার্য ICT প্রযুক্তি।
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থার প্রয়োগকে ই-ব্যবসায় বলে । যখন আমরা ই-ব্যবসায়, ই-বাণিজ্য, ই- খুচরা ব্যবসায় বলি তখন মনে হয় ব্যবসায় বাণিজ্যের ধ্যান-ধারণাতেই পরিবর্তন ঘটেছে কি না । বাস্তবে বিষয়টি তেমন নয় । ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবসায়ের হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি, যোগাযোগ পদ্ধতি, তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি ইত্যাদিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে, এখানে ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্যাবলির কোনো পরিবর্তন ঘটেছে। মুনাফার্জনের উদ্দেশ্যে আছে, ক্রেতা-বিক্রেতা আছে, উৎপাদন ও উপযোগ সৃষ্টির কাজ বিদ্যমান । ব্যাংক, বিমা, পরিবহণ, গুদামজাতকরণ, বিজ্ঞাপন, মোড়ককরণ, ঝুঁকি গ্রহণ-এর সবই রয়েছে। আগে বিভিন্ন রেজিস্টারে প্রয়োজনীয় তথ্য ও হিসাব লিখে রাখা হতো যা এখন কম্পিউটারে সংরক্ষিত থাকে। কোনো হিসাব বা তথ্য কারও কাছে পাঠানো দরকার। আগে রেজিস্টার বহি পাঠানো হতো । এখন দরকার হয় না। ই-মেইল ব্যবস্থায় বাটন টিপে মূহুর্তে তথ্য সবার কাছে পৌঁছানো যায় । আগে ফরমায়েশ লিখে ডাকে পাঠানো হতো এখন তার প্রয়োজন হয় না। ই-মেইল বা ইলেক্ট্রনিক অন্য কোনো ব্যবস্থায় সরবরাহ চেইন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় । আগে বিদেশে পণ্যের ফরমায়েশ দিতে ও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের নানান কাজে অনেক সময় যেতো। এখন সরবরাহ প্রতিষ্ঠান বা উৎপাদকের ওয়েব পেজে যেয়ে তথ্য জানা যাচ্ছে। ওয়েব পেজগুলো এমনভাবে সাজানো হচ্ছে যেখানে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যও একত্রে পাওয়া যাচ্ছে। ক্রেতা বা গ্রাহক আগে দোকানে যেয়ে দেশে শুনে পণ্য কিনতো। এখন আর তার প্রয়োজন হয় না, বাসায় বসে ইন্টারনেটেই ফরমায়েশ দিয়ে ও একই উপায়ে মূল্য পরিশোধ করে শপিং সেরে নেয়া হচ্ছে । তথ্য প্রযুক্তির ফলে ব্যবসায়ে যতই পরিবর্তন ঘটুক পরিবহণের ও গুদামের প্রয়োজন কিন্তু রয়েই গেছে । তাই ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তি তথা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবসায়ের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বহুমাত্রিক পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়েছে । আজকে বলতে যেয়ে ব্যবসায়ের ধরন, কার্যত যোগাযোগের ধরনকে নির্দেশ করছে। যেমন, আমরা বলছি B2B ব্যবসায় (ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ীর মধ্যকার ব্যবসায় / পাইকারি), B2C ব্যবসায় (ব্যবসায়ের সাথে ভোক্তা বা ব্যবহারকারীর ব্যবসায় / খুচরা), B2G (ব্যবসায়ের সাথে সরকারের ব্যবসায়) ইত্যাদি ।
মি. আলী বেড়াতে যাবেন। বিমানের টিকেট, হোটেল বুকিংসহ অনেক কাজ কম্পিউটারে বসে আর ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে সেরেছেন। অর্থাৎ বিমান কোম্পানি, হোটেল কোম্পানি এভাবে বিভিন্ন ব্যবসায় এখন ICT নির্ভর। মি. চৌধুরী ব্যাংকে যান। One stop service। একজন ব্যাংক কর্মী চেক পাওয়ার পর কম্পিউটারে মি. আলীর হিসাবে যেয়ে দ্রুত পোস্টিং দিয়ে এক মিনিটেই টাকা দিয়ে দিচ্ছেন। ATM (Automated teller machine) বুথে যেয়ে নিজেই টাকা উঠাচ্ছেন। বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান Walmart তাদের মালামাল সংগ্রহে ফরমায়েশ দেয়ার পদ্ধতি বাদ দিয়েছে। কোনো মাল বিক্রয় হওয়ার সাথে সাথে সরবরাহকারীর সার্ভারে তথ্য উঠে যাচ্ছে। ফলে নির্দেশিত পর্যায়ে গেলেই সে মাল সরবরাহ করছে। এখন ব্যবসায়ে স্টক রেজিস্টার লাগে না, হিসাবের খাতা • নেই- সব কম্পিউটারে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবাদে ব্যবসায় ও ব্যবসায় কার্যক্রম এক নতুন রূপ লাভ করেছে । কত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায় এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে । এর সব কিছুই এর প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্বের দিক নির্দেশ করে। নিম্নে ব্যবসায়ে এর প্রয়োজনীয়তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
যেখানে ই-মেইল করে মুহূর্তে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে তথ্য পৌঁছানো সম্ভব তখন কে চিঠি লিখে ডাকে ফেলে অপেক্ষা করতে চায়? একটা কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের মধ্যে যখন তথ্য ভাণ্ডার সংরক্ষণ করা যায়, মুহূর্তে যে কোনো তথ্য বের করা যায়- তখন কে কাগজ আর ফাইলের স্তুপ অফিসে সংরক্ষণ করে তা ঘাটাঘাটি করতে পছন্দ করে? ইন্টারনেট ব্যবস্থায় ওয়েবসাইটে যেয়ে যখন প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বশেষ তথ্য মুহূর্তে জেনে নেয়া যায়, সিদ্ধান্ত নেয়া যায়- তখন কে নিজেকে ঐ প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখবে? প্রযুক্তির সুবাদেই যেখানে সকল তথ্য পাওয়া যায়, দেখা যায়, লেনদেন করা যায় তখন যে কোনো সচেতন মানুষ তার ব্যবহার করবে এটাই স্বাভাবিক । দূরে বসে যখন অডিও কনফারেন্স ও ভিডিও কনফারেন্স করা যায় তখন ব্যস্ত মানুষগুলোর সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে সামনা সামনি বসে সভা করার তেমন প্রয়োজন থাকে না । তাই ব্যবসায়ের এমন কোনো দিক নেই যেখানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে না । নিম্নে ক্ষেত্রগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
১. কল-কারখানায় ব্যবহার (Use in factory) : কল-কারখানায় বৃহদায়তন উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করেছে। মজুদ ব্যবস্থাপনা, পণ্যমান নিয়ন্ত্রণ, উপকরণের যথাযথ ব্যবহার, অপচয় হ্রাস, শ্রমিক-কর্মীদের তথ্য সংরক্ষণ, হাজিরা নিয়ন্ত্রণ, বেতন-ভাতা প্রদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরূপ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়, বিক্রেতা, প্রতিনিধি, ডিলার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ, তথ্য প্রদান, লেনদেন ইত্যাদির ক্ষেত্রেও এরূপ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয় ।
২. বিক্রয়ধর্মী প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার (Use in trading organization) : বিক্রয়ধর্মী প্রতিষ্ঠানের পণ্য সংগ্রহ ও বিক্রয়ে এরূপ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়। এরূপ প্রতিষ্ঠানের পণ্যের ক্যাটালগ, মূল্য তালিকা, শর্তাদিও ওয়েবসাইট তথা ভার্চুয়্যাল স্টোর (এমন সদৃশ স্টোর যা সপ্তাহের সাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে) এ দেয়া পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে বা নিকটস্থ এজেন্টের নিকট থেকে সংগ্রহ করতে বলা হচ্ছে। মূল্য হ্রাস বা কোনো অফার ওয়েবসাইটে বা ওয়েবপেজে দেয়া হচ্ছে। ডিপার্টমেন্ট স্টোরে কোনো পণ্যের মূল্য কত তা দ্রুত নির্ধারণ করে। মূল্য পরিশোধেও এ প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে । মজুদ নিয়ন্ত্রণ, হিসাব রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন কাজে এরূপ প্রতিষ্ঠান এ ধরনের প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল ।
৩. ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার (Use in bank & other financial institutions) : ব্যাংকে ICT এর ব্যবহার এতটাই দৃশ্যমান যে আজকের ব্যাংক ব্যবস্থা কার্যত এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তথ্য সংরক্ষণ, ব্যবহার ও লেনদেনের সকল পর্যায়েই এ প্রযুক্তি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করছে । সঠিক ও নির্ভুল লেনদেনে এবং গ্রাহকদের দ্রুত ও উন্নত সেবা দিতে এ প্রযুক্তি অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। অনলাইন ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক ফাও ট্রান্সফার, হোম ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড-এ ভাবে নানান সেবা ব্যাংক ব্যবস্থাকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করেছে।
৪. আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যবহার (Use in import and export business) : আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে তথ্যাদি অনুসন্ধান, ফরমায়েশ প্রদান, দলিল-পত্রাদি হস্তান্তর, শুল্ক সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা পালন, মূল্য পরিশোধসহ সকল ক্ষেত্রেই ICT -এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। ইলেক্ট্রনিক ক্যাটালগ, ই-মেইল, ভয়েস মেইল, ইন্টারনেট সেবা, ফ্যাক্স ইত্যাদি ICT সেবার মাধ্যমে এর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীগণ খুবই স্বল্প সময়ে একদেশ থেকে অন্যদেশে পণ্য সরবরাহ করতে পারায় ও লেনদেন সম্পন্ন হওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
৫. পর্যটন শিল্পে ব্যবহার (Use in tourism industry) : পর্যটন শিল্পেও ICT এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়। পর্যটকদের আগ্রহী করতে বিভিন্ন তথ্য ওয়েবসাইটগুলোতে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন আকর্ষণীয় অফার প্রদর্শিত হচ্ছে। ই-টিকেটিং এর সুবাদে বিমান, রেল, বাসসহ সকল যানবহনের টিকেট সহজেই কাটা হচ্ছে। হোটেল রিজার্ভেশনসহ সব কাজ এ প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত আগাম সেরে নেয়া সম্ভব হচ্ছে। পর্যটন স্থানগুলোর অধিক নিরাপত্তা বিধান এবং পর্যটকদের অধিক সেবা প্রদানও এর ফলে সম্ভব হচ্ছে। ফলে পর্যটন শিল্প বিগত দশকগুলোতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছে।
৬. পরিবহণ শিল্পে ব্যবহার (Use in transport industry) : আকাশ, জল ও স্থলপথে দ্রুত ও নিরাপদে যাত্রী, ও পণ্য পরিবহণে ICT এর ব্যবহার অভাবনীয় । যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ, ট্রাফিক কন্ট্রোলিং, টিকেট বুকিং, সিডিউল নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এরূপ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। বিমান পরিচালনায় ফ্লাইং, ল্যান্ডিং, বোর্ডিং কার্ড প্রদান, ইমিগ্রেশন, ফ্লাইট কন্ট্রোল, টিকেট বিক্রয় সবকিছুই এর মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। রেল পরিবহণ ব্যবস্থাও এখন এরূপ প্রযুক্তির আওতাধীন। স্টেশনে থাকা, স্টেশন ত্যাগ, সিগন্যালিং সিস্টেমসহ কন্ট্রোলিং ব্যবস্থা এখন প্রযুক্তিনির্ভর । জলযানের ক্ষেত্রেও আবহাওয়া সংকেত, অবস্থান নির্ণয়সহ সকল কাজেই ICT সহযোগিতা করছে ।
৭. দুর্ঘটনা হ্রাসে সহায়তা (Help in reducing accident) : মানবীয় ভুল দুর্ঘটনার একটা বড় কারণ । চালক যখন ঘুমায় ও ভুল করে তখন দুর্ঘটনা ঘটে। ব্যাংক কর্মী যখন অসতর্ক হয় বা ইচ্ছাকৃত কোনো অপরাধ করে তখন দুর্ঘটনার কারণ সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রযুক্তি ঘুমায় না, ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করতে পারে। অপরাধ প্রবণতা থেকে মুক্ত। উন্নত বিশ্বে এরূপ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার পরিবহন সেক্টরে দুর্ঘটনার মাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনতে সাহায্য করেছে । সাইবার ক্রাইমের মত কিছু ঘটনা ঘটলেও ব্যাংকসহ সর্বত্রই আর্থিক লেনদেন এরূপ প্রযুক্তির সুবাদে অনেক নির্ভুল ও নিরাপদ হয়েছে ।
৭. শেয়ার, বিল ও বন্ড বাজারে ব্যবহার (Use in share, bill & bond market): শেয়ার, বিল ও বন্ড বাজারে এর সংশ্লিষ্ট ক্রয়-বিক্রয়ে ICT এর ব্যাপক ব্যবহার এ ব্যবসায়কে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে । নিউইয়র্ক, লণ্ডন, টোকিও ইত্যাদি বড় বড় শেয়ার ও বন্ড বাজার থেকে বাংলাদেশের যে কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত নিয়মে শেয়ার ও বন্ড ক্রয়-বিক্রয় করতে পারছে এরূপ প্রযুক্তির কারণেই । মোবাইলেই এ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে মূল্য পরিশোধসহ সবকিছুই এরূপ প্রযুক্তি করে দিচ্ছে। এজেন্ট বা ব্রোকাররা এরূপ প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রাহকদের এ সংক্রান্ত সকল লেনদেন সম্পাদন ও তথ্য সংরক্ষণের কাজ নির্ভুলভাবে দ্রুত করতে পারছে।
উপরোক্ত শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সেবা বিক্রয়ধর্মী সকল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান; যেমন- স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসেবা, বিনোদন সেবা, হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ সর্বত্রই ICT এর ব্যাপক প্রয়োগ সামগ্রিক ব্যবসায় প্ররিস্থিতিকেই উন্নত, সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করেছে। যার সহযোগিতা ব্যতিরেকে ব্যবসায় পরিচালনার চিন্তায় কার্যত এখন অসম্ভব ।
নেটওয়ার্কের আওতায় কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত ও কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত চলমান ব্যবস্থার অধীন ব্যবসায়কেই অনলাইন ব্যবসায় বলে। কেন্দ্রীয় সার্ভারের আওতায় ব্যাংকের শাখাসমূহের মধ্যে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে এক শাখার চেকের অর্থ অন্য শাখায় প্রদান বা অর্থ জমা গ্রহণের কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থাকে আমরা অনলাইন ব্যাংকিং বলি। এভাবে একজন ব্যবসায়ী আরেকজন ব্যবসায়ীর সাথে, ব্যবসায়ী গ্রাহকের সাথে, গ্রাহক গ্রাহকের সাথে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে ব্যবসায় পরিচালনা করলে তাকে অনলাইন ব্যবসায় বলা হয়ে থাকে । অনলাইন ব্যাংকিং এর বাইরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনলাইন ব্যবসায় নিম্নে তুলে ধরা হলো:
অনলাইন ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে মূল্য পরিশোধের বিষয়ে অনলাইন পেমেন্টের ব্যবস্থা থাকে । ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (EFT) এক্ষেত্রে সহায়তা করে। হোম ব্যাংকিং এর মাধ্যমে অনলাইনে ফান্ড ট্রান্সফার করা যায় ।
ইন্টারনেট প্রযুক্তিতে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পণ্য, সেবা ও তথ্য বণ্টন তথা ক্রয় বিক্রয়, হস্তান্তর বা বিনিময় কার্যকেই ই-কমার্স বলা হয়ে থাকে । ই কমার্স মূলত বিক্রয়ের স্বার্থে প্রতিষ্ঠানের বাইরের বিভিন্ন পক্ষ; যেমন- ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সহযোগী অংশীদার ইত্যাদির সাথে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT) ব্যবহারের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন ও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে এবং পণ্য ও সেবা বিক্রয় ও সরবরাহের ব্যবস্থা করে। ফরমায়েশের আলোকে পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বেলায় পণ্য উৎপাদনও ই কমার্সের অন্তর্ভুক্ত বিবেচিত হয় । ই-বিজনেস (E-Business) এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ (Subset) হলো ই-কমার্স ।
ই-ব্যবসায় যেখানে ব্যবসায়ের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের বিভিন্ন পক্ষের সাথে যোগাযোগ, ক্রয়-বিক্রয় হস্তান্তর ইত্যাদি বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করে তখন ই কমার্স ক্রয়-বিক্রয় সংশ্লিষ্ট বাইরের বিভিন্ন পক্ষের সাথে ICT নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা (B2B, B2C, P2P (P=Business Partner), C2C) গড়ে তুলে ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তর কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে ব্যাপৃত থাকে। ই কমার্সের অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ হলো-
ইন্টারনেট মার্কেটিং (Internet marketing);
মোবাইল বাণিজ্য (Mobile commerce);
ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (EFT);
সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমন্টে (Supply chain management);
অনলাইন লেনদেন প্রক্রিয়াকরণ (Online transaction processing);
ইলেক্ট্রনিক তথ্য বিনিময় (Electronic data interchange);
মজুদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (Inventory management system) ও
স্বয়ংক্রিয় তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা (Automated data collection system)।
ই-কমার্সের ক্ষেত্রে অনলাইন যোগাযোগ ও চুক্তি সম্পাদনের সাথে মূল্য পরিশোধ ও পণ্য সরবরাহের বিষয় দুটি গুরুত্বপূর্ণ । মূল্য পরিশোধে ইলেকট্রনিক পেমেন্ট সিস্টেম (EPS) ব্যবহৃত হয় । এক্ষেত্রে অনলাইন ব্যাংকিং, হোম ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক ক্যাশ, ইলেক্ট্রনিক চেক, স্মার্ট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ইত্যাদি পদ্ধতি চালু রয়েছে। পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে নিজস্ব পরিবহনে ক্রেতার নিকট পণ্য প্রেরণ, আঞ্চলিক পরিবেশকের মাধ্যমে সরাসরি পণ্য সরবরাহ বা পরিবেশকের মাধ্যমে পার্শ্বেল করে পণ্য প্রেরণ করা যেতে পারে ।
ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দক্ষতার সাথে মার্কেটিং কার্যক্রম পরিচালনাকেই ই-মার্কেটিং বলে । মার্কেটিং হলো গ্রাহকদের চাহিদা যথাযথভাবে চিহ্নিত্বপূর্বক পণ্য ও সেবাসামগ্রী তাদের নিকট পৌছানোর সর্ববিধ কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে গ্রাহকদের সন্তুষ্টি অর্জনের পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জন সম্ভব হয় । ওয়েব, ই- মেইল, ডাটাবেজ, ডিজিটাল টেলিফোন, টেলিভিশন ইত্যাদি ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে মার্কেটিং কার্য সম্পাদন ও সেবা প্রদান এর লক্ষ্য ।
ই-মার্কেটিং ই-বিজিনেস এর একটা উপশাখা (Subset)। ব্যবসায়ের উৎপাদন, বন্টন, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিভিন্ন পক্ষের সাথে যোগাযোগ, ব্যবসায়িক তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, বিতরণ সকল ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ই-বিজনেস হিসেবে গণ্য। অন্যদিকে গ্রাহকদের চাহিদা শনাক্তকরণ, এজন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ, গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ, মার্কেট Place শনাক্ত করে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন ধরনের বিপণন প্রসার কার্যক্রম গ্রহণ, এজন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কৌশল নির্ধারণ, বিভিন্ন ধরনের বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ই-মার্কেটিং কাজ করে । ই মার্কেটিং বিশেষভাবে গ্রাহক সম্পর্কিত । পণ্য কিভাবে আসবে বা সরবরাহ Chain কী হবে এ বিষয়ে ই-মার্কেটিং ততটা সম্পৃক্ত নয় ।
ব্যবসায়ের বিজনেস স্ট্রাটিজির সাথে ই-মার্কেটিং পরিকল্পনার সম্পর্ক নিম্নে রেখাচিত্রের সাহায্যে দেখানো হলো
ই-রিটেইলিং হলো ই-কমার্স তথা ই-বিজিনেসের একটা বিশেষ রূপ বা ধরন যেখানে কোনোরূপ মধ্যস্থ ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা ছাড়াই সরাসরি ইন্টারনেটের মাধ্যমে খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকদের পণ্য বা সেবা ক্রয়ের সুযোগ প্রদান করা হয় । ই-রিটেইলিংকে e-shop, e-store, Internet shop, Web shop, Web store, Online store, Virtual store, e-terling ইত্যাদি নামেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে । একজন গ্রাহক দোকানে যেয়ে দেখেশুনে মূল্য যাচাই করে যেভাবে পণ্য ক্রয় করে এবং মূল্য পরিশোধ করে পণ্য নিয়ে আসে, ই-রিটেইলিং এর ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন হয় না । এক্ষেত্রে ক্রেতা ইন্টারনেটে দোকানের ওয়েব সাইটে যেয়ে পণ্য ও মূল্য তালিকা সার্চ করে । অনেক সময় একই ধরনের পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সম্মলিতভাবে ওয়েব পেজ খুলে গ্রাহকদের পণ্য ও মূল্য বিষয়ে তুলনা করার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দেয় ।
অতঃপর সে যে প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনতে আগ্রহী তাদের নিকট ইন্টারনেটে ফরমায়েশ দেয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে অর্থাৎ ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ই-চেক, ই-মানি ইত্যাদির মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করে । অতঃপর সরাসরি পণ্য গ্রাহকদের ঠিকানায় নিজস্ব গাড়িতে করে বা পার্শ্বেলের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয় । অনেক সময় স্থানীয় কোনো চেইন স্টোর থেকে তা সরবরাহ করা হয়ে থাকে । ক্রেতাদের ব্রান্ড আনুগত্যের কারণে এখন আর পণ্য দেখে শুনে কেনার তেমন প্রয়োজন পড়ে না । ফলে উন্নত দেশগুলোতে ভোক্তা পর্যায়ে কেনা-বেচায় রিটেইলিং হাউজগুলোতে ই-রিটেইলিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এতে বিপণন প্রতিষ্ঠানে ভিড় যেমনি কমেছে তেমনি জনশক্তির প্রয়োজনীয়তাও হ্রাস পেয়েছে । একদিকে গ্রাহকদের সময় ও শ্রমের সাশ্রয় হচ্ছে অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচের পরিমাণও কমছে। ২০১২ সালের খুচরা পর্যায়ের (B2C) কেনা-বেচায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮% বিক্রয় ই-রিটেইলিং পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়েছে। যার অর্থমূল্য ছিল ১৪২.৫ বিলিয়ন ডলার । ২০১২ সালে চীনে ২৪.২ কোটি লোক অনলাইনে শপিং করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ই রিটেইলিং পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি বিক্রয়যোগ্য পণ্য ও সেবা হলো ভ্রমণ সংক্রান্ত বুকিং, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার এন্ড সফটওয়্যার, ভোক্তা পর্যায়ে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক সামগ্রী, অফিস সামগ্রী, খেলাধুলা ও শরীরচর্চা সামগ্রী, বই, ম্যাগাজিন, সংগীত সামগ্রী, খেলনা, স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যবর্ধক সামগ্রী, পোশাক ও কাপড় চোপড়, জুয়েলারি সামগ্রী, গাড়ি, ইলেকট্রনিক সেবা (ই-ব্যাংকিং ও অন্যান্য) ইত্যাদি ।
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং পদ্ধতি হলো ব্যাংকিং সেবা সুবিধা প্রদানের আধুনিক কৌশল বা পদ্ধতি । এটি এমন এক ধরনের ব্যাংকিং সেবা পদ্ধতি যেখানে উন্নততর ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অতিদ্রুত, নির্ভুল এবং ব্যাপক বিস্তৃত সেবা প্রদান সম্ভব। এ ধরনের ব্যাংকিং পদ্ধতি সনাতন, প্রথাগত, কায়িক শ্রমনির্ভর, সীমিত সেবাসম্বলিত, মন্থর, কাগজ ও নথির জমাকৃত স্তুপের সেকেলে ব্যাংকিং পদ্ধতির অবসান ঘটিয়েছে ।
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং বিশারদ এইচ. লিপিস এর মতে, Electronic banking systems are electronic systems that transfer money and record data relating to these transfer." অর্থাৎ ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং হলো এমন যেখানে ইলেকট্রনিক পন্থায় অর্থ স্থানান্তর করা হয় এবং এরূপ স্থানান্তর সংক্রান্ত তথ্যাবলি একই পদ্ধতিতে লিখে রাখা হয়। তিনি আরও বলেছেন, "Electronic banking services are developing tools in the overall banking services delivery system." অর্থাৎ ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং সেবা হলো সার্বিক ব্যাংকিং ডেলিভারি সেবা ব্যবস্থার উন্নততর পদ্ধতি ।
ইলেকট্রনিক ব্যাংকের সেবা সুবিধাসমূহ হলো নিম্নরূপ :
১. স্বয়ংক্রিয় গণনা যন্ত্র (Automated Teller Machine / ATM);
২. ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড;
৩. অন-লাইন ব্যাংকিং;
৪. হোম ব্যাংকিং;
৫. মোবাইল ব্যাংকিং
৬. বিক্রয় বিন্দু (Point of Sales / POS) সেবা;
৭. স্বয়ংক্রিয় নিকাশঘর (Automated clearing House /ACH) সেবা;
৮. আন্তঃব্যাংক নিকাশঘর পরিশোধ পদ্ধতি ইত্যাদি ।
উপসংহারে বলা যায়, ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং হলো ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অত্যাধুনিক তড়িৎবাহী পদ্ধতি যেখানে কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহার করে অতিদ্রুত নির্ভুলভাবে সম্প্রসারিত ব্যাংকিং সেবা সুবিধা প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে অর্থ উত্তোলন, সংগ্রহ, স্থানান্তর, লেনদেন সম্পন্নকরণ, তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদান, যোগাযোগ ইত্যাদি কাজ ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সম্পাদিত হয় ।
ATM কার্ড দু'ধরনের হয়; ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড । তহবিল থেকে অর্থ উত্তোলন ও ফান্ড ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ব্যৱস্থানির্ভর ডেবিট কার্ড একটা অন্যতম পদ্ধতি । এটি চুম্বকীয় শক্তিসম্পন্ন সাংকেতিক নম্বরযুক্ত এবং গ্রাহকদের ছবি ও অন্যান্য তথ্য সম্বলিত এক ধরনের প্লাস্টিক কার্ড । এক্ষেত্রে প্রত্যেক গ্রাহকের আলাদা PIN (Personal Identification Number) থাকে। যা ব্যবহার করে এর গ্রাহক ATM বুথ থেকে টাকা উত্তোলন ও ফান্ড ট্রান্সফার করতে পারে । আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো এ বুথ থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পর্যন্ত একবারে উঠানোর সুযোগ দেয় । সাধারণত ২৪ ঘণ্টায় দুইবার এরূপ কার্ড ব্যবহার করে ATM বুথ থেকে টাকা উত্তোলন করা যায় । গ্রাহকের হিসাবে ডেবিট জের (Balance) থাকলেই শুধুমাত্র এরূপ কার্ড ব্যবহার করা যায় বিধায় একে ডেবিট কার্ড বলা হয়ে থাকে । ক্রেডিট কার্ডে যেভাবে নির্দিষ্ট বিপণি থেকে পণ্য ও সেবা ক্রয় সুবিধা লাভ করা যায় ডেবিট কার্ডের বেলায়ও তা সম্ভব। এ ছাড়া বিভিন্ন সেবা সুবিধা (Utility charge)-এর বিল এবং ঋণের ও প্রিমিয়ামের কিস্তি সহজেই প্রদান করা সম্ভব হয় । এরূপ কার্ড সুবিধার কারণেই ই রিটেইলিং, ই- টিকেটিং ইত্যাদি কাজ সহজ হয়েছে । আমাদের দেশে এখন বিভিন্ন ব্যাংক ডেবিট কার্ড সরবরাহ করে ।
নির্দিষ্ট মার্চেন্ট প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য ও সেবা ক্রয়ে ক্রেডিট কার্ড একটা বহুল ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক সেবা পদ্ধতি । এরূপ কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহককে ক্রেডিট বা ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয় বিধায় তা ক্রেডিট কার্ড নামে পরিচিত । এটিএম বুথ থেকে অর্থ উত্তোলনেও ডেবিট কার্ডের ন্যায় এই কার্ড ব্যবহার করা যায় । অধুনা বিভিন্ন ব্যাংক ঋণ গ্রহণের সামর্থ্য রয়েছে এমন মর্যাদাবান গ্রাহকদেরকে চুম্বকীয় শক্তিসম্পন্ন সাংকেতিক নম্বরযুক্ত এবং গ্রাহকদের ছবি ও অন্যান্য তথ্য সম্বলিত এক ধরনের প্লাস্টিক কার্ড সরবরাহ করে । একজন গ্রাহককে কতটাকা পর্যন্ত Credit limit বা ঋণ সুবিধা দেয়া হবে তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় । এই ক্রেডিট সীমা বা সর্বোচ্চ অনুমোদিত ডেবিট ব্যালান্স-এর মধ্যে থেকে গ্রাহক নির্দিষ্ট দোকান বা প্রতিষ্ঠান (Merchant) থেকে পণ্য বা সেবা ক্রয়ের মূল্য পরিশোধ বাবদ তা বারবার ব্যবহার করতে পারে। ই-রিটেইলিং, ই-টিকেটিং এর জন্যও এরূপ কার্ড সহজে ব্যবহার করা যায় ।
তারবিহিন টেলিকম্যুনিকেশন ব্যবস্থায় মোবাইল হ্যান্ডসেট ব্যবহার করে ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, তথ্য সংগ্রহ, তথ্য প্রদান ও লেনদেন করাকেই মোবাইল ব্যাংকিং বলে। ব্যাংকের আর্থিক ও হিসাব সংক্রান্ত ডাটাবেজে ঢুকে দ্রুততার সাথে নিজের তথ্য বের করে আনার এবং অনুমোদিত লেনদেন করতে পারার এক চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করেছে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা । হোম ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের Pin (Personal Identification Number) ব্যবহার করে তথ্য জানা, ব্যাংক হিসাব বিবরণী সংগ্রহ ও সীমিত ফান্ড ট্রান্সফারের যে সুযোগ প্রচলিত রয়েছে তাকে আরও সহজতর করার জন্যই মূলত মোবাইল ব্যাংকিং এর উৎপত্তি ।
একজন গ্রাহককে এজন্য ব্যাংক প্রদত্ত ফরম পূরণ করে মোবাইল নম্বর প্রদান করতে হয় । অতঃপর এই মোবাইল নম্বর থেকে নির্দিষ্ট কোডের বিপক্ষে SMS (Short Message Service) করে সাথে সাথে তার হিসাবের ব্যালেন্স জানতে পারে । যা নতুন চেক কাটতে বা আর্থিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। সর্বশেষ কী লেনদেন হয়েছে তার তথ্যও সীমিত পরিসরে জানা যেতে পারে । এ ছাড়া SMS পাঠিয়ে বিল প্রদান ও ফাণ্ড অন্য কোনো হিসাবে স্থানান্তরের নির্দেশও দেয়া যায়। মোবাইল বিজিনেস (Mobile Business) বা M-Business এর ক্ষেত্রে মোবাইল হ্যান্ডসেটে ইন্টারনেট সংযুক্তির সুবাদে নির্দিষ্ট ওয়েবে যেয়ে যেভাবে ক্রয়সহ বিভিন্ন সার্ভিস গ্রহণ ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে লেনদেন করা যায় মোবাইল ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রে তার সুযোগ থাকে । বাংলাদেশে ২০১১ সালে ডাচ বাংলা ব্যাংক সর্বপ্রথম মোবাইল ব্যাংকিং সেবার প্রচলন করে । তাদের এ সেবা ‘মোবাইল ব্যাংকিং' নামে পরিচিত । পরবর্তীতে ব্রাক ব্যাংক bkash (বিকাশ) নামে এরূপ ব্যাংকিং সেবা চালু করে যা এখন দেশের সর্বত্র খুবই জনপ্রিয় । এছাড়া ইসলামী ব্যাংক এমক্যাশ, ইউসিবিএল ব্যাংক ইউক্যাশ এবং অন্যান্য কিছু ব্যাংক বিভিন্ন নামে এরূপ সেবা প্রদান করছে ।
উৎপাদন ও বণ্টন সংক্রান্ত ব্যবসায়িক সকল কার্যক্রমের সহায়তায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রয়োগকেই ই-বিজিনেস বলে। ই-কমার্সসহ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর কার্যক্রমই এর অন্তর্ভুক্ত । এর উদ্দেশ্য হলো গ্রাহকদের চাহিদা ও প্রত্যাশা যথাযথভাবে পূরণের লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ দক্ষতা ও নমনীয়তার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত করা । সেই সাথে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পক্ষের সাথে বাইরের সরবরাহকারী ও অন্যান্য সহযোগীরা যেন ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে তার সামর্থ্য সৃষ্টি করা। এটি ওয়েব, ইন্টারনেট, ইন্ট্রানেট ও এক্সট্রানেট বা এগুলোর সমন্বিত ব্যবস্থা ।
প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ধারণাকে পণ্য বা সেবায় পরিণতকরণ (Designing), পণ্য ও সেবা উৎপাদন (Producing), বিপণন (Marketing) এবং বিক্রয় পরবর্তী সেবা বা সাপোর্ট প্রদান (Rendering services and supports) কাজকে ফলপ্রদ করতে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ প্রযুক্তিগত সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য ই-বিজনেসের অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ হলো-
ই বিজনেসের ক্ষেত্রে এমন ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয় যাতে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে কর্মরত সকল জনশক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের বাইরের গ্রাহক, সহযোগী অংশীদার ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান (Stackholders) এর সাথে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে দ্রুত তথ্য বিনিময় ও যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা যায়। Amazon.com ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম সম্পূর্ণভাবে ই-বিজনেস পদ্ধতির প্রয়োগ করে বলে মনে হয় ।
উৎপাদক/সরবরাহকারী (Provider) এবং গ্রাহক/ভোক্তা (Client) বিবেচনায় ই-বিজনেস নিম্নোক্ত ধরনের হতে পারে:
ই-রিটেইলিং এ সাধারণত সরাসরি ভোক্তাদের নিকট (B2C) পণ্য বিক্রয় করা হয়ে থাকে। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি ভোক্তাদের 'পাশাপাশি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকেও পণ্য সরবরাহ করে থাকে (B2C & B2B)। Amazon.com তাদের প্রকাশিত বই B2C পদ্ধতিতে, তাদের প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান barnesandnoble.com তাদের প্রকাশিত বই B2C ও B2B পদ্ধতিতে বিক্রয় করে । বিশ্বখ্যাত খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান Walmart পরবর্তী পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে । সর্বপ্রথম ব্যবসায় ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ই-বিজনেস প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের নাম Amazon.com ।
সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের জ্ঞান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সেজন্য মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব । প্রত্যেক মানুষ নিজের জন্য নিজের সন্তান-সন্ততির জন্য ভালো কিছু প্রত্যাশা করে । যা তার অন্যের জন্যও করা বা চাওয়া উচিত । এখানেই সামাজিক দায়িত্ববোধ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রশ্ন । কোনো ব্যবসায়ী যখন জেনে-বুঝে পরিবেশ দূষণ করে, ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় তখন সে কতটা অনৈতিক ও অবিবেচকের মত কাজ করছে তা সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারে না; মুনাফা অর্জনই তার কাছে হয়ে ওঠে মুখ্য । ক'দিন আগে টেলিভিশনে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের এক অসুস্থ বৃদ্ধা মাকে দেখলাম । যিনি তার তিন যুবক সন্তান হারিয়েছেন একে একে । পরে মৃত্যুর কারণ জানা গেল । তারা ক্ষেতে কীটনাশক বিষ স্প্রের কাজ করতো । কিন্তু নাকে-মুখে কাপড় দিত না । এই বিষ শরীরে ঢুকে প্রত্যেকেরই ক্যান্সারে মৃত্যু ঘটেছে । তাই ঝুঁকিমুক্ত ভাবে নিজে বাঁচতে ও অন্যকে বাঁচাতে সবাইকে আরো সচেতন ও সতর্ক হতে হবে ।সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের জ্ঞান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সেজন্য মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব । প্রত্যেক মানুষ নিজের জন্য নিজের সন্তান-সন্ততির জন্য ভালো কিছু প্রত্যাশা করে । যা তার অন্যের জন্যও করা বা চাওয়া উচিত । এখানেই সামাজিক দায়িত্ববোধ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রশ্ন । কোনো ব্যবসায়ী যখন জেনে-বুঝে পরিবেশ দূষণ করে, ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় তখন সে কতটা অনৈতিক ও অবিবেচকের মত কাজ করছে তা সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারে না; মুনাফা অর্জনই তার কাছে হয়ে ওঠে মুখ্য । ক'দিন আগে টেলিভিশনে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের এক অসুস্থ বৃদ্ধা মাকে দেখলাম । যিনি তার তিন যুবক সন্তান হারিয়েছেন একে একে । পরে মৃত্যুর কারণ জানা গেল । তারা ক্ষেতে কীটনাশক বিষ স্প্রের কাজ করতো । কিন্তু নাকে-মুখে কাপড় দিত না । এই বিষ শরীরে ঢুকে প্রত্যেকেরই ক্যান্সারে মৃত্যু ঘটেছে । তাই ঝুঁকিমুক্ত ভাবে নিজে বাঁচতে ও অন্যকে বাঁচাতে সবাইকে আরো সচেতন ও সতর্ক হতে হবে ।
১. ব্যবসায়িক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারবে
২. ব্যবসায়িক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারবে
৩. ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতার ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারবে
৪. ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতে পারবে
৫. সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে পারবে
৬. ব্যবসায়িক কারণে পরিবেশ দূষণের প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারবে
৭. পরিবেশ সংরক্ষণে বণিক সমিতি/ব্যবসায় সংগঠনসমূহের দায়িত্ব বিশ্লেষণ করতে পারবে
৮. সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের গৃহিত কার্যক্রম বিশ্লেষণ করতে পারবে
৯. খাদ্য সংরক্ষণে যে সকল রাসায়নিক ব্যবহার হয় সেগুলোর ক্ষতিকর দিক শনাক্ত করতে পারবে
১০. রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত খাদ্যের ক্ষতিকর দিকগুলো বিশ্লেষণ করতে পারবে
১১. ক্ষতিকারক পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলো শনাক্ত করতে পারবে
১২. খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণে রাসায়নিক ব্যবহারে সতর্কতা ও করণীয়দিকগুলো চিহ্নিত করতে পারবে
পহেলা বৈশাখে ইলিশের চাহিদা বৃদ্ধি পায় । তাই মাছ ব্যবসায়ী আজমল অতিরিক্ত মুনাফার প্রত্যাশায় কয়েক মাস পূর্ব থেকেই ইলিশ মাছে এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে গুদামে সংরক্ষণ করেন ।
মি. বিল্লাহ একজন সমাজ গবেষক সাদা মনের মানুষ। তিনি সমাজে নানান অশান্তি, মানুষের মাঝে নানান জটিলতা, নির্দ্বিধায় মিথা বলা ও অন্যকে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা দেখে ব্যথিত হন। মেয়ের সাথে মার্কেটে গেছেন । বিক্রয়কর্মী দাম চাইলো। বললো, এটা তার ৫০০ টাকায় কেনা। ৪৫০ টাকায় বিক্রয় করলো । তিনি দোকানিকে বললেন, বাবা মিথ্যা কথা কেন বলো? ছেলেটা বললো, স্যার এটা না বললে ব্যবসায় করা যায় না । আম পাকাতে নিষিদ্ধ ক্যামিক্যাল কেনো ব্যবহার করো এটা জিজ্ঞাসা করলেন একদিন এক ব্যবসায়ীকে । ব্যবসায়ীর জওয়াব, স্যার আপনারাতো আমের রং ভালো না হলে কেনেন না, তাই আমাদের করার কী? বাড়ির পাশে রাস্তায় কাজ করছে কন্ট্রাক্টর । কোনোভাবে ফাঁকিঝুঁকি দিয়ে কাজ হচ্ছে দেখলেই বোঝা যায় । তিনি কন্ট্রাক্টরকে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা কেনো এভাবে কাজ করো? তার সাফ জওয়াব, কাজ পেতেই ২৫% বিভিন্ন পক্ষকে দিতে হয়েছে । কাজ শেষ করে বিল আনতে নানানভাবে ২৫% যাবে। আমার লাভ ২৫% বাদ দিলে কাজ যা হওয়ার তাই হচ্ছে । মি. বিল্লাহ ভাবেন, মানুষের উচিত-অনুচিতের বোধ মরে গেছে সর্বত্রই । যা একদিনে মরেনি একদিনে ভালোও হবে না ঠিক, কিন্তু চেষ্টাটাই বা শুরু হবে কবে?
কোনটা ভালো কোনটা মন্দ, কোনটা উচিত কোনটা অনুচিত এ সংক্রান্ত মানুষের বোধ বা উপলব্ধিকেই মূল্যবোধ বলে । দীর্ঘদিনের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা ইত্যাদির আলোকে ব্যক্তি, দল ও সমাজের মধ্যে এরূপ বোধের সৃষ্টি হয় এবং তা সমাজের মানুষদের আচরণকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে । এরূপ বোধ বা আচরণকে সমাজে মূল্যবান ও অনুকরণীয় বলে মনে করা হয়ে থাকে । মূল্যবোধের ওপর মানুষের বিবেকবোধের একটা সাধারণ প্রভাব থাকায় সকল সমাজেই এরূপ বোধ ও আচরণের একটা সাধারণ ভাবধারা গড়ে উঠতে দেখা যায় । নৈতিকতার সাথে মূল্যবোধের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান । কারণ নৈতিকতা ভালমন্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত । যেটি করা উচিত সেটি করা এবং যা করা উচিত নয় তা থেকে বিরত থাকা- নৈতিকতার বিষয় । এই করণীয় ও বর্জনীয়র বিষয়টি মূল্যবোধ বা দীর্ঘদিনে গড়ে উঠা ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস দ্বারা নিঃসন্দেহে প্রভাবিত হয়ে থাকে । শিক্ষকের কাজ হলো শিক্ষার্থীদের জ্ঞানদান ও মানুষ হিসেবে গড়তে সহায়তা করা। একজন সরকারি কর্মকর্তার কর্তব্য হলো রাষ্ট্রের স্বার্থে জনগণের কল্যাণে অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা । একজন ব্যবসায়ীর কর্তব্য হলো সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে পণ্য ও সেবা সরবরাহের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা । এর সবই মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত না হলে সেখানে বিপত্তি দেখা দেয়াই স্বাভাবিক। আইন ও আইনের যথার্থ প্রয়োগ নৈতিকতার পথে চলতে মানুষকে বাধ্য বা উৎসাহিত করে ঠিকই তবে মূল্যবোধকে সুরক্ষার জন্য সমাজে সুশিক্ষার বিস্তার, সামাজিক সাম্য ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি, কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি রাজনীতিকদের দৃঢ় অঙ্গীকার এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগে যত্নবান হওয়া প্রয়োজন ।
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে উচিত-অনুচিত মেনে চলা বা ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করে চলাই হলো ব্যবসায়ের নৈতিকতা। ব্যবসায় সমাজ বিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ শাখা হওয়ায় এক্ষেত্রে নৈতিকতার বিষয়টি অধিক তাৎপর্যপূর্ণ । ব্যবসায় সমাজের মানুষের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপজীবিকা । মানুষ তার প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার জন্য ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল । তাই ব্যবসায়ী যদি উচিত-অনুচিত না মানে, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ভুলে যায়, অস্বাস্থ্যকর পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় করে, পরিবেশ দূষণ করে মূল্যবোধ হারায় তখন ঐ সমাজে ব্যবসায় নামক পেশার সম্মান ও মর্যাদা যেমনি থাকে না তেমনি সাধারণ মানুষও প্রতারিত হতে হতে ভালো-মন্দ জ্ঞান হারাতে থাকে । যা ঐ সমাজে অনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেয় । তাই ব্যবসায় পরিচালনায় কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনার সকল পর্যায়ে নৈতিক মানদণ্ড মেনে চলাকেই ব্যবসায়ে নৈতিকতা নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে । নিম্নে ব্যবসায়ে নৈতিকতার কিছু বিষয় উল্লেখ করা হলো:
পালনীয় বিষয় | বর্জনীয় বিষয় |
১. বৈধ উপায়ে ব্যবসায় চালানো; ২. সকল ক্ষেত্রে সততা বজায় রাখা ও নির্ভরতার গুণ অর্জন করা; ৩. শ্রমিক-কর্মীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা; ৪. সকলের পাওনা যথাসময়ে পরিশোধ করা; ৫. প্রতিষ্ঠানের বাইরে বিভিন্ন পক্ষের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করা; ৬. স্বগোত্রীয় ব্যবসায়ীদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা; ৭. পরিবেশ রক্ষায় সাধ্যমতো ভূমিকা রাখা; ৮. সরকারি নিয়ম-রীতি মেনে চলা; ৯. আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা; ইত্যাদি | ১. প্রতারণা, শঠতা ও ধোকাবাজির আশ্রয় গ্রহণ না করা; ২. ক্ষতিকর ও বেআইনি পণ্য উৎপাদন বা বিক্রয় না করা; ৩. বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না করা; ৪. একচেটিয়া প্রবণতা পরিহার করা; ৫. মাপে কম না দেয়া; ৬. ক্ষতিকর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হওয়া; ৭. কর ও রাজস্ব ফাঁকি না দেয়া; ৮. আইন মেনে চলা; ইত্যাদি |
শহরের মধ্যবিত্ত একটা পরিবারের কথা যদি ধরা যায় তবে দেখা যাবে চাল-ডাল, তরি-তরকারি, মাছ- গোশতসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সকল জিনিসের জন্য পরিবারটি ব্যবসায়ীদের ওপর সম্পূর্ণভাবেই নির্ভরশীল । তৈজসপত্র, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে জামা-কাপড়, বাচ্চাদের বই-খাতা, কলম, ব্যাগ, নাস্তা, যাতায়াত ইত্যাদি সবকিছুতেই ব্যবসায়ের সংশ্লিষ্টতা । তাই বর্তমানকালে ব্যবসায় মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মানুষের আয় রোজগার ও সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান অবলম্বন । ব্যবসায় শুধুমাত্র একটা দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় সারা বিশ্বেই তার এখন অবাধ বিচরণ । তাই দেশের ভাবমূর্তি এবং সামর্থ্যও এই ব্যবসায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই ব্যবসায় কতটা নীতি-নৈতিকতা মেনে পরিচালিত হচ্ছে তার ওপর সমাজের মানুষগুলোর নৈতিকতার মান, জনগণের মন-মানসিকতা, সামাজিক সুস্থতা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ইত্যাদি নানান বিষয় নির্ভর করে । যে কারণে ব্যবসায়িক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সমাজে অনেক বেশি প্রয়োজন । নিম্নে এর কতিপয় কারণ তুলে ধরা হলো :
১. ব্যক্তিক পরিশুদ্ধি অর্জন (Gaining individual purity): মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। বিশ্বাস ও আচরণে মানুষ পরিশীলিত হবে এটাই সৃষ্টিকর্তার প্রত্যাশা । প্রতিটা মানুষও অন্যের নিকট থেকে এটাই প্রত্যাশা করে । মানুষের বিবেকবোধও তাকে সদা ভালো হয়ে চলার মন্ত্রণা দেয় । তাই একজন ব্যবসায়ী যখন লোভ-লালসা ভুলে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা মেনে ব্যবসায় করে তখন তার মধ্যে আত্মিক পরিশুদ্ধি ও নির্মল মানসিক সন্তুষ্টি অর্জিত হয় ।
২. স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সুরক্ষা (Careful protection of health & safety): যে কোনো সমাজেই স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যবসায়িক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। ফরমালিনযুক্ত মাছ ও ফলমুল, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে উৎপাদিত শাক-সবজি, খাদ্যে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশ্রণ ইত্যাদি স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ভয়ংকর তা সবারই জানা । অবৈধ অস্ত্র বিক্রয় মানুষের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ । তাই ব্যবসায়ীদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এত্থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে ।
৩. উত্তম পরিবেশ সুরক্ষা (Careful protection of environment): মানুষ পরিবেশের দাস । উত্তম পরিবেশ মানুষকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করে । অন্যদিকে প্রতিকূল পরিবেশ মানুষকে করে বিপর্যস্ত । এই পরিবেশ বিষয়টির ওপর ব্যবসায় নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। সমগ্র বিশ্বে পরিবেশ দূষণে মুখ্য ভূমিকা রাখছে শিল্প কারখানাগুলো । তাদের নির্গত গ্যাস ও ধুয়া, নিঃসরিত বর্জ্য পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বুড়িগঙ্গার পানি, ঢাকার বাতাস সবকিছুই এর মারাত্মক শিকার । তাই নৈতিকতার শিক্ষাই ব্যবসায়ীদের পরিবেশ আইনের অনুসরণে ও উত্তম পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর সহযোগিতা দিতে পারে ।
৪. মানসিক প্রশান্তি প্রতিষ্ঠা (Establishment of mental peace): একজন মানুষ কী করছে, কী খাচ্ছে, তাকে ঠকানো হলো কি না- এগুলো নিয়ে যদি সারাক্ষণ দুঃশ্চিন্তায় থাকে তখন ঐ মানুষটির মানসিক প্রশান্তি থাকে না । যখন বাজারে মরা মুরগীর গোশত, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ ও ক্যামিক্যাল দিয়ে পাকানো ফল বিক্রয় হয়, ফরমালিনের ছড়াছড়ি থাকে, সৃষ্টিকর্মের নকল হয় অবলীলায়, নকল ও ভেজাল পণ্য কমদামে বিক্রয় হয় তখন ভোক্তা, ক্রেতা ও বিক্রেতা কেউই মানসিক প্রশান্তিতে থাকতে পারে না। ব্যবসায়িক মূল্যবোধ ও নৈতিকতাই শুধু সে অবস্থায় মানুষের মধ্যে প্রশান্তি সৃষ্টি করতে পারে ।
৫. সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা (Establishment of social attachment): একজন ব্যবসায়ী যখন গ্রাহককে ঠকায় তখন স্বভাবতই ঐ ব্যবসায়ীর প্রতি গ্রাহকের বিরূপ ধারণা জন্মে । একটা সমাজের অনেক ব্যবসায়ী যখন এ অন্যায় কাজটি করে তখন সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিই মানুষের বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ীরা যদি নৈতিকতা মেনে চলে, কাউকে না ঠকায়, মিথ্যা কথা না বলে, মাপে কম না দেয়, কথা ও কাজে মিল রেখে চলে তখন গ্রাহকরা নির্দ্বিধায় ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করতে পারে । এতে সমাজে একটা সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয় ।
৬. জাতীয় ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠা (Establishment of national image): জাতীয় ভাবমর্যাদা যে কোনো জাতির জন্য একটা বড় সম্পদ । ভালো ব্যবসায়ীরা দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । কিন্তু ব্যবসায়ী যদি খারাপ হয়, বিদেশী ব্যবসায়ীদের সাথে প্রতারণা করে তবে দেশের ভাবমূর্তি প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে । একবার বাংলাদেশের কিছু অসাধু চিংড়ি ব্যবসায়ী ওজন বাড়ানোর জন্য চিংড়ির মধ্যে লোহা ঢুকিয়ে বিদেশে বিক্রি করায় সম্ভাবনাময় চিংড়ি খাত যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা অপূরণীয় । ব্যবসায় নৈতিকতায় শুধুমাত্র এ ধরনের অবস্থা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে পারে ।
৭. ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি অর্জন (Gaining business prosperity): ব্যবসায়ে দীর্ঘস্থায়ী সমৃদ্ধি অর্জনেও মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অনুসরণ আবশ্যক । অনেক সময়ই দেখা যায়, অবৈধ ব্যবসায়ী সীমিত সময়ের জন্য আর্থিকভাবে লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদে তার পক্ষে ব্যবসায়ে ভালো করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের ব্যবসায়ীরা শুধুমাত্র নিজেদেরই ক্ষতি করে না একটা খাতের এমনকি দেশের ব্যবসায় অগ্রগতিকেও বাধাগ্রস্ত করে । অথচ যদি দেশের ব্যবসায়ীরা সৎ হয়, নীতি-নৈতিকতার অনুসরণ করে তবে দীর্ঘমেয়াদে ব্যক্তিক ও সামগ্রিক ব্যবসায়িক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয় ।
কীরণ বাজারের একজন ব্যবসায়ী । তার আচরণে গ্রাহক, সরবরাহকারী, প্রতিবেশি ব্যবসায়ী, বাজার কর্তৃপক্ষ কেউই সন্তুষ্ট নয় । তা হলে প্রতিযোগিতার বাজারে কীরণের ব্যবসায়টা কী ভালো চলবে? অসম্ভব। ধরো বাজারের দক্ষ ব্যবসায়ী দোলনের ওপর সবাই সন্তুষ্ট। সবাই তাকে সহযোগিতা করে। তবে নিঃসন্দেহে দোলনের ব্যবসায়টা ভালো চলবে । এই ভালো চলার পিছনে যারা সহযোগিতা করলো তাদের প্রতি যদি দোলন কৃতজ্ঞ হয়, তাদের প্রতি তার দায়িত্ব রয়েছে বলে মনে করে, সাধ্যানুযায়ী দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয় তাহলে সমাজের এই পারে সদস্যরা কী আরও সন্তুষ্ট হবে না? আরও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবে না? এই যে সমাজের প্রতি, বশ স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ (Stackholders) এর প্রতি দোলনের বা তার ব্যবসায়ের দায়িত্ব পালনের অনুভুতি একেই ব্যবসায়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা হিসেবে দেখা হয় ।
দায় হলো কোনো কর্ম সম্পাদনের বা কর্তব্য পালনের দায়, আবশ্যকতা বা গরজ । তাই ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতা হলো সমাজ ও সমাজ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের প্রতি ব্যবসায়ের কর্তব্য পালনের দায় যা সমাজ থেকে প্রাপ্ত নানান সুবিধা ও সহযোগিতার বিপক্ষে তার করা উচিত। ব্যবসায় সমাজবিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ শাখা । সমাজের মানুষগুলোকে পণ্য ও সেবা সরবরাহ করে মুনাফা অর্জন করাই তার উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য পূরণে গ্রাহক বা ক্রেতার বাইরেও তার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান; যেমন- শ্রমিক-কর্মী, ঋণদাতা, পণ্য বা কাঁচামাল সরবরাহকারী, প্রতিবেশি ব্যবসায়ী, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, সরকার ইত্যাদি পক্ষের সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে । এই সহযোগিতা পাওয়ার জন্য বা প্রাপ্তির প্রতিদান হিসেবে ব্যবসায় সাধ্যানুযায়ী নানান ভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালন করে। এর সবই ব্যবসায়ের সামাজিক দায়িত্ব পালন হিসেবে দেখা হয়ে থাকে । এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যবসায়ী নিজেও সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সে নিজের সন্তানদের জন্য যেমনি ভেজাল গুড়ো দুধ, মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ পছন্দ করে না অন্যের জন্যও তার এটাই চাওয়া উচিত । সচেতন মানুষ হিসেবে তার কর্তব্য হলো নীতি- নৈতিকতা মেনে ব্যবসায় চালানো । আর এটাও তার সামাজিক দায়বদ্ধতারই অংশ ।
ব্যবসায়কে বা একজন ব্যবসায়ীকে কেন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে? এর সহজ উত্তর হলো সমাজের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া ব্যবসায় পরিচালনা করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সহযোগিতাকারীর প্রতি সাহায্যগ্রহীতা কৃতজ্ঞ হবে, বিনয়ী হবে- এটাতো স্বাভাবিক বিষয় । একজন ডাক্তার কেন সমাজের মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল হবে? এর জওয়াব যদি এটা হয় যে, তার বাবা-মা তাকে পড়িয়েছেন তাই তাদের প্রতি দায়িত্বশীল হলেই চলবে- সেটা কখনই যথার্থ উত্তর হতে পারে না । তার এ ডাক্তার হওয়ার পিছনে রাষ্ট্র খরচ করেছে । সেই খরচের টাকা কাদের পকেট থেকে এসেছে? দেখা যাবে তার এই ডাক্তার হতে হাজারো মানুষের শ্রম, মেধা ও অর্থ ব্যয়িত হয়েছে। একজন ব্যবসায়ী রাস্তার মোড়ে, বিদ্যুত ও গ্যাস সুবিধা বিবেচনা করে, নিরাপত্তার কথা ভেবে ব্যবসায় গড়ে তুলেছে । এগুলোর ব্যবস্থা করেছে কে? তার শ্রম, মূলধন, মালামাল ইত্যাদি কারা সরবরাহ করছে? তার উৎপাদিত পণ্য ও সেবা কারা কিনছে- তাদের প্রতি কী তার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত নয়? এমনতো নয় যে তার আর কোনো সহযোগিতা লাগবে না । তাই ভবিষ্যতে ভালো করার জন্যও একজন ব্যবসায়ীকে সামাজিক দায়বয়দ্ধতার বিষয়টি মাথায় রেখে ব্যবসায় চালাতে হয়। নিম্নে ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বদ্ধতার গুরুত্ব সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
১. সামাজিক বিপর্যয় রোধ (Prevent to social disaster): দরিদ্র বাবা-মা কষ্ট করে সন্তান মানুষ করেছেন । এখন সেই সন্তান যদি বাবা-মার প্রতি দায়বদ্ধতার কথা না ভাবে তাহলে ঐ পরিবারটার কী দশা হবে? সরকার যদি জনগণের ওপর অধিক ট্যাক্স বসিয়ে, বিদেশ থেকে ঋণ এনে দেশের ব্যবসায় অবকাঠামো গঠন করে, ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণ দেয় আর যদি ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় গড়ে সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দেয়, সরকারের সাথে অসহযোগিতা করে তবে সরকার চলবে কিভাবে? যে ক্রেতা ও ভোক্তা ব্যবসায়ীর সৌভাগ্যের ধন তাদেরকে যদি ঠকায়, প্রতারণা করে, ভেজাল ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন পণ্যে বাজার ছেয়ে ফেলে তাহলে ঐ ক্রেতা বা ভোক্তাদের দশা কী? সমাজের যে মানুষগুলো তাকে সহযোগিতা করে পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে যদি সে ঐ সমাজেই বিপর্যয় সৃষ্টি করে তবে ব্যবসায়ীও কী এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে । তাই সমাজ বাঁচাতে ব্যবসায়ীদের অবশ্যই সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করতে হবে ।
২. সহযোগিতার উন্নয়ন (Development of co-operation) : 'সহযোগিতায় মধুরতা আছে' এ আপ্তবাক্যটি সর্বত্রই প্রযোজ্য । একটা পরিবারে, সমাজে বা রাষ্ট্রে সবাই যদি একে অন্যের সহযোগী হয় তবে তার যে সৌন্দর্য, দৃষ্টিনন্দন ভাব ও ফলাফল তা নিঃসন্দেহে গুরুত্ববহ । সমাজ বিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে ব্যবসায় সমাজ সম্পৃক্ত একটা প্রতিষ্ঠান । সবার সহযোগিতার মধ্য দিয়েই এটি বিকশিত হয় । ব্যবসায়ী, ভোক্তা, শ্রমিক- কর্মচারী, মধ্যস্থ ব্যবসায়ী, ঋণদাতা, সরবরাহকারী, কৌশলগত মিত্র, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, সরকার ইত্যাদি পক্ষসমূহের পারস্পরিক সহযোগিতাতেই একটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা দেশের ব্যবসায় খাত এগিয়ে যায়। পারস্পরিক কর্তব্যবোধ ও দায়বদ্ধতাই শুধুমাত্র এরূপ সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে ব্যবসায়ের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে ।
৩. ব্যবসায়ের সুনাম প্রতিষ্ঠা (Establishment of goodwill of business) : সুনাম ব্যবসায়ের একটা মূল্যবান সম্পদ । এই সম্পদ দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না কিন্তু এর ফল অত্যন্ত বেশি ও সুদূরপ্রসারী । এই সুনাম অর্জনে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের সবারই সুধারণা ও সহযোগিতার প্রয়োজন । একটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান প্রচুর বিজ্ঞাপন দিয়ে বাজারে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে । গ্রাহকদের আগ্রহও বেড়েছে । কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করে না, শ্রমিক কর্মীদের বেতন ও সুযোগ সুবিধা বাড়ায় না, মধ্যস্থ ব্যবসায়ীদের পাওনা ও সুযোগ-সুবিধা দেয় না তাহলে দেখা যাবে ব্যবসায়টির ঋণ খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে, শ্রমিক-কর্মীরা আন্দোলন করায় উৎপাদন বন্ধ হতে পারে, পণ্যমান কমে যাওয়ায় বাজার হারাতে হতে পারে, মধ্যস্থ ব্যবসায়ীরা সহযোগিতা না করায় পণ্য বাজারে না যাওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে । তাই বিভিন্ন পক্ষের সুধারণা সৃষ্টির মধ্য দিয়েই একটা ব্যবসায়ের সুনাম প্রতিষ্ঠিত হয় । যার মূলে থাকে সকল পক্ষের প্রতি ব্যবসায়ের দায়বদ্ধতা ।
সমাজের বিভিন্ন পক্ষের প্রতি ব্যবসায় যে দায়িত্ব পালন করে তাকে ব্যবসায়ের সামাজিক দায়িত্ব পালন বলে । বর্তমান তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায় জগতে ভালো করতে হলে ব্যবসায়ীদেরকে অবশ্যই সমাজের বিভিন্ন পক্ষের প্রতি দায়িত্ব পালনের প্রয়োজন পড়ে। ব্যবসায় 'পালন করে এমন সামাজিক দায়িত্বসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. ক্রেতা ও ভোক্তাদের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility to customers and consumers) : ক্রেতা বা ভোক্তা বলতে গেলে ব্যবসায়ের প্রাণস্বরূপ । এই ক্রেতা বা ভোক্তারা সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ । তাদের আস্থা ও সহযোগিতার ওপর ব্যবসায়ের সফলতা বিশেষভাবে নির্ভরশীল। ব্যবসায় তাদের প্রতি নিম্নোক্তভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে :
২. শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility to employees) : শ্রমিক-কর্মচারীদের পরিশ্রমের ওপর বলতে গেলে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে । তাই তাদের সন্তুষ্ট ও কর্মচঞ্চল রাখার জন্য ব্যবসায় তাদের প্রতি নিম্নোক্তভাবে দায়িত্ব পালন করে :
৩. বিনিয়োগকারী ও সরবরাহকারীদের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility to investors and suppliers) : বিনিয়োগকারীরা তাদের কষ্টের সঞ্চয়কে লভ্যাংশের বা মুনাফার প্রত্যাশায় ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করে । ঋণ ও মালামাল যারা সরবরাহ করে তারাও যথাসময়ে তাদের পাওনা প্রাপ্তির প্রত্যাশা করে । তাই তাদের প্রতি ব্যবসায় নিম্নোক্ত উপায়ে দায়িত্ব পালন করে :
৪. সরকারের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility to Government) : সরকার যেকোনো সমাজের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা। দেশের ব্যবসায় উন্নয়নে সরকারের যেমনি দায়িত্ব রয়েছে তেমনিভাবে ব্যবসায়েরও সরকারের প্রতি দায়িত্ব থাকা স্বাভাবিক । ব্যবসায় সরকারের প্রতি নিম্নোক্তভাবে দায়িত্ব পালন করে :
৫. সগোত্রীয় ব্যবসায়ীদের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility to business community) : বর্তমানকালে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসায় পরিচালনার ক্ষেত্রে সগোত্রীয় ব্যবসায়ীদের প্রতিও দায়িত্ব পালনের প্রয়োজন পড়ে । ব্যবসায়ীরা এরূপ দায়িত্ব পালন না করলে তাদের মধ্যে অন্যায় প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি বৃদ্ধি পায় এবং এতে সকলেরই স্বার্থ বিপন্ন হয়ে থাকে । এ লক্ষ্যে ব্যবসায় যে সকল দায়িত্ব পালন করে তা নিম্নরূপ :
৬. সাধারণ সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব (Responsibility to general communities) : সমাজ ও সমাজের মানুষকে ঘিরেই ব্যবসায় ও এর কার্যাবলি আবর্তিত হয়। এই সমাজ হতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেই ব্যবসায় সমৃদ্ধি লাভ করে । তাই নিম্নোক্ত উপায়ে ব্যবসায় সমাজের প্রতিও তার দায়িত্ব পালন করে :
উপসংহারে বলা যায়, বর্তমানকালে ব্যবসায় শুধুমাত্র নিছক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় না বরং তা সমাজের বিভিন্ন পক্ষের প্রতি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সম্পর্ক সৃষ্টি ও সবার নিকট হতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা লাভের প্রয়াস চালায়। যার ফলশ্রুতিতে ব্যবসায়ের সুনাম বৃদ্ধি পায় এবং এর সাথে ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ ও অধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব হয়ে থাকে ।
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী । স্বাধীন বাংলাদেশে এটা আমাদের গর্বের ধন । কিন্তু এই ঢাকার পরিবেশে যেভাবে বিপর্যয় ঘটেছে তাতে এই শহরের মানুষ এখন বাধ্য হয়ে এখানে বাস করছে বললে অত্যুক্তি হবে না । ভয়াবহ যানজট, হাঁটার রাস্তা সব ব্যবসায়ী ও হকারদের দখলে । বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস নেয়ার সুযোগ সীমিত । ধুলা-বালি, গ্যাস-ধুয়া আর পরিবহণের নির্গত শিশায় বাতাস দূষিত। পরিবহণের গাড়ির উচ্চ শব্দের হর্ণ, কোলাহল ও হৈ চৈ মিলিয়ে শব্দ দূষণ মারাত্মক । খেলার মাঠ নেই । যা আছে তা পরিবহণ কোম্পানির গাড়ি রাখার আর ময়লা ফেলার ভাগাড় । ঢাকার চারদিকে নদী । কিন্তু তা মারাত্মকভাবে পানি দূষণের শিকার । ট্যানারি ও শিল্পের তরল বর্জ্য ফেলার সহজ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে নদীগুলো । দুর্গন্ধে এখন এই নদীর পাশে বাস করাই কষ্টসাধ্য। এখন যদি বলা যায়, এই দূষণের পিছনে প্রত্যক্ষ দায় কাদের? দেখা যাবে উত্তর বেরিয়ে আসবে বেশির ভাগ দায় ব্যবসায়ী শ্রেণির । প্রশ্ন উঠতে পারে সরকার কী করছে? সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে চোখ-কান বন্ধ করে ব্যবসায়ীরা এগুলো করবে এটাতো কাম্য নয় । সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে তাদের দায় রয়েছে এটা কী তারা অস্বীকার করতে পারবে?
বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে বড় দায় হলো ব্যবসায়ী সমাজের । আবহমান কাল থেকে কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি মানুষের চিন্তায় আসেনি । কিন্তু যখন শিল্প-বাণিজ্য বেড়ে ওঠা শুরু হলো তখনই পরিবেশ দূষণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হতে থাকলো । গ্রামের একটা ছোট বাজারকে নিয়েই যদি ভাবা যায় তবে দেখা যাবে হাটের দিন মানুষের কোলাহল, ধুলা-বালিসহ নানানভাবে সেখানের পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়ছে । বাজারে উচ্চ আওয়াজে গানের সিডি বাজানো হচ্ছে, ঔষধ বিক্রেতাসহ নানান বিক্রেতারা মাইকে উচ্চস্বরে বক্তৃতা দিচ্ছে- এভাবে যদি শহর ধরা যায়, রাজধানী ধরা যায় তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ব্যবসায়কে কেন্দ্র করে পরিবেশ কতটা দূষিত হচ্ছে । নিম্নে বিভিন্ন ধরনের দূষণে ব্যবসায়ের প্রভাব সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
১. শব্দ দূষণ ও এর প্রভাব (Sound pollution& its influence) : পারিপার্শ্বিকতায় শব্দ ও কোলাহল বেড়ে যাওয়ার কারণে শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশে যে অস্বাভাবিকতার জন্ম নেয় তাকে শব্দ দূষণ বলে । এই শব্দ দুষণে ব্যবসায়ীরাই মুখ্য ভূমিকা রাখে। ব্যবসায়ের উন্নয়ন এবং বাজার ও শহর সৃষ্টি শব্দ দূষণের অন্যতম কারণ । উড়োজাহাজ উঠছে ও নামছে এতে শব্দ দূষণ ঘটছে । রেলগাড়ি, বাস-ট্রাকসহ সব ধরনের পরিবহণ শব্দ দূষণের কারণ । মেশিনের শব্দ, বুলডোজার ও ড্রিলের শব্দ, নির্মাণ কাজ ইত্যাদি নানান ব্যবসায়িক কাজে শব্দ দূষণ ঘটছে । গ্রামের বাজারে উচ্চ আওয়াজে দোকানে সিডি বাজছে, মাইকিং হচ্ছে- এগুলোরও প্রধান কারণ ব্যবসায় । এরূপ শব্দ দূষণের ফলে মানুষের শ্রবণ শক্তি, চিন্তা ও অনুভূতি শক্তি হ্রাস পাচ্ছে । মানসিক চাপ বাড়ছে, সুস্থ চিন্তা-ভাবনায় বাধার সৃষ্টি হচ্ছে । উচ্চ রক্তচাপসহ কানে ও মাথায় নানা ধরনের রোগ সৃষ্টিতে এরূপ দূষণ অন্যতম কারণ ।
২. পানি দূষণ ও এর প্রভাব (Water pollution & its influence) : পানির স্বাভাবিকতায় প্রাণীজগত ও সৃষ্টিকূলের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকরণের কাজকেই পানি দূষণ বলে । এই পানি দূষণের অন্যতম কারণ ব্যবসায় কর্মকাণ্ড । শিল্পবর্জ্য ও ব্যবসায়িক তরল ময়লা যখন নির্দ্বিধায় পানিতে ছেড়ে দেয়া হয় তখন ঐ পানি মানুষের জন্য আর উপকারী থাকে না । বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষা নদীর পানির রং ও দুর্গন্ধ থেকে এটা সহজেই অনুমান করা যায় । নদীতে ও সমুদ্রে জলযান চলছে। তৈল, ময়লাসহ নানান আবর্জনা ফেলা হচ্ছে পানিতে । তৈল ট্যাংকার ফেটে ও খনি থেকে তৈল নির্গত হচ্ছে পানিতে। এতে পানি তার স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে। এভাবেই ব্যবসায় কর্মকাণ্ড পানি দূষণে বিরূপ ভূমিকা রাখছে। এরূপ পানি দূষণ চর্মরোগ সৃষ্টির মুখ্য কারণ । এছাড়া পানিবাহিত রোগ টাইফয়েড, ডায়রিয়া, জণ্ডিস ইত্যাদি পানি দূষণের ফলে সৃষ্টি হয় । মাছসহ জলজ প্রাণী নিধনে পানি দূষণ মুখ্য ভূমিকা রাখে ।
৩. বায়ু দূষণ ও এর প্রভাব (Air pollution & its influence) : স্বাভাবিক উপাদানের বাইরে বায়ুতে যখন নানান ধরনের ধুয়া, গ্যাস, ধুলা-বালি, সিসাসহ নানান খারাপ উপাদান যুক্ত হয় তখন তাকে বায়ু দূষণ বলে । ব্যবসায় আজ এই নির্মল বায়ু থেকেও মানুষকে বঞ্চিত করছে। ঢাকা শহরের কথাই যদি ধরা যায় তবে পরিবহনের গাড়িগুলো প্রতিদিন যে পরিমাণ ধুয়া ছড়াচ্ছে; তাতে ঢাকার বাতাস দূষিত হচ্ছে । ইটের ভাটা আমাদের দেশে বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ । শিল্প কারখানার ধুয়া, ধুলা-বালি, পরিবহণের পোড়া ডিজেল থেকে নির্গত সিসা ইত্যাদি বায়ু দূষণ করছে। এতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। ওজনস্তর ক্ষয় হচ্ছে। নানান ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে। ত্বক ক্যান্সার, ফুসফুসজনিত রোগ, যক্ষ্ণা, এ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব এ কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
৪. মাটি দূষণ ও এর প্রভাব (Soil pollution & its influence): উর্বর মাটি যখন নানান খারাপ উপাদানযুক্ত হয়ে তার স্বাভাবিকতা হারায় তখন তাকে মাটি দূষণ বলে। এই মাটিও আজকে ব্যবসায় কর্মকাণ্ডের কারণে দূষণের অসহায় শিকার । কৃষি ফার্মগুলো অতিরিক্ত সার আর কীটনাশক ব্যবহার করে মাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে । শিল্পবর্জ্য জমিতে ফেলে মাটির ক্ষতি করা হচ্ছে । ইটের ভাটার টুকরো ইট মাটির সাথে মিশে মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করছে । খনি থেকে সম্পদ আহরণের ফলে জমি যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি এ সকল খনিজ পদার্থ মাটির সাথে মিশে মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে। ভূগর্ভস্থ পানি অধিক মাত্রায় উঠিয়ে ফেলার কারণে মাটির শুষ্কতা বাড়ছে । মাটির নিচ দিয়ে যখন বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ নানান সংযোগ লাইন টানা হচ্ছে তাতেও মাটি তার স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে । এই মাটি দূষণ কৃষি উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে । মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে । দূষিত মাটিতে চাষ করা শাক-শব্জী খেয়ে মানুষ পেটের পিড়া, কিডনি ও লিভারের নানা রোগে ভুগছে।
পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি এখন সারাবিশ্বেই ব্যাপক আলোচনার বিষয়। সুনামি, জলোচ্ছ্বাস, ঘুর্ণিঝড়, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিসহ নানান প্রকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধির উচ্চহার সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে । গ্রীণ হাউজ প্রভাব আগামী ৫০ বছর পর পৃথিবীকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে এ নিয়ে সচেতন সবাই কমবেশি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত । এই পরিবেশে বিপর্যয় সৃষ্টিতে ব্যবসায়ীরা যে সবচেয়ে বেশি দায়ী এ বিষয়টিও পরিষ্কার। তাই শিল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিবেশ সুরক্ষার চাপ বাড়ছে । আমাদের দেশের দিকে তাকালেও দেখা যাবে শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশ দূষণে এগিয়ে । তাই স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন ও বণিক সভাগুলো এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে তা সবাই প্রত্যাশা করে ।
বণিক সভা হলো বণিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখাশুনার জন্য তাদের গড়া স্বেচ্ছাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান । একটা এলাকার বা অঞ্চলের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ী একত্রিত হয়ে বণিক সভা গঠন করে । উক্ত আঞ্চলিক বণিক সভা মিলিত হয়ে আবার জাতীয় পর্যায়ে বণিক সভা গড়ে তোলে । বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ীরাও তাদের ব্যবসায় খাতের উন্নয়নের জন্য সেক্টরভিত্তিক ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তুলতে পারে । বাংলাদেশে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স-আঞ্চলিক বণিকসভার উদাহরণ। বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (FBCCI) জাতীয় পর্যায়ে গঠিত বণিক সভা। ঔষধ প্রস্তুতকারী শিল্প মালিক সমিতি, বাস মালিক সমিতি এভাবে নানান, ধরনের প্রতিষ্ঠান জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তুলে তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখাশুনা, নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষা এবং সরকারকে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শদানসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে । পরিবেশ সুরক্ষায় এ সকল সমিতি ও সংগঠনের নিঃসন্দেহে দায়িত্ব রয়েছে ।
বণিক সভা ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করে । তাই ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বোধের বিষয়টি তাদের দায়বোধেরও বিষয়। সরকার নীতি ও আইন প্রণয়ন করে । সেই নীতি ও আইন যাতে তাদের স্বার্থরক্ষা করে সেজন্য এ সকল প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন প্রয়াস--প্রচেষ্টা চালায়, দেন-দরবার করে । পরিবেশ সুরক্ষায় সরকার যে সকল আইন প্রণয়ন করে সেগুলো তাদের সদস্যরা যেন মেনে চলে তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই বণিক সভা বা সংগঠনগুলোর অবশ্যই দায়িত্ব রয়েছে। একটা সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও আইনানুগ ব্যবসায় খাত গঠন ও পরিচালনায় এরূপ সংগঠনগুলোর দায়িত্ব হলো সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সাহায্য করা । দু- চারটে প্রতিষ্ঠানের কারণে যেন সমগ্র ব্যবসায় খাতের বদনাম না হয় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর তা দেখা সদা কর্তব্য। বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণের যে সকল প্রধান প্রধান আইন ও নীতিমালা কার্যকর রয়েছে তা নিম্নরূপ :
উপরোক্ত আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নে সরকার বণিকসভা ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় সংগঠনগুলোকে সাথে নিয়ে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্রিয় ভূমিকা পালনই এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহায়তা গ্রহণ প্রয়োজন। বিভিন্ন বণিক সমিতিগুলো পরিবেশ দূষণ রোধে নিম্নোক্ত উপায়ে সহযোগিতা করতে পারে :
১. আইনানুযায়ী যে সকল শিল্পে বর্জ্য শোধন যন্ত্রপাতি (ETP) বসানো প্রয়োজন তা সমিতির সকল সদস্য যাতে মান্য করে তা নিশ্চিত করা;
২. কোনো শিল্প ইউনিট এই নিয়ম ভঙ্গ করলে সমিতির সদস্যপদ বাতিলসহ সমিতির পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
৩. ট্যানারি শিল্প দ্রুত ঢাকার মধ্য থেকে চামড়া শিল্প পার্কে সরাতে সরকারকে সর্বোত সহযোগিতা প্রদান করা;
৪. বিক্ষিপ্তভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠান না গড়তে সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করা এবং বিভিন্ন শিল্পের জন্য পৃথক শিল্প এলাকা গড়তে সরকারকে উৎসাহিত করা;
৫. ইটের ভাটাগুলো যেন সরকারি নিয়ম মেনে চিমনি ব্যবহার ও ইটভাটা স্থাপন করে এবং কাঠ পুড়িয়ে বন উজাড় করতে না পারে সেজন্য সমিতির পক্ষ থেকে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা;
৬. মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন যাতে রাস্তায় চলতে না পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট সমিতিগুলোর পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া এবং গণপরিবহন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সরকারকে সহায়তা করা;
৭. গাড়িতে উচ্চ মাত্রায় হর্ণ ব্যবহার না করতে সদস্যদের বাধ্য করা এবং অপ্রয়োজনীয় হর্ণ যাতে বাজানো না হয় সেজন্য ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ দেয়া;
৮. শিল্প বর্জ্য, হাসপাতাল বর্জ্য, তরল ময়লা ইত্যাদির অপসারণের বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করা;
৯. যে সকল শিল্পে উচ্চ মাত্রার শব্দ সৃষ্টি হয় বা ধোয়া ও তরল বর্জ্য নির্গত হয় সে সকল শিল্পে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারপূর্বক তা রোধে ব্যবস্থা নিতে সদস্যদের উৎসাহিত করা;
১০.প্রতিটা সমিতির পক্ষ থেকে পরিবেশ সুরক্ষায় মনিটরিং সেল গঠন, পর্যবেক্ষণ, তত্ত্বাবধান এবং এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা;
১১. পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমিতির পক্ষ থেকে উৎসাহিত ও প্রয়োজনে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করা;
১২. সমিতির আয়ের একটা অংশ পরিবেশ সুরক্ষায় ব্যয়ের নির্দেশিকা জারি করা এবং বনায়ন, পরিবেশ সচেতনতা সৃষ্টিসহ বিভিন্ন কাজে তা ব্যয় করা ইত্যাদি ।
ঢাকা শহরের আশেপাশের নদীগুলোর পানি দূষণের মাত্রা কমানোর জন্য এরই মধ্যে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যবসায় সংগঠনগুলোকে সাথে নিয়ে ১৮০০ এর মত শিল্প-কারখানাকে চিহ্নিত করেছে। তাদের জন্য বর্জ্য শোধন যন্ত্রপাতি (Effluent Treatment plant /ETP) বসানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নতুন শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রেও এ বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে । ট্যানারি শিল্প মালিক সংগঠনের সাথে আলোচনা করে সাভারে ট্যানারি শিল্প সরানোর ব্যবস্থা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকদের সংগঠনের সাথে আলাপসাপেক্ষে এর বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে । ইটভাটাগুলোতে ১২০ ফুট উচ্চতার চিমনী লাগনোতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো সহযোগিতা করায় তার বাস্তবায়ন সহজ হয়েছে । যানবাহনের ধুয়া ও গ্যাস নিঃসরণ বন্ধে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর সহায়তায় ২০০২ সাল থেকে দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনবিশিষ্ট থ্রি হুইলার মোটরযান চলাচল ঢাকার শহরে বন্ধ করা হয়েছে । ক্ষতিকারক পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তা মান্য করা হচ্ছে। এভাবে বণিক সভা ও ব্যবসায় সংগঠনগুলোর সহায়তা গ্রহণে সরকারকে যেমনি এগিয়ে আসতে হবে তেমনি এ সংগঠনগুলোকেও নিজেদের ব্যবসায় খাতের উন্নতি ও সুনাম বজায় রাখতে ও পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। পরিবেশে বিপর্যয় ঘটালে তার হাত থেকে যে কেউই বাঁচতে পারবে না-এ বিষয়টা ব্যবসায়ী ও ব্যবসায় সংগঠনগুলো যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারবে ততই এক্ষেত্রে উন্নয়ন সহজতর হবে ।
সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ব্যবসায়ী সমাজ গ্রাহকদের চাহিদা মতো পণ্য ও সেবা তাদের হাতের নাগালের মধ্যে পৌঁছে দিয়ে নিঃসন্দেহে অনেক বড় সামাজিক দায়িত্ব পালন করে চলেছে । তার বাইরেও ব্যবসায়ীরা ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেও সমাজকে সেবা দিচ্ছে। কিন্তু এই স্বাভাবিক কর্তব্য- কর্মের বাইরেও তাদের সমাজের জন্য অনেক কিছু করার রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন । এজন্যই বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মানুষের মরণঘাতি অসুখের চিকিৎসার গবেষণায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে । হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, হাসপাতালে বিভাগ চালু, চিকিৎসা সেবা প্রদান, পঙ্গু, প্রতিবন্ধী ও অবহেলিত মানুষকে সহায়তা দান, স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি, পরিবেশ সুরক্ষা ইত্যাদি কাজে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে । IBM এর কর্ণধার বিল গেটস, গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানান ভাবে শত শত কোটি ডলার সহযোগিতা করছেন। ভারতে টাটা, বিড়লা ইত্যাদি বড় বড় কোম্পানি হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে সেবা দিচ্ছে । বাংলাদেশের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব পালন (CSR) এর বিষয়ে এগিয়ে আসছে । নিম্নে তার কতিপয় উল্লেখ করা হলো:
কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে । শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি সরবরাহ, খেলাধুলা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নারী উন্নয়ন, প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়ন, বিধবা নারীদের ভাতা প্রদান, মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদ পরিবারের জন্য কল্যাণ ভাতা প্রদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ দেশের ব্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে । CSR এর আওতায় ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো যখন ৫৫ কোটি টাকা খরচ করেছে তখন ২০১২ সালে এ কার্যক্রমে ব্যয়িত হয়েছে ৩০৪.৬৭ কোটি টাকা ।* এ সময়ে শুধুমাত্র শিক্ষাখাতে ব্যয় হয়েছে ৯৮.৩৮ কোটি টাকা ।
২০১২ সালে বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংক CSR এর পিছনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে তার চিত্র নিম্নে তুলে ধরা হলো:
ব্যাংকের নাম | CSR এর পিছনে ২০১২ সালে ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ |
১. ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড | ৫২.৭৭ কোটি টাকা |
২. এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড | ৩৯.১০ কোটি টাকা |
৩. ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড | ৩০.১১ কোটি টাকা |
৪. প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড | ২৯.৫৭ কোটি টাকা |
৫. জনতা ব্যাংক লিমিটেড | ১৩.৭৬ কোটি টাকা |
৬. ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড | ১৩.০২ কোটি টাকা |
৭. অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড | ১০.৪১ কোটি টাকা |
৮. ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক লিমিটেড | ৯.৪৪ কোটি টাকা |
৯. মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড | ৮.৫ কোটি টাকা |
১০. শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড | ৭.৯২ কোটি টাকা |
বাংলাদেশে ব্যাংকসমূহের মধ্যে ডাচ বাংলা ব্যাংক CSR এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে । তারা ২০১১ সালে ৬,০৩৫ জন শিক্ষার্থীকে ১৬ কোটি টাকা প্রদান করেছে। ব্যাংকটি ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে একটা ক্যাথ ল্যাব (Cath Lab) এবং লিভার ও কিডনি সংযোজনের জন্য দু'টি অপারেশন থিয়েটারের পিছনে ৯.৩৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে । ২০০৩ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ৩,০০০ এর বেশি ঠোঁট কাটা রোগীর প্লাস্টিক সার্জারির ব্যবস্থা করেছে । বিভিন্ন সময়ে ৩৫১ জন এসিড দগ্ধ নারীকে ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করেছে। ৮০০ এর বেশি বিধবা মহিলাকে ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করেছে। ২০০৭ সালের সিডর দুর্গত মানুষের জন্য ব্যাংকটি ৪.২২ কোটি টাকা প্রদান করে । এ ছাড়া ব্যাংকটি পরিবেশ সুরক্ষায় ও ভোটার আইডি কার্ড তৈরি সহ বিভিন্ন খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে ।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণ ফোন CSR এর আওতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে সমাজের মানুষদের জন্য কাজ করে চলেছে। জন সচেতনতা সৃষ্টি, সরকারের টীকাদান কর্মসূচিতে সহায়তা দান, চক্ষু চিকিৎসা সেবা প্রদান, টেলি চর্ম চিকিৎসা সহায়তা প্রদান, নিরাপদ মাতৃত্ব ও শিশু যত্ন সেবা প্রদান, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ সেবা, অনলাইন স্কুল সেবা, শিক্ষা বৃত্তি, খেলাধুলায় সহায়তা দান, নন ফরমাল প্রাথমিক স্কুল কাম ঘুর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি সমাজ সেবামূলক কাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি CSR এর ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাথে মিলে শিশুদের পোলিও খাওয়ানো ও টীকাদান কর্মসূচিতে কাজ করে যাচ্ছে। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৪টি চক্ষু শিবির (Eye camp) করে ৩৬,৩২৭ জনকে ফ্রি চিকিৎসা এবং ৪,৭৪৩ জনকে ফ্রি সানি অপারেশনে সহযোগিতা করেছে। গ্রামের চর্মরোগীদের টেলি চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানটির আরেকটি জনসেবা কার্যক্রম । ২০১২ সালে ১,৫০০ এর বেশি রোগী এ পদ্ধতিতে বিজ্ঞ চিকিৎসকদের চিকিৎসা সেবা লাভ করেছেন। পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল এর সাথে সহযোগিতায় ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ‘সুর্যের হাসি’ প্রজেক্ট এর আওতায় ১৭,০৩,৭৬৭ জন মাকে নিরাপদ মাতৃত্ব সেবা সহযোগিতা প্রদান করেছে ।
বাংলাদেশের স্বনামধন্য উদ্যোক্তা মরহুম আকিজ উদ্দিন প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপ বাংলাদেশের একটা অন্যতম শিল্প গ্রুপ হিসেবে পরিচিত। ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০টির মত সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘আকিজ’ সহ বিভিন্ন নামে কর্মরত রয়েছে। বাংলাদেশে CSR এর ক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রম অত্যন্ত সুবিদিত। তাদের প্রতিষ্ঠিত আদ-দ্বীন ফাউন্ডেশন চিকিৎসা সেবা প্রদানে অনন্য নজীর সৃষ্টি করেছে । এই ফাউন্ডেশনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্নরূপ ;
আদ-দ্বীন ফাউন্ডেশনের বাইরেও প্রতিষ্ঠানটি আকিজ ফাউন্ডেশন স্কুল, আকিজ এতিমখানা, শেখ আকিজ উদ্দিন হাইস্কুল, ফিরোজা ফাউন্ডশেন নামে কতকগুলো শিক্ষামূলক ও সমাজধর্মী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। উল্লেখ্য গ্রুপের অধীন শেখ আকিজ ফুটওয়্যার (SAF) লিমিটেড ঢাকায় টেলিফোন কলের মাধ্যমে খুবই কম খরচে এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস পরিচালনা করছে । এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি সাপ্তাহিক দু'টি দাতব্য শিশু সেবা কেন্দ্র পরিচালনা করে । ঢাকায় প্রতিবছর তারা বড় ধরনের চক্ষু ক্যাম্প পরিচালনা করে থাকে। যেখানে কমবেশি দু'হাজার রোগীকে তারা স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৩৬টি চক্ষু ক্যাম্প পরিচালনা করেছে । যেখানে ৪৩,৬৫৯ জনকে চক্ষু স্বাস্থ্য সেবা প্রদান এবং ৩,৩১৬ জনকে ছানি (Cataract) অপারেশন করানো হয়েছে । এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ, পলিও ক্যাম্পে সরকারের সাথে কার্যক্রম পরিচালনা, বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিশোধন এবং বৃক্ষ রোপনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি পালন করছে । একইভাবে আকিজ গ্রুপের অন্যান্য প্রতিটা প্রতিষ্ঠানেরও এরূপ নিজস্ব CSR কর্মসূচি রয়েছে ।
প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত স্কয়ার গ্রুপ বাংলাদেশে একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প গ্রুপ হিসেবে পরিচিত । প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব পালন (CSR) এর বিষয়ে যত্নশীল । গ্রাহকদের উত্তম মানের পণ্য সরবরাহের পাশাপশি কর্মীদের কল্যাণের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত আন্তরিক । শ্রমিকদের যে সকল অধিকার আইনে বলা হয়েছে তার অনুসরণে প্রতিষ্ঠানটি সচেষ্ট । সরকারকে রাজস্ব প্রদানে প্রতিষ্ঠানটি স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়ে থাকে । যে কোনো ধরনের দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি 0 (Zero) Tollerence এর নীতি অনুসরণ করে । প্রতিষ্ঠানটি ঢাকায় একটা বড় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সচেষ্ট রয়েছে । স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন NGO প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। এছাড়া দেশে খেলাধুলার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। পাবনায় প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানসহ অন্যদের পড়াশুনার জন্য ভালোমানের একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুনাফাবিহীনভাবে পরিচালনা করছে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রতিষ্ঠানটি এর নারী শ্রমিক-কর্মীদের আবাসন সুবিধাসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করে থাকে`। তথ্য প্রযুক্তির বিষয়ে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা, পাবনার ঐতিহ্যবাহী আনন্দ গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি পুনঃনির্মাণ ও উন্নয়ন ইত্যাদি জনহিতকর কাজে প্রতিষ্ঠানটির উজ্জ্বল ভূমিকা ভবিষ্যতেও বহাল থাকবে বলে আশা করা যায় ।
১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত গেটস ফাউন্ডেশন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও স্বচ্ছতার সাথে পরিচালিত প্রাইভেট ফাউন্ডেশন । মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি জগতের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিল গেটস এবং তার স্ত্রী মেলিন্দা গেটস এর নামে ফাউন্ডেশনটি গঠিত। এই ফাউন্ডেশনের তিনজন ট্রাস্টি হলেন মি. ও মিসেস গেটস এবং প্রখ্যাত শেয়ার ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফেট (Warren Buffet) । ২০১২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের হিসাব মতে ফাউন্ডেশনের দানপ্রাপ্ত সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৩৬.২ কোটি বিলিয়ন ডলার । প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটি তার সম্পদের কমপক্ষে ৫% মানব কল্যাণে দান করে থাকে। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৪.৪ বিলিয়ন ডলার দান করেছে। যার বাংলাদেশী টাকায় মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৩৬,০০০ কোটি টাকা । প্রতিষ্ঠানটির দানের তিনটি প্রধান খাত হলো-
১. বৈশ্বিক স্বাস্থ্য কর্মসূচি (Global Health Program) : এই কর্মসূচির আওতায় প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে অর্থ সহযোগিতা প্রদান করে । এক্ষত্রে উল্লেখযোগ্য কতিপয় খাত নিম্নে তুলে ধরা হলো-
২. বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি (Global Development Program) : বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ফাউন্ডেশন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
৩. যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কর্মসূচি (United States Program) : গেটস ফাউন্ডেশন আমেরিকান স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা বৃত্তি এবং এককালীন দান হিসেবে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে । এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের গবেষণা কর্মে, বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানে নতুন আবিষ্কার ইত্যাদি কাজে প্রচুর আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে ।
উচিত-অনুচিত মেনে ব্যবসায় পরিচালনাকেই ব্যবসায় নৈতিকতা বলে । এর সাথে আইন ও নীতি দুটি বিষয়ই সম্পর্কযুক্ত। আইন মেনে যেমনি ব্যবসায় চালানো আবশ্যক তেমনি নীতি বা আদর্শ অর্থাৎ যা সমাজে করণীয় ও বর্জনীয় বলে প্রতিষ্ঠিত- এমন বিষয়াবলি মেনে ব্যবসায় পরিচালনা করাও অপরিহার্য । প্রতারণা করা, পণ্যে ভেজাল মিশানো, মাপে কম দেয়া, নকল পণ্য বাজারে উৎপাদন ও বিক্রয় করা ইত্যাদি দণ্ডনীয় অপরাধ এবং সেই হিসেবে অনৈতিক। অন্যদিকে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না করা, অতি মুনাফার লোভ পরিত্যাগ করা, একচেটিয়া প্রবণতা পরিহার করা, শ্রমিক-কর্মীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা ইত্যাদি আদর্শ বা বিবেকবোধের বিষয় । যা ব্যবসায়ীদের মেনে চলা উচিত । এর বাইরেও বর্তমানকালে ব্যবসায়িক নৈতিকতা সংক্রান্ত কিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে । বিষয়গুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো:
মি. মৃদুলের একটাই ছেলে । এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে । শুরু থকেই মায়ের সাথে স্কুলে যায় । কত কিছু খাওয়ার বায়না । কেক, বার্গার, ফাস্টফুড, চকলেট, আইসক্রীম, কোমল পানীয় তার ভীষণ পছন্দের । বাবা অফিস থেকে ফিরতে মিষ্টি ও ফলমূল প্রায়সই নিয়ে আসেন । ছেলের ভাত-রুটি ও স্বাভাবিক খাদ্যের প্রতি আগ্রহ নেই বললেই চলে । ইদানিং দ্রুত মুটিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে বাবা-মা বিষয়টি ততটা আমলে নেননি । এখন একটু থেকে একটু হলেই ঠাণ্ডা, জ্বর, পেটের পীড়া লেগেই থাকে । বড় ডাক্তারের কাছে নেয়া হলে ডাক্তার সাহেব সব জেনে-শুনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যা বললেন তার অর্থ দাঁড়ায়, ছেলেকে আদর করে ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত যে খাদ্য খাওয়াচ্ছেন তা তার শরীরের বিভিন্ন কোষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে । হরমোনে নানান সমস্যা দেখা দিয়েছে। রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তাই ছেলেকে বাঁচাতে এ সকল অপখাদ্য খাওয়ানো বন্ধ করুন । মি. ও মিসেস মৃদুল ভাবছেন, তাদের দোষেই ছেলের আজ এ অবস্থা ।
প্রাণী, গাছপালাসহ সকলের জীবন ধারণের জন্যই খাদ্যের প্রয়োজন । মানুষ তার বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই খাদ্য গ্রহণ করে । এই খাদ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ স্বভাবজাত । তাই নানান ধরনের খাদ্য-দ্রব্য, ফলমূল, তরি- তরকারি এগুলো নিয়ে সারা বিশ্বে জমজমাট ব্যবসায়। খাদ্য ও খাদ্য জাতীয় সামগ্রী একটা পচনশীল বিষয় । ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণেও খাদ্য-দ্রব্য দ্রুত নষ্ট হয়। তাই ব্যাকটেরিয়া ও পচনশীলতা থেকে রক্ষায় এ ধরনের পণ্যে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও খাদ্যের রং, ঘ্রাণ, স্বাদ, সৌন্দর্য, ঘনত্ব ইত্যাদি বাড়াতেও এরূপ রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার লক্ষণীয় । একটা সীমিত পর্যায় পর্যন্ত এ সকল পণ্যে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর বিষয়টি অনমোদিত হলেও এর সুবাদে সর্বত্রই ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের প্রতিযোগিতা চলছে । উন্নত দেশগুলোতে এগুলো নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের মত দেশে তা নেই । সেখানকার ক্রেতারা শিক্ষিত ও সচেতন হওয়ায় এর ব্যবহার সীমিত পর্যায়ে থাকছে । কিন্তু আমাদের দেশে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ব্যবহার মারাত্মক। আইন থাকলেও তার প্রয়োগের অভাবে অসাধু ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার করছে। ক্রেতাসাধারণ একদিকে অসচেতন ও অন্যদিকে অসহায়। কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছাড়াই খাদ্যদ্রব্য, মাছ, তরি-তরকারি, ফলমূলসহ সর্বত্রই ব্যাপকভাবে ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য; যেমন- নাইট্রেটস (Nitrates), সালফাইডস (Sulfdes), ফর্মালিন (Formalin), সালফার ডাইঅক্সাইড (Sulphur Dioxide), অ্যালজিনেট (Alginate) ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন ফল পাকাতে ক্ষতিকারক কার্বাইড (Carbide) ব্যবহৃত হচ্ছে । খাদ্যকে আকর্ষণীয় রংযুক্ত করতে বিভিন্ন কালারিং এজেন্ট (Coloring agent) ব্যবহার করা হচ্ছে । এর ফলে বিভিন্ন বয়সের মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সামনে পড়ছে। কোষের ক্ষতি করায় কান্স্যারের ঝুঁকি বাড়ছে । পরিপাক তন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি করায় কিডনি, লিভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে মারাত্মক রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। শরীরে মেদ ও চর্বি সৃষ্টি হওয়ায় হার্টের সমস্যা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি মরণঘাতি রোগ ব্যাপকভাবে বাড়ছে। শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমে যাওয়ায় নানান ধরনের রোগ সংক্রমন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মানুষকে রক্ষায় ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই ।
আমি (লেখক) কৃষক পরিবারের সন্তান। ১৯৬৫ সালের দিকে ইরি জাতের ধানের আবাদ শুরু হলে ইউরিয়াসহ বিভিন্ন সারের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করেছি । ক্ষেতে ইউরিয়া ব্যবহারের দিন দশকের মধ্যেই ধানের গাছ কিভাবে দ্রুত উন্নতি লাভ করে তা দেখে কৃষকরা অভিভূত । তাই এ সার ব্যবহারে এক ধরনের প্রতিযোগিতা দেখছি কৃষকদের মধ্যে। ধানে ও অন্য ফসলে কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার না করলে রোগ-বালাই বাড়ে । তাই নামমাত্র মূল্যে বিক্রয় হওয়া কীটনাশক ঔষধ ছিটানো হয়েছে মাত্রাতিরিক্তভাবে । ক্ষতি কী হয়েছে তখন তা এতটা নজরে আসেনি । তবে খাল-বিলসহ, নদ-নদীর মাছ, ব্যাঙসহ জলজ প্রাণী, ভালো-পোকা-মাকড় এমন কী পাখীও মরেছে ব্যাপক হারে। ক্ষতিকর DDT পাউডার ময়দা নাড়ার মত ছাইয়ের সাথে মিশিয়ে বেগুনের জমিতে ছিটিয়েছি- সে দৃশ্যও মনে পড়ে । এর কুফল নতুন নতুন রোগ বালাইয়ের মধ্য দিয়ে মানুষ এখন প্রত্যক্ষ করছে। এখন মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করে হাইব্রিড জাতীয় বিভিন্ন ফসলের আবাদ করা হচ্ছে । দ্রুত ফলন বৃদ্ধির জন্য গাছে থাকা কলা, আমসহ সর্বত্র স্প্রে করা হচ্ছে, স্বাভাবিক বৃদ্ধি থামাতেও ক্ষতিকর রাসায়নিক স্প্রে করা হচ্ছে। এগুলো যে মানুষের জীবনের জন্য কত বড় ক্ষতিকর তা উৎপাদনকারীরা কে কতটা বুঝছে কে জানে?
খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে রাসায়নিক ব্যবহার আধুনিক চাষাবাদের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ । জমির পরিমাণ বাড়ছে না অথচ অনেক বেশি ফসল চায়। সেজন্য ফসলের নতুন নতুন জাত আবিষ্কারে গবেষক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমনি চেষ্টা চালাচ্ছে তেমনি অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও হরমোন জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করা হচ্ছে । এতে ফসলের উৎপাদন বাড়ছে ঠিকই কিন্তু অতিরিক্ত মাত্রায় ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমনি মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে তার ক্ষতিকর প্রভাব উৎপাদিত ফসলের মধ্যেও এসে যাচ্ছে । যা মানুষের শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে স্বাস্থ্য ঝুঁকির জন্ম দিচ্ছে । তরি-তরকারি ও ফলমূলে এ জাতীয় ক্ষতিকর রাসায়নিকের প্রভাব পড়ছে অনেক বেশি। শাক-সব্জীতে এ ধরনের রাসায়নিক স্প্রে করার পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা না করে এগুলো সংগ্রহ করে খাওয়ার কারণে তা শরীরে যেয়ে পৌঁছাচ্ছে। এতে পরিপাক তন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দিচ্ছে। ফসলে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ফলমূলে স্প্রে করায় তা খেয়ে মানুষের হরমোনেও নানান ধরনের অসঙ্গতির সৃষ্টি করছে। সবমিলিয়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন ধরনের দরকারি পোকা-মাকড় ও জলজ প্রাণির সাথে মানুষের জীবনেও মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ছে কিডনি ফেইলিওর (Failure), লিভার সিরোসিস, ব্লাড প্রেসারসহ বড়-ছোট নানান ধরনের রোগ। অসচেতনভাবে এ ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করতে যেয়ে কৃষকের শ্বাস-প্রশ্বাসে তা শরীরের ভিতরে যেয়েও ঘাতক ব্যাধির সৃষ্টি হচ্ছে । ত্বকেও দেখা দিচ্ছে নানান সমস্যা । তাই স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে এ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার প্রয়োজনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা ও ব্যবহারে সতর্ক হওয়া অত্যন্ত জরুরি ।
বাংলাদেশ ব্যাপক জনসংখ্যা অধ্যষিত একটা দেশ। ঢাকা শহরেই এক কোটির ওপর লোকের বাস। শহরাঞ্চলগুলোতে ব্যাপক পরিবেশ দূষণের কারণে মানুষ সবসময় স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করে। পরিবেশ দূষণের আর সব কারণের মধ্যে পলিথিন একটা অন্যতম কারণ হিসেবে বাংলাদেশে চিহ্নিত। পলিথিন এমন একটা পণ্য যা মাটির মধ্যে মেশে না ও পানিতে গলে না । ফলে মাটি দূষণের ও পানি দূষণের তা অন্যতম কারণ । এর ব্যাপক ব্যবহার এবং যত্রতত্র তা ফেলার ফলে রাস্তা-ঘাট, বাসা-বাড়ি সর্বত্র তা আবর্জনা সৃষ্টির একটি কারণ হিসেবে বিবেচিত। স্যুয়ারেজ লাইন আটকে যাওয়া, জলাবদ্ধতা ইত্যাদির অন্যতম কারণ এ ধরনের পলিথিন । অন্যান্য ময়লা ও বর্জ্য যেভাবে সংগ্রহ, বহন ও নিঃশেষ করা যায় এটা তা করা যায় না । বরঞ্চ ব্যবহৃত পলিথিন সংগ্রহ করে পুনরায় উৎপাদন কাজে লাগাতে যেয়ে এটা আরেক ধরনের বায়ু দূষণের সৃষ্টি করে । তাই সবকিছু বিবেচনায় সরকার ১০০ মাইক্রোনের নিচে উৎপাদিত সকল ধরনের পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার ১ জানুয়ারি ২০০২ থেকে ঢাকা মহানগরীতে এবং ১ মার্চ ২০০২ থেকে সারাদেশে নিষিদ্ধ করেছে । এর বিকল্প বিভিন্ন রকমের চট, কাপড়, কাগজের ব্যাগ, ঠোঙ্গা ইত্যাদি ব্যবহারে সরকার জনগণকে উৎসাহিত করছে । যদিও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বা যোগসাজসে পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাত করছে তথাপিও এর ব্যাপক ব্যবহারের ফলে যে দৃশ্যমান বিপদের সৃষ্টি হয়েছিল তা কমে এসেছে ।
খাদ্য ছাড়া জীবন বাঁচে না । সেই খাদ্যই যদি মানুষের জীবন সংহারক হয় তবে তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? বিষ খেলে মানুষ মারা যায়- এটা ঠিক কিন্তু যে বিষ খেয়ে মানুষ একবারে মরে না, খাদ্যের সাথে ধীরে ধীরে মানুষের শরীরে ঢুকে নিরবে ঘাতক রোগের সৃষ্টি করে, মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় - সেই খাদ্য, সেই খাদ্যের উৎপাদন ও খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার দ্রুত বন্ধ হওয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে। সমস্যা হলো রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার একবারে বন্ধ করার বিষয়ে কেউই হয়তোবা রাজি হতে চাইবে না । কারণ খাদ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার অত্যাবশ্যক। খাদ্য সংরক্ষণেও সীমিত মাত্রায় এর ব্যবহার বিশেষজ্ঞগণ অনুমোদন করেন। কিন্তু অধিক মাত্রায়, বেপরোয়াভাবে এর ব্যব হার অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত । উল্লেখ্য উন্নত দেশসমূহে কোনোরূপ রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার ছাড়াই 'অর্গানিক ফুড’ উৎপাদনের দিকে তারা নজর দিচ্ছে ও কৃষকদের উৎসাহিত করছে। সে সব দেশে 'অর্গানিক ফু' ড' প্রকৃতই অর্গানিক ফুড কি না তা পর্যবেক্ষণ, পরীবিক্ষণ সনদ দেয়ার জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ রয়েছে । রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার সে সকল সমাজের কৃষকদের মধ্যে সচেতনতার সৃষ্টি হচ্ছে । ফলে তারা বিষয়গুলোকে তাদের ম তো করে সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে । আমাদের দেশে এই অশুভ রাসায়নিকের কুফল থেকে বাঁচতে নিম্নোক্ত পন্থ সমূহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি :
১. সরকারের করণীয় (Duty of Govt.) : যে কোনো সমাজেই সরকার হলো সবচেয়ে বড় দায়িত্বশীল সংস্থা । আইন ও নীতিমালা প্রণয় ন এবং তার বাস্তবায়নের গুরুদায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তে। রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের মাত্রা নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের উৎপাদন ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যে কেউ যেন অবাধে এ সকল জিনিস সংগ্রহ করে খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণে ব্যবহার করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ফরমালিনের ব্যবহার বন্ধে সরকার যেভাবে ভ্রাম্যমান আদালতসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়ে।ছে সর্বক্ষেত্রে তার যথাযথ প্রয়োগে সরকারকেই সর্বোচ্চ আন্তরিকতাসহ এগিয়ে আসা উচিত ।
২. খাদ্য উৎপাদনকারী ও বিক্রেতাদের করণীয় (Duty of food producers and sellers): যারা রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারের করে খাদ্য উৎপাদন করছেন তাদের সচেতনতা ও আন্তরিকতা এক্ষেত্রে ভালো ফল দিতে পারে । অনেক কৃষক বা খামারি রয়েছেন যারা এগুলোর ক্ষতিকর ব্যবহার সম্পর্কে ততটা ওয়াকিবহাল নয় । জৈব সার, জৈব কীটনাশক ও নতু ন নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে খরচ কমানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি না করেও ফসল উৎপাদন করা যায়- এ বিষয়ে তাদের সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন । উৎপাদক ও বিক্রেতাদের অধিকাংশই নিজেদের সামান্য লাভের জন্য কী করছে ও কী বিক্রি করছে তা বুঝতে চান না । তাই তাদেরকে যদি এ সকল জিনিস ব্যবহার ও বিক্রয়ের বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক করা যায় তবে ক্ষতিকর এ সকল দ্রব্যের ব্যবহার কমে আসতে পারে ।
৩. গ্রাহক বা ভোক্তাদের করণীয় (Duty of customer or consumers): ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহৃত উৎপাদিত খাদ্য যারা খাচ্ছেন বা ব্যবহার করছেন তারাই প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণি। যদিও এরূপ খাদ্য উৎপাদক ও বিক্রেতারা ও কার্যত এক পর্যায়ে এরই অন্তর্ভুক্ত । এই শ্রেণি কী কিনছেন, ক্ষতিকর রাসায়নিকের প্রভাব পণ্যে বা খাদ্যে আছে কি না- এগলো যাচাই-বাছাই করার চেষ্টা করেন, একটু বেশি পয়সা দিয়ে হলেও অর্গানিক বা কার্যকর শানের পণ্য ক্রয় করেন তবে এরূপ ক্ষতিকর দ্রব্যের উৎপাদন ও বিক্রয় নিরুৎসাহিত হতে পারে । এছাড়া বেগুন, বরবটি, সীম ইত্যাদি তরকারি কম কিনে চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, কাঁচাকলা, কচুর চলতি ইত্যাদি তরকারি বেশি খাওয়ার অভ্যাস করা যেতে পারে । ফলের ক্ষেত্রেও আগেল, কলা, আঙ্গুর ইত্যাদি কমিয়ে কাঠাল, ডালিম, আমড়া, কামরাঙ্গা ইত্যাদি খেলে হয়তো ক্ষতিকর রাসায়নিকের প্রভাব কমতে পারে ।
৪. গণমাধ্যমের কর্তব্য (Dutyt of mass media) : মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি এবং অন্যায় কর্মকাণ্ডকে নিরুৎসাহিত করতে যে কোনো সমাজেই গণমাধ্যম; যেমন- রেডিও, টেলিভিশন, ইত্যাদির দায়িত্ব অনেক বেশি। প্রতিটা চ্যানেল যদি খাদ্য উৎপাদনে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের কুফল মিডিয়াতে তুলে ধরে, উৎপাদকদের করণীয় এবং এগুলোর ব্যবহার ভিন্ন যারা পণ্য উৎপাদন করছে তাদের কৌশলগুলো মানুষের সামনে উপস্থাপন করে তবে উৎপাদকরা এ বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক হবে। যদি এ প্রচেষ্টার মাধ্যমে গ্রাহক বা ভোক্তা পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি; করা যায়, এর কুফল বা ক্ষতিগ্রস্তদের অবস্থা তুলে বিশেষজ্ঞদের মতামত প্রকাশ করা হয়। সরকারি উদ্যোগ 'ও আইনগত বিষয়াবলি জানানো যায় তবে প্রচারের এ যুগে তা ভালো ফল দিতে পারে ।
Read more